বিশেষ রচনা
শখের দুনিয়ায় স্বাগত
পৃথিবীতে আর কিছু পাওয়া যাক বা না যাক শখবিহীন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রত্যেকেরই এক বা একাধিক শখ রয়েছে। সেই সব শখের আদ্যোপান্ত নিয়ে আজকের লেখা।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো বিমানবন্দরে বসে আছি বিমানের অপেক্ষায়। যাচ্ছি মেক্সিকো। ইচ্ছা আছে ১৪ দিনের এই ভ্রমণে মেক্সিকো সিটি ঘুরে একদম ভাজা ভাজা করা আর যত ধরনের মেক্সিকান খাবার আছে সব খেয়ে শেষ করে ফেলার। মেক্সিকোর বাইরে এত দিন এত মেক্সিকান খাবার খেয়েছি! এবার মেক্সিকো গিয়ে খেয়ে দেখি, খাবার আরও সুস্বাদু হবে নিশ্চয়ই। ভাবতেই জিবে জল চলে আসছে। আর ইনকা ও মায়া সভ্যতার কথা তো সেই ছোটবেলা থেকেই বইয়ে পড়ে আসছি। মেক্সিকো এদের নানা নিদর্শনে ভরপুর। এবার নিজের চোখে দেখব সেসব। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, হাঁটছি বিশাল বিশাল সব পিরামিডের মাঝখান দিয়ে, ওই তো ওখানে একদল মায়ান কাকে ঘিরে যেন নাচছে, উপাসনা করছে সূর্য দেবতাকে...।
স্বপ্নে সাময়িক বিরতি ঘটাল বিমানবন্দরের মাইকের নাকি কণ্ঠের ঘোষণা—ফ্লাইট নম্বর এত, যান্ত্রিক কারণে বিমান এক ঘণ্টা দেরি করে ছাড়বে। আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত। পৃথিবীব্যাপী বিমানের ওঠা-নামার সময় পরিবর্তিত হওয়া একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তাই কী আর করা! সময় কাটানোর জন্য ফেসবুকে ঢুকেছি। হঠাৎই ইনবক্সে একটা মেসেজ ভেসে এল। নক করেছে ঢাকা থেকে ফয়সাল আকরাম।
: স্ট্যাটাস দিয়েছেন দেখলাম, আপনি প্লেনে করে মেক্সিকো যাচ্ছেন। ভাই, আমার জন্য কয়েকটা বমির ব্যাগ আনবেন!
: মানে? কিসের, বমির ব্যাগ?
: ওই যে প্লেনে দেখবেন সিটের সঙ্গে একটা ব্যাগ দেয়। শরীর খারাপ হলে যাতে প্লেনের মধ্যেই কেউ বমি না করে ফেলে সে জন্য। ওইটায় বমি করা যায়।
: হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। প্লেনে থাকে। দেখেছি। কখনো ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু এইটা আপনার কী দরকার?
আমি হতভম্ব।
: আমি বমির ব্যাগ জমাই। এটা আমার শখ।
: হাহাহা, বলেন কী! মজার জিনিস তো! তা এই রকম শখ কেন?
