খুব ছোটবেলায় একটা মজার বইয়ের সন্ধান পেয়েছিলাম আমি, ‘আনাড়ির কাণ্ডকারখানা’। ছোট ছোট কাহিনি নিয়ে একেকটা খণ্ড, আর তার সঙ্গে দারুণ সব হাতে আঁকা ছবি। রুশ দেশের এক ছোট্ট ছেলের অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে লেখা বইটি অনুবাদ করছিল কলকাতার রাদুগা প্রকাশনী। মানুষ বেলুনে চড়ে আকাশ ভ্রমণ করতে পারে, সেই বইয়ের ছবি দেখেই জানতে পারি প্রথম। ছোট্ট আমি রাস্তায় বেলুন দেখলেই চিন্তায় পড়ে যেতাম। আচ্ছা, অত বড় বেলুন কোথায় পাওয়া যায়? সত্যিই বেলুনে চড়া যায় নাকি?
যখন ক্লাস ফোরে পড়ি, প্রতি বুধবার সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে বিটিভিতে প্রচারিত হত ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’। ডাইনোসরের জগতে মানুষের ভ্রমণ। আর সেখানেই প্রথম দেখতে পাই সত্যিকারের বেলুন। গবেষক আর বিজ্ঞানীরা সত্যিকারের বেলুনে চড়ে আকাশ ভ্রমণ করছে, আর তাদের বেলুনের নিচে হেঁটে যাচ্ছে দৈত্যাকার সব ডাইনোসর! আমার ছোট্ট মনে ডাইনোসর আর বেলুনের প্রতি আগ্রহ তখন কেউ কারও চেয়ে কম নয়। এত বড় বেলুন তাহলে সত্যিই বানানো সম্ভব। যাক একটু স্বস্তি পেলাম ভেবে।
বেলুন নিয়ে আগ্রহ বিশ্বের হাজার হাজার মানুষের। এশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সব মহাদেশেই প্রতিবছর হট এয়ার বেলুন ফেস্টিভ্যাল হয় গ্রীষ্মকালে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জাপানে অনুষ্ঠিত সাগা ইন্টারন্যাশনাল বেলুন ফেস্টিভ্যাল। তুরস্কের ক্যাপাডোশিয়া (Cappadocia) শহরে বছরে ২৫০ দিন বেলুনে করে আকাশে ওড়া যায়। আর তাই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এটি অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থান। ফিলিপাইন, তাইওয়ান, ব্রিস্টল আর স্পেনের বেলুন উৎসবের কথা না বললেই নয়। প্রতিবছর এসব শহরে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয় উৎসবে যোগদান করতে।
এসব মানুষের মতো আমারও বেলুনে চড়ার প্রবল আগ্রহ। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম আমি। তবে বেলুনে চড়ার সেই আগ্রহে একটুও ভাটা পড়ল না। বই আর ইন্টারনেটে যখনই হট এয়ার বেলুনের ছবি দেখতাম, মনে হতো আমাকে একবার চড়তেই হবে এতে। নিজের বাকেট লিস্টে তাই বেলুনে চড়ার সিরিয়াল ছিল প্রথম পাঁচের মধ্যেই। নিউইয়র্ক থেকে যখন ভার্জিনিয়ায় পাড়ি জমালাম পিএইচডি করতে, তখনো জানতাম না আমার জন্য অপেক্ষা করছে সেই অকল্পনীয় সুযোগ। প্রতিবছর মেরিল্যান্ডের ক্যারোল কাউন্টিতে অনুষ্ঠিত হয় বেলুন উৎসব। শুধু উৎসব বললে ভুল হবে হয়তো, আসলে এ এক মহাসমারোহ। দুদিনের সেই উৎসবে কী নেই! কনসার্ট, মেলা আর বেলুনে চড়ে আকাশ দেখার সুবর্ণ সুযোগ যখন একসঙ্গে পাওয়া যায়, সেখানে মানুষের ভিড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার শহর ফেয়ারফ্যাক্স থেকে গাড়িতে মাত্র এক ঘণ্টার পথ ক্যারোল কাউন্টি। ফেসবুকে তাই ইভেন্টের লিংক দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি। নিজের গাড়ি নেই এখনো, তাই যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবু মন খারাপ করে ইভেন্টে ‘ইন্টারেস্টেড’ হিসেবে নাম লেখালাম।
