
মাস্টারদা সূর্যসেনের নাম তোমরা শুনেছ। অগ্নিদিনের একজন বীর হিসেবে কে না তাঁকে চেনে। প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশরা শাসন করেছিল আমাদের এই দেশটা। শুধু দেশটা বলি কেন, ভারত উপমহাদেশটারই মালিক বনে গিয়েছিল ওরা। প্রথমে যুক্তরাজ্যের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পরে স্বয়ং যুক্তরাজ্যের রানিই হয়ে ওঠেন এই উপমহাদেশের ভাগ্যবিধাতা। ১৭৫৭ সাল থেকে প্রায় ২০০ বছর ধরেই এরা আমাদের সম্পদ লুট করেছে এবং এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। সে এক বিভীষিকার যুগ ছিল ওই ঔপনিবেশিক সময়টা।
প্রথমে তো ভারতবর্ষের মানুষ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারে, এ রকম শোষণের মধ্যে থাকলে নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তাই গোপনে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে শহরে-গ্রামে। কীভাবে ইংরেজদের হাত থেকে ক্ষমতার লাগাম নিজেদের হাতে আনা যায়, তাই নিয়েই ভাবতে থাকেন এ দেশের অগ্রনায়কেরা। মাস্টারদা সূর্যসেন ছিলেন তাঁদেরই একজন। আমাদের চট্টগ্রামেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন মুক্তিকামী মানুষদের নিয়ে একটি দল।
চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মেছিলেন সূর্যকুমার সেন। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ। রাজমণি সেন ও শশীবালা সেনের চতুর্থ সন্তান তিনি। ডাকনাম কালু। বর্ণমালার হাতেখড়ি বাবার কাছে। এরপর নোয়াপাড়া দয়াময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নোয়াপাড়া মাইনর স্কুল, চট্টগ্রামের নন্দনকাননের ন্যাশনাল স্কুলে পড়াশোনা করেন।
এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে আইএতে ভর্তি হন। এখানেই যুক্ত হন বৈপ্লবিক সংগঠন ‘অনুশীলন’-এর সঙ্গে। আইএ পাস করে চলে যান পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে বিএ পড়তে। ১৯১৮ সালে বিএ পাস করে চট্টগ্রামে ফিরে এসে আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তিনি ‘ন্যাশনাল স্কুল’-এ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এ কারণেই তাঁকে মাস্টারদা নামে ডাকা হয়। বাংলাদেশে বিপ্লবীরা তখন অনুশীলন ও যুগান্তর এই দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। বহরমপুর থেকে ফিরে এসে সূর্যসেন যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে সংগঠনটিকে সক্রিয় করে তোলেন এবং বিবদমান দল দুটিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। ১৯১৯ সালের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে আয়োজিত সভায় সূর্যসেন তাঁর বক্তৃতায় ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা যোগ দেন সশস্ত্র বিদ্রোহে। তাঁর নেতৃত্বে পুলিশের অস্ত্রাগার দখলের পর অস্ত্র ও গুলি সংগৃহীত হয়। সূর্যসেন পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। তিনি দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন যে বিপ্লবী দল চট্টগ্রামে গিয়ে ইংরেজদের আক্রমণ করবে। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল সংঘটিত এ যুদ্ধে ১৪ জন বিপ্লবী শহীদ হন। সূর্যসেনকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে। সরকার ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শুরু করে। ১৯৩২ সালের জুন মাসে মাস্টারদা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তকে ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রাম কারাগার উড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এই ঘটনায় ১১ জন বিপ্লবী গ্রেপ্তার হন। ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান, তবে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
এ ঘটনার পরে মাস্টারদা পটিয়ার কাছে গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করেন। কিন্তু গ্রামবাসীদের একজন সূর্যসেনের লুকিয়ে থাকার তথ্য পুলিশকে জানিয়ে দেয়। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গোর্খা সৈন্যরা স্থানটি ঘিরে ফেলে। সূর্যসেন ধরা পড়েন। ১৯৩৩ সালে সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিশেষ আদালতে বিচার হয়। ১৪ আগস্ট সূর্যসেনের ফাঁসির রায় হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়াারি চট্টগ্রাম কারাগারে তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়।
মাস্টারদার ফাঁসি হয়, কিন্তু তাঁর আদর্শে দীক্ষিত হয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে সংগ্রামী জনতা।
বিস্তারিত পড়ো www.gunijan.org.bd ঠিকানায়।