মূল্যস্ফীতি কত খারাপ?

অলংকরণ: তুলি

গল্পটা এক কুখ্যাত আসামির। একদিন সে জেল থেকে পালাল। কিছুতেই পুলিশ ধরতে পারল না। পাঁচ বছর পর হঠাৎ সেই আসামি নিজেই জেলে হাজির। সবাই অবাক। জেলার জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার? তুমি ধরা দিলে যে?’

আসামি বলল, ‘ধন্যবাদ জানান মূল্যস্ফীতিকে। বাইরে সবকিছুর যে দাম, তার চেয়ে জেলে থাকা ভালো।’

এটা নিছকই গল্প। কিন্তু বাস্তবেও এর চেয়ে অনেক মজার আর ভয়াবহ ঘটনা আছে। এই যেমন সাম্প্রতিক সময়ে জিম্বাবুয়ের কথাই ধরা যাক। সেখানে কয়েক বছর আগেও সামান্য একটি রুটি কিনতে ব্যাগভর্তি অর্থ নিয়ে বাজারে যেতে হতো। এর কারণ সেই মূল্যস্ফীতি। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মূল্যস্ফীতির কারণে জার্মানিতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। জার্মান মুদ্রা মার্কের মান ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় শিশুরা মার্কের নোট নিয়ে খেলত। নোট নিয়ে দেয়ালও সাজাত অনেকে। কী ভয়াবহ, তাই না।

এ রকম আরও উদাহরণ আছে। সেগুলো জানার আগে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে জেনে নিলে ভালো হয়। তাত্ত্বিকভাবে দামস্তর অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাওয়াকেই বলে মূল্যস্ফীতি। অনেকে বলে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া মানেই মূল্যস্ফীতি। আসলে তা নয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের তুলনায় আরেক নির্দিষ্ট সময়ে সামগ্রিক দামস্তরের পরিবর্তনই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির মুদ্রা মার্ক নিয়ে খেলছে শিশুরা

প্রশ্ন হচ্ছে কেন মূল্যস্ফীতি হয়? এর দুটি তত্ত্ব রয়েছে। একটি হচ্ছে অর্থের পরিমাণ তত্ত্ব, অন্যটি বাড়তি চাহিদা তত্ত্ব। সহজ ভাষায়, বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়লে বিভিন্ন পণ্যের দামও বাড়ে। কারণ, তাতে পণ্য আগের মতোই থাকে, কিন্তু মানুষের হাতে টাকা যায় বেড়ে। এতে যে দাম বাড়ে তাকেই মূল্যস্ফীতি বলা যায়। বাড়তি চাহিদা তত্ত্বটি একটু অন্য রকম। যেমন ধরো, টাকা ও পণ্য আগের মতোই আছে। উৎপাদনও বাড়ল না। কিন্তু হয়তো মানুষ বেড়ে গেল, কিংবা যারা আছে তারা একটু বেশি কিনতে চাইল। এতে চাহিদাও বাড়ল। তাতেও পণ্যের দাম বাড়তে পারে।

আরও কিছু তত্ত্বকথা বলি। কারণ হিসেবেও মূল্যস্ফীতি দুই ধরনের হয়। যেমন: চাহিদা বাড়লে যে মূল্যস্ফীতি হয়, তাকে বলে চাহিদাজনিত বা ডিমান্ড পুল মূল্যস্ফীতি। অর্থাত্, পণ্যের সরবরাহ কম থাকলেও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে। আরেকটি হচ্ছে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত বা কস্ট পুশ মূল্যস্ফীতি। অনেক সময় যেসব উপকরণ দিয়ে পণ্য উৎপাদন করা হয়, সেসব উপকরণের দাম বাড়লে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এতে পণ্যের দাম বাড়ে এবং মূল্যস্ফীতি ঘটে।

জিম্বাবুয়েতে মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে বাজারে এভাবেই টাকা নিয়ে যেতেন ক্রেতারা