: আসলে আমি প্লেনের নানা ধরনের স্মারক জমাই। বমির ব্যাগে দেখবেন প্লেনের লোগো ছাপ মারা থাকে। তাই ওইটাও জমাই। আমার জন্য কয়েক ধরনের প্লেনের ব্যাগ আনবেন প্লিজ।
মনে মনে ভাবলাম মানুষের কত ধরনের শখই না থাকে। অন্যের চোখে সেটা হয়তোবা অদ্ভুত। কিন্তু শখই একমাত্র জিনিস, যা ভূত-অদ্ভুত মানে না। মানে না বয়স-কাল-ভৌগোলিক শাসন। তাই তো কেউ কয়েন জমায়, কেউ জমায় বার্বি ডল কিংবা কেউ জমায় বিভিন্ন প্রাণীর লেজের চুল। শখের জন্য আমরা দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বাঁধি কালো কাপড়, ঝুঁকি নিই মৃত্যুর। শখের কাজের জন্য আমাদের রয়েছে ক্লান্তিহীন অফুরান ভালোবাসা। কথায় আছে, শখের তোলা আশি টাকা। মানে শখের পেছনে খরচ করতেও কোনো হিসাব-নিকাশ করি না আমরা। তাই তো সত্যজিতের শঙ্কুর চরিত্ররা লাখ টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা জাহাজের রেপ্লিকা কেনে, কেউবা শখের বশে জ্যান্ত মানুষকে মূর্তি বানিয়ে সাজিয়ে রাখে আন্ডারগ্রাউন্ড সেলে।
দশ-বারো বছর আগের কথা। কক্সবাজার গিয়েছি বেড়াতে। সারা দিন সমুদ্রে লাফালাফি করে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরেছি মাত্র। পাশের কামরা থেকে হঠাৎ শুরু হলো চিৎকার। দরজা খুলে তাকাতেই দেখি তিন বিদেশি একটা রেডিও আর অ্যানটেনা নিয়ে ধুপধাপ করে দৌড়াল ছাদের দিকে। ভয় পেয়ে গেলাম। রিমোট কন্ট্রোল বোমা-টোমা দিয়ে হোটেল ভবন উড়িয়ে দিচ্ছে নাকি এরা! দ্রুত পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে দৌড়ে ছাদের সিঁড়ি ধরলাম। গিয়ে দেখি তারা গভীর মনোযোগে একটা রেডিওতে কান পেতে আছে। রেডিও থেকে আসছে বিজাতীয় ভাষার কথাবার্তা। একজন খাতায় খসখস করে কী যেন লিখছে। আমাকে দেখেই মুখে আঙুল দিয়ে বলল চুপ থাকতে। ১০ মিনিট পর তারা হাসিমুখে জানাল, পোল্যান্ডের এই তিনজনের দলটি গত ছয় মাস হয় বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে। এই প্রথম তারা এশিয়ার কোনো দেশ থেকে আফ্রিকার দেশ জিবুতির রেডিও রিসেপশন স্পষ্ট পেল। এই জন্য তারা উত্তেজিত। এটা নাকি একটা অভাবনীয় ব্যাপার। কথায় কথায় তারা জানাল বিভিন্ন দেশের রেডিও শোনাই তাদের শখ। রেডিও শুনে তারা তখনকার আবহাওয়া, রিসেপশন কোয়ালিটি ইত্যাদি খাতায় লিখে রাখে আর পরে পঠিয়ে দেয় রেডিও স্টেশনের ঠিকানায়। রেডিও স্টেশন তখন খুশি হয়ে তাদের পাঠায় নানা ধরনের উপহার আর কিউএসএল কার্ড (পোস্টকার্ডের মতো দেখতে)।
দেশ-বিদেশের রেডিও শোনার এই শখের নাম ডিএক্সিং (উীরহম)। তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে আমিও দারুণ উৎসাহী হয়ে উঠলাম। এরপর একটা ১২ ব্যান্ডের রেডিও কিনে বনে গেলাম ডিএক্সার। রেডিও নেদারল্যান্ডস আমাকে পাঠাল ডিএক্সিং গাইড ও রিসেপশন রিপোর্ট লেখার কৌশল। বাসার ছাদে লাগালাম বইপত্র ঘেঁটে নিজের তৈরি করা অ্যানটেনা। রাত জেগে শর্টওয়েভ রেডিওর নব ঘুরিয়ে বিভিন্ন দেশের বিজাতীয় ভাষার অনুষ্ঠান শুনি। সেসব আমাকে মুহূর্তে টেনে নিয়ে যায় লাতিন আমেরিকার কোনো এক মায়াময় দ্বীপের নাচের আসরে, নয় তো আমাজনের জঙ্গলে। সোয়াহেলি ভাষার অপূর্ব সংগীত আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেনে রাখে। কখনো গভীর রাতে আফ্রিকার কোনো এক ছোট দেশের রেডিওর সিগনেচার টিউন, সুরেলা কোনো পাখির ডাক—আমার বুকে হাহাকার তোলে। শর্টওয়েভের রেডিও শোনার এই যে আনন্দ, এ আনন্দ আমি জীবনে আর কোথাও, অন্য কিছুতে পাইনি।
