রূপকথার রাজপুত্ররা

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে অন্যতম নাম দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। ইউরোপে যেমন হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন কিংবা গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকসাহিত্যকে শিশু-কিশোরদের হাতে তুলে দিয়েছেন, ঠিক সেই কাজটিই বাংলায় করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন।

তাঁর জন্ম ১৮৭৭ সালে, ঢাকার সাভারের উলাইল গ্রামে। তাঁর মায়ের নাম কুসুমময়ী ও বাবার নাম রমদারঞ্জন মিত্র মজুমদার। ১৯০২ সালে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর তাঁর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি টাঙ্গাইলে পিসির কাছে চলে যান। সেখানে কৃষিকাজে মনোযোগী হন। পাশাপাশি পিসির জমিদারি দেখাশোনারও দায়িত্ব নেন। সে সময়টাতেই বাংলার গ্রাম আর এর আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুখরোচক গল্প জানার সুযোগ হলো তাঁর। সেসব গল্প তিনি নিজের খাতায় লিখে রাখতেন। পরবর্তী সময়ে সংগৃহীত এই গল্পগুলো কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন। একসময় গল্পগুলো নিয়ে একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন তিনি। নাম দেন ঠাকুরমার ঝুলি। কিন্তু বইয়ের প্রকাশক খুঁজে পেলেন না দক্ষিণারঞ্জন মিত্র। বাধ্য হয়ে নিজের অর্থেই বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেন তিনি। কাকতালীয়ভাবে রূপকথা-লোকগীতি সংগ্রাহক দীনেশচন্দ্র সেনের নজরে আসে বইটার প্রুফ কপি। তিনিই ঠাকুরমার ঝুলি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। তাঁরই চেষ্টায় অবশেষে ১৯০৭ সালে কলকাতার ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হয় ঠাকুরমার ঝুলি। তাতে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয় অপূর্ব এক আলোড়ন। এ বইটির জনপ্রিয়তা দেখে পরে তিনি আরও রূপকথা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। সেগুলোর নাম ঠাকুরদাদার ঝুলি, ঠানদিদির থলে এবং দাদামাশয়ের থলে।

লেখালেখি ছাড়াও তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। নিজের বইয়ের ছবিগুলো তিনি সব সময় নিজেই আঁকতেন। বইয়ের প্রচ্ছদও করতেন তিনি নিজের হাতে। ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় মারা যান তিনি।

গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়

জ্যাকব গ্রিম আর উইলহেম গ্রিম ব্রাদার্স নামে পরিচিত। তবে জার্মান এই দুই ভাইয়ের সবচেয়ে বড় পরিচয় রূপকথার জাদুকর হিসেবে। তাদের সংগৃহীত রূপকথা সারা বিশ্বে সর্বাধিক সমাদৃত। এই দুই ভাই ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রাচীন বইপত্র, পাণ্ডুলিপিসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে রূপকথা সংগ্রহ করেছিলেন। কালক্রমে মায়েদের মুখে মুখে প্রচলিত গল্প ও লৌকিক উপাখ্যানগুলোও ঠাঁই পেয়েছে গ্রিম ভাইদের বইয়ে। তাঁদের সংগৃহীত বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে সিন্ডারেলা, ঘুমন্ত সুন্দরী, হ্যান্সেল ও গ্রেটেল ইত্যাদি। গ্রিম ভাইদের রূপকথা বাংলাসহ পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

যাহোক, জ্যাকব ১৭৮৫ সালে আর উইলহেম ১৭৮৬ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের বলা হয় মানিকজোড়। কারণ, তাঁরা দুজন সব সময় একসঙ্গে থাকতেন। শুধু স্কুলেই নয়, কলেজে একসঙ্গে আইন পড়েছেন তাঁরা। রূপকথা প্রকাশ ছাড়াও বিদেশি কবিতা অনুবাদ করেছেন এই দুই ভাই। এ ছাড়া জার্মান ভাষা ও ব্যাকরণের ওপর বইও লিখেছেন। একসময় দুই ভাই রাজনীতিতে আগ্রহী হন। তাঁরা উত্তর জার্মান রাজ্যের রাজার কিছু অসমনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। শাস্তি হিসেবে তাঁদের বার্লিনে নির্বাসিত করা হয়। উইলহেম মারা যান ১৮৫৯ সালে, এআর জ্যাকব মারা যান ১৮৬০ সালে।

