আমার বয়স যখন মাত্র ছয় বছর, ঠিক সে সময় থেকেই এই বিশেষ মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পিঠে হেলান দিয়ে আমি নভোযান কলাম্বিয়ার সিটে নিজেকে বেঁধে নিলাম। ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসের ৮ তারিখ। মহাকাশে আমার প্রথমবার যাত্রার মাত্র কয়েক মিনিট আগের ঘটনা এটা। নভোযানটি মহাকাশে ছোটার মাত্র ছয় সেকেন্ড আগে প্রধান ইঞ্জিন প্রাণ পেয়ে গর্জাতে লাগল। আমার পেছনের সিট বন্য উদ্যমে কাঁপতে শুরু করল। ভাগ্যিস সিটবেল্ট শক্ত করে বাঁধা ছিল। নইলে অনেক আগেই নভোযানের মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে হতো। মুহূর্তেই কলাম্বিয়া প্রবলবেগে মাটি ছেড়ে আকাশের দিকে ছুটতে লাগল। সে সময় মনে হলো, আমার পিঠের ঠিক মাঝখানে হাত রয়েছে। সেই হাতটাই আমাকে ঠেলে সোজা আকাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কলাম্বিয়া ওপরের দিকে উঠছিল। প্রচণ্ড উত্তেজনায় হেলমেটের ভেতরে আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘ইয়াহু! লেটস গো!’ তবে ইঞ্জিনের প্রবল গর্জনের কারণে আমার চিৎকার কেউ শুনতে পেল না। সাড়ে আট মিনিট পর সবকিছু নীরব হয়ে গেল। কলাম্বিয়ার প্রধান ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। অবশ্য যখন বুঝতে পারলাম, শেষ পর্যন্ত আমি মহাকাশে পৌঁছে গেছি, তখন আরেক উত্তেজনার ঢেউ বইতে লাগল আমার ভেতরে। যা-ই হোক, এখন মহাকাশ থেকে আমার প্রথমবার দেখা পৃথিবী সম্পর্কে কিছু কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত
সিটবেল্ট খুলে আমি ভাসতে ভাসতে কলাম্বিয়ার জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু যে দৃশ্য দেখলাম, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কাচে নাক চেপে বাইরে তাকিয়ে খাবি খাওয়ার মতো অবস্থা তখন। বাইরের দৃশ্য দেখে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।
সামনে মখমলের মতো নিকষ কালো আকাশ দেখতে পেলাম। আমার দেখা সবচেয়ে গাঢ় রঙের ছিল ওই দৃশ্যটাই। গাঢ় কালির মতো অন্ধকারও দেখে মনে হচ্ছিল, তা জ্বলজ্বল করছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উজ্জ্ব্বল নীল একটি স্তর মহাকাশের সেই নিষক কালো ছুঁয়ে ছিল।
নভোযান থেকে সেবার সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। মহাকাশে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। পৃথিবীতে আমরা প্রতিদিন একবার সূর্যোদয় আর একবার সূর্যাস্ত দেখতে পাই। পৃথিবীর ঘূর্ণন আর নিজের অক্ষের ওপর লাটিমের মতো পৃথিবী ঘোরে বলেই এমনটি ঘটে। একটি ঘূর্ণন শেষ করতে পৃথিবীর ২৪ ঘণ্টা লাগে।
কিন্তু নভোযান প্রতি ৯০ মিনিটে পৃথিবীর চারপাশে একবার ঘোরে। তার মানে, নভোযান থেকে প্রতিদিন আমি ১৬ বার সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখতে পারতাম। সেবার মহাকাশ ভ্রমণে এক শর বেশিবার এ ঘটনা দেখতে পেয়েছিলাম।
আমাদের নক্ষত্র সূর্য
নভোযান সাধারণত ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে পাক খায়। এ গতির কারণে পৃথিবীর তুলনায় মহাকাশে সূর্যাস্তের ব্যাপ্তি অনেক দ্রুত ঘটতে দেখা যায়। আর দ্রুতগতির কারণে মাঝেমধ্যে দু-একটা সূর্যাস্ত দেখার কোনো সৌভাগ্য তোমার না-ও হতে পারে। আমি দেখেছিলাম, মাত্র ১৩ সেকেন্ডে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দিনের নীল থেকে কমলা, তারপর গাঢ় লাল থেকে আবার রাতের বেলার অন্ধকারে ঢেকে গেল।
তবে পৃথিবী বলো আর নভোযানই বলো, দুই জায়গা থেকেই আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু ওই সূর্যই। আবার আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় বস্তুও সূর্য। এক সূর্যের মধ্যে আমাদের পৃথিবীর সমান কমসে কম ১০ লাখ গ্রহ ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে।
