
ব্রিটিশ লেখিকা রুথ রেন্ডেলকে অনেক চিঠিপত্র পাঠাতেন তাঁর ভক্তরা। প্রায় চিঠিতেই থাকত একটা সাধারণ প্রশ্ন, ‘আমি লেখক হতে চাই। আমাকে কী করতে হবে?’ জনপ্রিয় এই ক্রাইম ফিকশন লেখিকা রসিকতা করে একবার উত্তর দিলেন, ‘আমাকে চিঠি লেখা বন্ধ করে, খাতাপত্র নিয়ে লিখতে বসে যাও!’
সব লেখকই কমবেশি একবার হলেও এই প্রশ্নটি শুনেছেন। লেখক হতে হলে আসলে কী করতে হবে? আরেক ব্রিটিশ লেখক ব্রায়ান ক্লার্ক ১০টি পরামর্শ দিয়েছেন এ ব্যাপারে। তাঁর পরামর্শগুলো এ রকম—
১. লেখো।
২. আরও লেখো।
৩. আরও বেশি লেখো।
৪. তার চাইতেও বেশি লেখো।
৫. তখনো লেখো, যখন লিখতে ইচ্ছে করছে না।
৬. লেখো, যখন ইচ্ছে করছে।
৭. কিছু বলার থাকলে লেখো।
৮. লেখো, যখন লেখার কিছু নেই।
৯. প্রতিদিন লেখো।
১০. লিখতেই থাকো।
সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে গেলে না হয় ‘সোজা হও, আরামে দাঁড়াও’জাতীয় হাজার রকম নিয়ম মানতে হয়। কিন্তু লেখক হওয়ার জন্য এ রকম গত্বাঁধা নিয়ম নেই। নিয়ম মেনে আদৌ লেখক হওয়া যায় কি না, তাও বেশ তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। অঙ্কের সূত্র ঠিকঠাক জেনেবুঝে করলে ভালো গণিতবিদ হওয়া যায় বটে। কিন্তু লেখালেখিতে এমন কোনো সূত্র নেই। তবু ভক্তকুলের অনুরোধে অনেক লেখকই লেখালেখি নিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আমেরিকান লেখক স্টিফেন কিংকে চেনো তো? ওই যে দ্য শাইনিং, মাইজারি, ডক্টর স্লিপিং বইগুলোর লেখক। হরর, সায়েন্স ফিকশন ও ফ্যান্টাসি ধরনের বই লিখে জনপ্রিয়তা কুড়ানো এই লেখকও দিয়েছেন এমন কিছু পরামর্শ। চলো, কিং সাহেবের পরামর্শগুলো শুনি।
১. টিভি বন্ধ করো!
মীনা কার্টুনের মিঠুর কথা মনে আছে তো? ওই যে উড়ে উড়ে সবাইকে মানা করত, ‘যৌতুক বন্ধ করো’! এ রকম একটা পাখিকে ‘টিভি বন্ধ করো’মূলক কথা শিখিয়ে-পড়িয়ে নাও, যদি তোমার টিভি দেখার বেশি বাতিক থাকে। কারণ, স্টিফেন কিং লেখালেখির জন্য সবার আগে বাদ দিতে বলেছেন টিভি দেখাকে। ‘সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে বিষাক্ত’ বলে টেলিভিশনকে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। লেখালেখির জন্য কল্পনাশক্তি ভালো হওয়া জরুরি। বই পড়লে তুমি নিজের মতো কল্পনা করতে পারবে। অথচ টেলিভিশন তোমার কল্পনাকে করবে সীমাবদ্ধ। তাই কল্পনা করবে যতটুকু দেখানো হচ্ছে। আর কিংয়ের মতে, লেখালেখির মূল নিয়ম দুটি। অনেক পড়া আর অনেক লেখা।
২. অন্যের জন্য নয়, নিজের জন্য লেখো
‘আরে এইটা কোনো লেখা হলো? এমন লেখা কে না লিখতে পারে!’ তোমার লেখা পড়ে কেউ যদি এ রকম মন্তব্য করে, তখন গাল ফুলিয়ে বসে থেকো না। স্টিফেন কিং বলেছেন, তুমি আঁকো, লেখো, গাও যা-ই করো না কেন, কেউ না কেউ তোমাকে অবজ্ঞা করবেই। সব পাঠককে মুগ্ধ করতে পারবে বিষয়টা এমন নয়। তাই সমালোচনা শুনে থেমে যেয়ো না। ভালো লাগা থেকেই লেখো। লেখালেখির প্রাথমিক পর্যায় হলো, নিজের জন্য লেখা। অন্যকে মুগ্ধ করতে গিয়ে সময় নষ্ট করো না। ধরো, কিআতেই কোনো লেখা পাঠিয়েছ, সেটা ছাপা হয়নি। তখন আবার হতাশ হয়ে পড়ো না। সমালোচনা এবং ব্যর্থতা দুটোই গ্রহণ করতে হবে। লিখতে কঠিন মনে হলে লেখা বন্ধ করে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। লেখালেখির ক্ষেত্রে আশাবাদী হতে হবে।
৩. হয়ে যাও ভাবুক
অনুভূতি কি লিখে বোঝানো যায়? তোমার চিন্তাভাবনাগুলো ঠিক তোমার মতো করে অন্যকে বোঝাতে গেলে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখতে হবে। আর এটাই কঠিন কাজ। তাই একজন লেখককে কঠিন বিষয়টা সামলে লিখে যেতে হবে। কোনো একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখতে গিয়ে তুমিই যদি রহস্যের প্যাঁচে জড়িয়ে আর সমাধান না দিতে পারো, তবে সেখানেই থেমে যেয়ো না। আরও গভীরভাবে চিন্তা করো। স্টিফেন কিং মনে করেন, লেখকদের হতে হবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতো। একটা ফসিল খুঁজে পেতে হলে মাটিতে কতটা গভীর গর্ত খুঁড়তে হয় ভেবে দেখেছ? একটা গল্পের জন্যও এতটা চিন্তার সাগরে ডুব দেওয়া প্রয়োজন।
৪. একা একা লিখতে চাও? দরজা বন্ধ করে লেখো!