কথায় আছে না, ‘যদি থাকে নসিবে, আপনা-আপনি আসিবে!’ ঠিক তা–ই হলো আমার সঙ্গে। পরিচিত এক বড় আপু সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার ইভেন্ট ইন্টারেস্ট দেখে ইনবক্সে বলল, তারাও যেতে ইচ্ছুক বেলুন উৎসবে। আমি চাইলে তাদের সঙ্গেই যেতে পারি। আমার খুশি তো আর ধরে না। অবশেষে ছোটবেলার সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে! আমি বেলুনে চড়ব শেষমেশ।
২৯ আগস্ট রোববার ঘণ্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে আমরা যখন উৎসবে পৌঁছালাম, তখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল ছুঁইছুঁই। তবে লোকে লোকারণ্য পুরো জায়গা। একদিকে খোলা মাঠে কনসার্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বিশাল বিশাল ফুড ট্রাকে নানান রকম খাবার দোকানে মানুষের ভিড় আর তার পাশেই মেলা। কী নেই সেই মেলায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, রকমারি হাতে বানানো পণ্যসামগ্রী, সুইস নাইফ থেকে শুরু করে বুড়ো দাদুর নিজ হাতে বোনা উলের সোয়েটার—সবই পাওয়া যাচ্ছে। সেই বিশাল মাঠের এক পাশেই উড়ছে বেলুন। মস্ত বড় সব বেলুন! চোখ ফেরানো যায় না এত রঙিন সেসব! আর বিশাল লাইনে মানুষ অপেক্ষা করছে বেলুনে চড়ার জন্য।
আমরা মেলা ঘুরে দেখলাম আর খাওয়াদাওয়া সেরে কনসার্ট শুনলাম প্রথমে। ছোট ছোট বাচ্চারা বল নিয়ে ছোটাছুটি করছে চারপাশে। তাদের মধ্যেই ফোক গানের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচছে ছেলে–বুড়ো সবাই। কী দারুণ পরিবেশ। সূর্যটাও উঁকিঝুঁকি মারছে মেঘের আড়ালে বারবার। হাসি–গানে বেশ কিছু সময় উপভোগ করলাম সবাই মিলে।
এরপরেই এল বেলুনে চড়ার পালা। চোখের সামনে এত বড় বড় বেলুন দেখেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। সত্যিই আমি বেলুনে চড়ব! লাইন ধরে এগিয়ে গেলাম একটু একটু করে। বেলুনে উঠার আগে ক্যাপ্টেন কিছু উপদেশ দিলেন আমাদের। আর তারপরেই উঠে পড়লাম আমরা ঝুড়িতে। সে এক অবিশ্বাস্য অনুভূতি! ওপরে উঠতে উঠতে একটু করে দুলছিল বেলুন। মাথার ওপরেই জ্বলছে দাউদাউ আগুন (বেলুনে গরম বাতাস দেওয়া হয় আগুন থেকেই) আর আমরা ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছি মাটি থেকে ওপরে। আরও ওপরে…আরও…আরও! নিচের মানুষগুলো ছোট হচ্ছে পিঁপড়ার মতো। ছবি তুললাম আমরা ওপর থেকে। অসাধারণ সুন্দর পরিবেশে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় আমার। অবাক হয়ে দেখলাম চারপাশ। সূর্য ডুবছে আর তার শেষ আলো এসে পড়ছে লেকের পানিতে। প্রকৃতি এত সুন্দর হয়!
নেমে এলাম যখন বেলুন থেকে, তখনো ঘোর কাটেনি আমার। তাই বেলুন থেকে নামতে গিয়ে ছোট্ট একটা হোঁচট খেলাম পায়ে। তবে তখন আর পায়ের ব্যথায় নজর দেওয়ার সময় নেই। শেষবারের মতো ঘুরে ঘুরে দেখলাম চারপাশ। ছবি তুললাম কয়েক শ। শেষমেশ রোল আইসক্রিম খেতে খেতে ফিরে এলাম আমরা। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে নিজের মনেই ভাবছিলাম, ‘দিস ইজ আ ডে আই শ্যাল নেভার ফরগেট!’
আমার বেলুনে চড়ার আজন্মসাধ পূরণ হলো অবশেষে।