কিন্তু সত্যি বলতে কি, সূর্য হচ্ছে মাঝারি আকারের একটি নক্ষত্র। নক্ষত্র হচ্ছে আসলে উত্তপ্ত গ্যাসভর্তি দানবীয় আকারের বলের মতো। এই গ্যাসই হচ্ছে নক্ষত্রের জ্বালানি, যা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বেশির ভাগ নক্ষত্রের মধ্যে আরামসে কয়েক বিলিয়ন বছর তাপ আর আলো তৈরি করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ জ্বালানি থাকে।
সূর্য থেকে আলো বেরিয়ে আসে এবং তা মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছাতে আট মিনিটের একটু বেশি সময় লাগে। তার মানে, এই মুহূর্তে তুমি যে আলো দেখতে পাচ্ছ, তা আসলে সূর্য থেকে আট মিনিট আগে বেরিয়ে গেছে।
পৃথিবী থেকে সূর্য দেখতে স্থির আর শান্ত বলে মনে হয়। কিন্তু শক্তিশালী দুরবিন দিয়ে দেখলে দেখা যায়, সূর্যের ওপরের উত্তপ্ত স্তরে ঝড়ের মতো অগ্নিময় কী তোলপাড় চলছে। সূর্যে একধরনের ঝড়কে বলে সানস্পট বা সৌরকলঙ্ক, যা দেখতে গাঢ় ফোড়া বা ফুসকুড়ির মতো। সৌরকলঙ্কের সংখ্যা ১১ বছরের একটি চক্র অনুসরণ করে। সূর্যের পৃষ্ঠতলে গ্যাস আর জ্বালানির বিস্ফোরণ হলে সৌরশিখা (solar flare) তৈরি হয়। যখন সূর্য থেকে শক্তি ফিনকি দিয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে, সেটি কখনো কখনো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলেও চলে আসতে পারে। এর প্রভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গ্যাস সবুজ, নীল, লাল, এমনকি গোলাপি রঙে জ্বলে উঠতে পারে। এ ঘটনাকে বলে অরোরা বা মেরুজ্যোতি।
আমাদের সৌরজগৎ
সূর্য থেকে আসা শক্তি পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে। পাশাপাশি সৌরজগতের অন্য সব গ্রহকেও উত্তপ্ত করে। গ্রহ হচ্ছে বেশ বড় এক বস্তু, যা কিনা নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘোরে। আমাদের নক্ষত্র সূর্যকে ঘিরে মোট আটটি গ্রহ প্রদক্ষিণ করছে। এদের মধ্যে চারটির আকার ছোট আর তাদের ওপরের স্তর পাথুরে। এই চারটি গ্রহকে বলে আন্তগ্রহ। বাকি চারটি গ্রহ দানবাকৃতির আর গ্যাসীয়। এদের বলা হয় বহিগ্রহ।
সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহ বৃহস্পতি। অন্যদের তুলনায় এ গ্রহটির সবচেয়ে বেশি বলয় ও উপগ্রহ রয়েছে। গ্রহটির প্রায় অধিকাংশই চলমান গ্যাসে তৈরি। গ্রহটি শক্তিশালী ঝড়ে সব সময় তোলপাড় চলছে। আর এ ঝড়ের চারদিকে বিভিন্ন রঙের মেঘ পাক খাচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। গ্রহটির গ্রেট রেড স্পটেই এ সৌরজগতের সবচেয়ে বড় ঝড়টির অবস্থান। এর দুই মেরুতেও অরোরা চকমক করতে দেখা যায়।
নক্ষত্রের আলো নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা
নভোযান থেকে সূর্যসহ পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলো বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। আবার পৃথিবী থেকে আগে আমি যত নক্ষত্র বা তারা দেখেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি তারা দেখলাম মহাকাশ থেকে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাকাশে তারা মিটমিট করে না। সেগুলো একটা স্থির আলোর মতো দেখায়। নভোযান থেকে আমি বিভিন্ন রঙের নক্ষত্র দেখতে পেলাম। এর মধ্যে কোনোটি সাদা, কোনোটি নীল, কোনোটি লাল। এমনকি আমাদের সূর্যের মতো হলুদ তারা দেখেছিলাম। একটি নক্ষত্রের রং দেখে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায়। যেমন রং দেখে বোঝা যায় নক্ষত্রটির উত্তাপ কেমন। তুলনামূলক ঠান্ডা নক্ষত্রের রং লাল। আর উত্তপ্ত নক্ষত্রের রং হলুদ। আর সবচেয়ে উত্তপ্ত নক্ষত্রের রং নীল হয়। মহাকাশে অনেক আগেই একটি দুরবিন স্থাপন করেছে নাসা। সে কারণে মহাকাশ থেকে নক্ষত্রগুলো অনেক পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। নাসার স্থাপিত এই হাবল টেলিস্কোপই সম্ভবত সবচেয়ে ভালো দুরবিন। এটি ২০ বছরেরও আগে স্থাপন করা হয়েছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ বা দুরবিনের চেয়েও অনেক শক্তিশালী এটি। এসব দুরবিনের চেয়ে হাবল মহাকাশের অন্তত ৫০ গুণ অস্পষ্ট বস্তু পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়।
নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু
হাবলের তোলা কিছু চমকপ্রদ ছবিতে নেবুলা দেখা যায়। নেবুলা হচ্ছে মহাকাশে গ্যাস আর ধুলার মেঘ। নেবুলার রংটাও দারুণ। কিছু নেবুলা আসলে নক্ষত্রের জন্মস্থান। এদের মধ্যে ক্যারিনা নেবুলা সবচেয়ে পরিচিত নক্ষত্র জন্মস্থান। পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু থেকেই কেবল নেবুলা দেখা যায়।
নেবুলার মধ্যে নক্ষত্র জন্ম নেয়। এ প্রক্রিয়ার শুরুতে কিছু গ্যাস আর ধুলা একত্র হয়। অভিকর্ষশক্তির প্রভাবে আরও গ্যাস আর ধুলা তাতে যুক্ত হয়ে গোল আকার ধারণ করে। এই গোলক ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। পাশাপাশি গোলকের অভিকর্ষণশক্তিও বাড়তে থাকে, যার ফলে তা একসময় ভেঙে পড়ে। আর ভেঙে পড়ার ফলে এর ভেতরের গ্যাস ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে। এই উত্তাপ যদি কখনো ১০০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়, তাহলেই একটি নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। অবশ্য যত সহজে বলছি, বিষয়টি আসলে তত দ্রুত ঘটে না। একটি নতুন নক্ষত্রের মিটমিট করে আলো ছড়ানোর জন্য কয়েক লাখ বছরও লেগে যেতে পারে।
বেশির ভাগ নক্ষত্রের আয়ু কয়েক লাখ থেকে কয়েক কোটি বছর। তবে নক্ষত্রটি কত দিন বাঁচবে, সেটি নির্ভর করে তাদের আকারের ওপর। যেসব নক্ষত্রের আকার বড় এবং যারা বেশি উত্তপ্ত, তাদের আয়ু কম। তারা মাত্র কয়েক লাখ বছর বেঁচে থাকতে পারে। অন্যদিকে, ছোট আকারের নক্ষত্রগুলো বেশি দিন বাঁচে। কারণ তারা তাদের ভেতরের জ্বালানিগুলো ধীরে ধীরে খরচ করে। আমাদের সূর্য এরই মধ্যে তার জীবনের অর্ধেক কাটিয়ে ফেলেছে। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ, এভাবে সূর্য আরও ৫০ লাখ বছর দিব্যি বেঁচে থাকতে পারবে। আবার একটি নক্ষত্র কীভাবে মারা যাবে, সেটিও নির্ভর করে তার আকারের ওপর। আমাদের সূর্যের মতো আকারের নক্ষত্রগুলো মারা যাওয়ার সময় এদের বাইরের পৃষ্ঠের গ্যাসের কারণে স্ফীত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হতে থাকে। এরপর ক্রমান্বয়ে সেটি কালো বামনে পরিণত হয়। বলে রাখা ভালো, মহাকাশে ভাসমান জমাটবাঁধা গোলাকার বস্তুকে বলে কালো বামন। এদিকে বড় আকারের নক্ষত্রগুলোর জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে তারা নিজেদের মধ্যেই বিধ্বস্ত হয়। তাদের বাইরের স্তর বিস্ফোরিত হয়ে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং মৃত নক্ষত্রটির চারদিকে একটি নেবুলা গঠিত হয়।
অগ্রগামী ছায়াপথ
কলাম্বিয়ায় থাকার সময় আমার প্রিয় কিছু কাজের মধ্যে একটি ছিল বিশাল আর ক্ষুদ্রাকৃতির ম্যাগেলানিক ক্লাউড দেখা। আসলে মিল্কিওয়েকে (মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা নামের ছায়াপথেই আমাদের সৌরজগৎ অবস্থিত) কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করা এক জোড়া ছোট গ্যালাক্সি বা ছায়াপথকে বলে ম্যাগেলানিক ক্লাউড। দুরবিন দিয়ে আমি এদের মিহি গুঁড়ায় ভরা একগাদা দাগের মতো দেখতে পেতাম। তবে দৃশ্যটা যত দ্রুত সম্ভব দেখে শেষ করতে হতো। কারণ, ততক্ষণে আরেকটি অপূর্ব সূর্যোদয় দেখার সময় হয়ে যেত। কলাম্বিয়ার জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো আর তাপ যখন আমার চোখেমুখে ছুঁয়ে যেত, তখন খুবই ভালো লাগত। রাতের আকাশে অদ্ভুত আর অসাধারণ সব দৃশ্য দেখার পরও সেই চিরচেনা সূর্যকে আরও একবার দেখার অনুভূতি ছিল অপূর্ব। অচিরেই মনের ভেতর নিজের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা জেগে উঠতে শুরু করল। নক্ষত্র, নেবুলা আর ছায়াপথ যতই অসাধারণ হোক না কেন, পৃথিবীর মতো এমন সুন্দর জায়গা আসলে একটিও নেই।