লিখতে বসে দশ মিনিট ফোন ব্যবহার করলে আবার দশ মিনিট ভিডিও গেমস খেললে, এমন করলে চলবে না। লেখার সময় মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এমন সব কাজ বাদ দিতে হবে। দরজা বন্ধ করে লিখবে, দেখবে মনের দরজা খুলে গেছে।
৫. নঠিক নঠিক ষাভা!
কিছু বুঝতে পারলে কি বললাম? বুঝলে না তো? এটাই। ‘কঠিন কঠিন ভাষা’ বাক্যটাকে উল্টো করে বলেছিলাম। অহেতুক ভারী-কঠিন শব্দ লেখাতে ব্যবহার করার দরকার নেই। লেখা যতটা সম্ভব সহজ ভাষায় হওয়া উচিত। তোমার কথা যদি কেউ বুঝতেই না পারে, তো লিখে কী লাভ?
৬. লেখক না ব্যাকরণবিদ
তুমি কি ব্যাকরণ লিখতে বসেছ, না গল্প? শব্দগুলোকে ব্যাকরণের স্যুট-টাই পরিয়ে একদম ফিটফাট তৈরি করে দিলেই সুন্দর লেখা হয়ে যায় না। পাঠক যেন গল্প পড়তে পড়তে ভুলেই যায় যে এটা গল্প! তাকে তোমার চিন্তার জগত্টাতে ঘুরিয়ে আনতে হবে। তাই ব্যাকরণে বেশি মনোযোগ না দিয়ে গল্প বলায় মন দিতে বলেছেন কিং। তা ছাড়া লম্বা প্যারাগ্রাফ না লেখাই ভালো।
৭. লেখবে তুমি, দেখবে পাঠক
লেখার ক্ষেত্রে বর্ণনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণনা লেখবে তুমি, তবে তার শেষ হবে পাঠকের কল্পনায়। ধরো, পাঁচ বছর বয়সী একটা লাল টুকটুকে ফ্রক পরা কোনো ছোট্ট মেয়ের বর্ণনা দিচ্ছ। এখন তোমার বর্ণনায় পাঠক নিজের মতো কল্পনা করে নেবে চরিত্রটি। আবার অতিরিক্ত বর্ণনা বিরক্ত করে পাঠকদের। ‘বোরিং’ ভেবে অর্ধেক পড়ে বই রেখে দেওয়ার স্বভাব হয়তো তোমার নিজেরও আছে। কাজেই, পারিপার্শ্বিক বর্ণনাও বুঝেশুনে লিখতে হবে। পাঠক গল্প পড়তে চায়, লেখক কতটা জ্ঞানী ও কতটা জানেন তা জানতে চায় না। তাই শুধু গল্পের প্লট ভালো হলেই চলবে না, কীভাবে বলছ তা-ও জানতে হবে।
৮. তোতাপাখি হওয়া চলবে না
‘আরে, তোমার লেখা একদম হুমায়ূন আহমেদের মতো!’ এমন মতামত শুনে মোটেও খুশি হবে না। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রিয় লেখকের লেখার প্রভাব আসতে পারে, তবে সেটা দ্রুত বদলাতে হবে। অন্য লেখকের লেখার ধরন আওড়ে গেলে নিজের আলাদা সত্তা তৈরি হবে না। তোমার লেখার ধরন অন্যদের চেয়ে আলাদা হতে হবে।
৯. মাদককে না বলি
লেখা আসছে না? সিগারেটে একটু টান দিয়ে দিলাম। তাহলেই গড়গড় করে লেখা আসবে। এগুলো একদম ভুলভাল ধারণা। অ্যালকোহল কল্পনাশক্তিকে বাড়ায় এ রকম মিথ প্রচলিত আছে। তবে বিষয়টাকে একদম উড়িয়ে দিয়েছেন স্টিফেন কিং। লেখালেখির সঙ্গে মাদকের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে এত সব নিয়ম যখন জানলেই, তখন একটা গল্প লিখে মিলিয়ে নাও, আসলেই লেখালেখি করতে এসব নিয়মের দরকার হয় কি না!
ফাহমিদা আলম
তথ্যসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার ও গুডরিডস