অমর গল্পকথক ইশপ

কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্প শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তোমরাও নিশ্চয়ই অমর এই কথাশিল্পীর গল্প পড়েছ। কিন্তু তাঁর জীবনের গল্পটাই হয়তো কখনো শোনোনি। অবশ্য সত্যি বলতে কী, তাঁর জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানাও যায় না। বলা যায়, তাঁর জীবন অনেকটাই রহস্যের চাদরে ঢাকা। ঐতিহাসিকদের মতে, এ নামে নাকি কেউ ছিলই না। তাহলে? তবে অন্য অনেকের দাবি, ইশপ নামে এক বিখ্যাত গল্পকার সত্যি সত্যিই এই পৃথিবীতে ছিলেন। ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় ছয় শ বছর আগে তিনি গ্রিসে বাস করতেন।

প্রাচীন গ্রিসে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩০ সালে এক ক্রীতদাস পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। তবে তার জন্মস্থান নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কেউ বলে গ্রিসের ফ্রিজিয়াস, কেউ বলেন থ্রেস শহর কেউবা লিডিয়া শহর। সে যাহোক, ছোটবেলা থেকে তিনি বিকলাঙ্গ ছিলেন বলে জানা যায়। বয়সকালে গ্রিসের অ্যাথস নামের এক ধনী বণিকের দাস হয়েছিলেন ইশপ। দ্য বুক অব জেনথাস, দ্য ফিলোসপার ও হিজ স্যাভ ইশপ বই থেকে জানা যায়, মিসরের এক দেবী ইশপকে গল্প বলার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। গল্প শোনাতে শোনাতে তিনি ফ্রিজিয়াস থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন সামোসে পর্যন্ত। তাতে তাঁর নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেই তিনি বণিক অ্যাথসের ক্রীতদাস হন। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কথা শুনে আর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে প্রভু অ্যাথস তাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।

এদিকে লিভিয়ার রাজা ক্রুসাস লোকমুখে ইশপের কথা শুনে তাঁকে রাজসভায় আমন্ত্রণ জানান। রাজসভার বিশেষ পদেও বসান ইশপকে। সে সময় মজার আর বুদ্ধিদীপ্ত গল্পকথক হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়। রাজা ক্রুসাস একবার গ্রিসের ডেলফির মন্দিরে পাঠান বিশেষ এক কাজে। এ মন্দিরে সবাই যেত দৈববাণীর আশায়। ইশপ মন্দিরের দৈববাণী নিয়ে কিছু রসিকতা করায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কথিত আছে, উঁচু এক পাহাড় থেকে চোখ বেঁধে নিচে ফেলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কিন্তু তার আসলে মৃত্যু নেই। প্রায় আড়াই হাজার বছর পরও তিনি সারা বিশ্ববাসীর কাছে অমর হয়ে আছেন তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত আর নৈতিক গল্পগুলোর জন্য। গ্রিক দার্শনিক জিমট্রিয়াস তাঁর গল্পগুলো সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। সেই থেকে ইশপের গল্প সারা বিশ্বের অমূল্য সম্পদ।

হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন

কুৎসিত হাঁসের ছানা, রাজার নতুন জামা, ছোট্ট মৎস্যকুমারী, রাজকুমারী ও মটরদানা সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় রূপকথা হিসেবে পরিচিত। তোমরাও নিশ্চয়ই নানু-দাদুর কাছে এসব গল্প শুনেছ। এ গল্পগুলো লিখেছেন হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন।

১৮০৫ সালের ২ এপ্রিল ডেনমার্কের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মেছিলেন অ্যান্ডারসন। তাঁর বাবা মুচি ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতেন অ্যান্ডারসন। তাই সারা দিনের কাজের শেষে প্রতিদিন অ্যান্ডারসনের বাবা তাঁকে একটা হলেও গল্প শোনাতেন। একসময় নিজেই গল্প বানিয়ে পাপেট শো করতে শুরু করেন অ্যান্ডারসন। ১১ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। অসহায় অ্যান্ডারসন পড়াশোনা ছেড়ে কাজে নেমে পড়েন। ১৪ বছর বয়সে তিনি কোপেনহেগেন চলে যান থিয়েটারে কাজ করতে। সেখান থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। তিনি সব সময় গল্প লিখতেন শিশুদের কথা ভেবে। ছোটদের জন্য ৩৫০টিরও বেশি গল্প লিখেছেন। এসব গল্প খুব সহজেই সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে, নিয়ে যায় কল্পনার রঙিন এক রাজ্যে। শিক্ষণীয় কিছু উপদেশও তিনি গল্পে রাখতেন। ছোটদের এই প্রিয় লেখক ১৮৭৫ সালের ৪ আগস্ট মারা যান। প্রতিবছর তাঁর জন্মদিনের দিন সারা বিশ্বে পালন করা হয় ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন বুকস ডে হিসেবে।