এবার মূল্যস্ফীতির চক্রটি নিয়ে বলি। ধরো, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো হলো। এতে মানুষ আগের চেয়ে বেশি পণ্য কিনতে চাইবে। কিন্তু চাইলেই তো হয় না, বাজারে পর্যাপ্ত পণ্যও থাকতে হয়। যদি চাহিদার তুলনায় জোগান না থাকে তাহলে কী হবে? এতে পণ্যের দাম বেড়ে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে। কারণ, আমরা জানি, চাহিদা বাড়লে উৎপাদকেরা পণ্যের দাম বাড়ায়। প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকেরা তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবি করে। অনেক সময়ে বেতন-ভাতা বাড়লে চাহিদা আরও বাড়ে। তাতে আবারও সৃষ্টি হয় মূল্যস্ফীতির। যেমন: সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়াচ্ছে আমাদের সরকার। অনেকের আশঙ্কা, এতে মূল্যস্ফীতি ঘটবে। কারণ, অনেক মানুষের হাতে আগের চেয়ে টাকা বেশি থাকবে।

এ মূল্যস্ফীতিকে আমরা বলি অর্থনীতির নীরব ঘাতক। আবার নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষকে বাড়তি ব্যয় করতে হয় বলে তাকে বাধ্যতামূলক করও বলে। হিসাবটা সহজ। আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা ব্যয় করতে হতো, মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশ হলে সেই পণ্য কিনতে হবে ১১০ টাকায়। কিন্তু ওই বাড়তি ১০ টাকা আয় না বাড়লে কী হবে? ১০ টাকার পণ্য কম কিনতে হবে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি ঘটলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে, ভোগও কমে যায়। খুব গরিব মানুষ তখন আগের চেয়ে কম চাল কেনে, কম খায়। মানে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি বাড়লে সবচেয়ে কষ্ট হয় গরিবদের।

যতই নিন্দা করি না কেন, এই মূল্যস্ফীতি একেবারে কমে যাওয়াও অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়। বলা যায়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি খারাপ, কিন্তু প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য কিছুটা মূল্যস্ফীতি থাকা ভালো। কারণ, বাজারে চাহিদা থাকায় উৎপাদন বাড়ে। উৎপাদকেরা উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহী হয়। চাহিদা থাকা মানেই তো বেশি বেশি বিক্রি।

মূল্যস্ফীতিকে আরও দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন মৃদু মূল্যস্ফীতি ও অতি মূল্যস্ফীতি। মৃদু অর্থাতৎ মূল্যস্ফীতি যখন আস্তে আস্তে বাড়ে, তখন মানুষও আস্তে আস্তে এর সঙ্গে মানিয়ে নেয়, আয় বাড়ায়, উৎপাদকেরা বিনিয়োগ করে। এতে দেশের উন্নতি হয়। কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লে এর সঙ্গে কেউই তাল মেলাতে পারে না। ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে। মানুষের জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়ে যায় এই লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাওয়াকেই বলে অতি মূল্যস্ফীতি।

বিশ্বে প্রথম অতি মূল্যস্ফীতি দেখা গিয়েছিল জার্মানিতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। ১৯২২ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে জার্মানির মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল ৩২২ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরির পরিস্থিতি ছিল আরও খারাপ। ১৯৪৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৪৬ সালের জুলাইয়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছিল ১৯০০০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিদিন বেড়েছে ১৯ শতাংশ হারে। কয়েক বছর আগেও জিম্বাবুয়েতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩৭০০ শতাংশ। আগেই বলেছি, সেখানে আক্ষরিক অর্থেই রুটি কিনতে ব্যাগভর্তি অর্থ নিয়ে বাজারে যেতে হয়েছে। সেদিন একজন এসে বলল, তার বাবা আগে পকেটে অল্প টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে ব্যাগভর্তি বাজার আনতেন। এখন তিনি ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে যান, আর পকেটভর্তি বাজার আনেন। জিম্বাবুয়ের অবস্থাও হয়েছিল এ রকম।

এর চেয়েও ভয়াবহ গল্প আছে। এক চোর বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে যাচ্ছিল, পথে পড়ল ডাকাত। ডাকাতেরা সব টাকা রাস্তায় ফেলে বস্তাটি নিয়ে পালাল। কারণ, বস্তার দামটাই বেশি। পুরোনো ছবি দেখলে মনে হয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে হয়তো এ রকমই ঘটেছিল। সে সময়ে শিশুরা মার্কের নোট নিয়ে খেলত, লোকজন নোট নিয়ে দেয়াল সাজাত। ঠেলাগাড়িতে করে অর্থ নিয়ে যাওয়ার সেই ছবি এখনো গুগলে খুঁজলেই পাওয়া যায়। আশার কথা, সেই অতি মূল্যস্ফীতির যুগ হয়তো আর ফিরে আসবে না; বরং কাম্য মূল্যস্ফীতির মধ্যেই আমরা থাকব।