২০০৭ সালের কোপা আমেরিকা ফুটবল চলার সময় আমার রেডিও নব ঘোরাঘুরিতে ধরা পড়ল এক পর্তুগিজ রেডিও স্টেশন। এক ফোঁটা ভাষা বুঝি না, কিন্তু এমন অদ্ভুত দ্রুতগতির ধারাভাষ্য যে, আমাকে ৯০ মিনিট চুম্বকের মতো ধরে রাখল মাঠে। একটু পর থেকেই যেন স্পষ্ট বুঝতে শুরু করলাম মাঠে কী হচ্ছে। সেটি ছিল কোপার তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলা—মেক্সিকো আর উরুগুয়ের মাঝে। আমার ডিএক্সিং খাতায় লিখে রেখেছিলাম সেদিনের খেলার কথা। ৩-১ গোলে জিতেছিল মেক্সিকো। মাঠের উত্তেজনা আমি যেন পুরোটাই পেয়েছিলাম হাতিরপুলে আমার ছয়তলা বাসার ছাদে বসে।
রেডিও শোনার সে নেশা আজও আমার কাটেনি। এখন পর্যন্ত নানা দেশের বিজাতীয় সব রেডিও স্টেশনে চিঠি পাঠিয়ে আমি সংগ্রহ করেছি প্রায় ৪০টির মতো কিউএসএল কার্ডসহ নানা মজার মজার উপহার। রীতিমতো এক মাস কঠিন পড়াশোনা করে লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে সংগ্রহ করেছি হ্যাম রেডিও লাইসেন্স। শিখেছি মোর্স কোডসহ বেশ কয়েকটি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। কলসাইন পেয়েছি সিয়েরা টোয়েন্টি ওয়ান সিয়েরা নভেম্বর (ঝ২১ঝঘ। এখানে এস২১ হলো বাংলাদেশের কোড আর এসএন হলো আমার নামের আদ্যাক্ষর)।
হ্যাম রেডিও চালানোর এই শখটি সারা বিশ্বেই বেশ জনপ্রিয়। শখের হ্যাম রেডিও অপারেটর ছিলেন মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, অভিনেতা মার্লোন ব্রান্ডো, অ্যাপল কম্পিউটারের সাবেক প্রধান নির্বাহী জন স্ক্যালিসহ পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত লোক। বিশ্বব্যাপী অন্য হ্যামদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা ছাড়াও কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যদি সব যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে তাহলে হ্যাম রেডিও দিয়ে যোগাযোগ করা যায় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে। কোনো ধরনের খরচ ছাড়াই। চাওয়া যায় সাহায্য। এর বাইরে হ্যাম রেডিও খুলে দেয় অজানা এক দুনিয়া। একটু অবসর পেলেই আমি গভীর রাতে ওয়্যারলেস সেট বা ল্যাপটপে নামানো হ্যাম সফটওয়্যারে নিজের কলসাইন দিয়ে লগইন করে কথা বলি পৃথিবীর অন্য প্রান্তের কারও সঙ্গে—অদ্ভুত সব বিষয় নিয়ে! আর ঠিক সেই সময়টায় আমিও যেন আমার চারপাশের এত জটিলতা থেকে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। অনেকটা সেই ছোটবেলায় পত্রমিতালি বন্ধুর কোনো চিঠি আসার সময় যেমন লাগত, সে রকম!
আর এই কারণেই আমাদের প্রতিটা মানুষের কোনো না কোনো একটা শখ থাকা খুব জরুরি। কারণ, শখ তোমাকে দেবে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচার সুযোগ, প্রাণশক্তি, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।
বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অপছন্দের কাজ করতে হয়। কারও হয়তোবা স্কুলে যেতে ভালো লাগে না, কারও হয়তোবা জীববিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগে না। আর পরীক্ষা দিতে তো ভালো লাগে না কারোই। কিন্তু এসবই আমাদের করতে হয় পারিপার্শ্বিক চাপে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদে। এসব করার সময় যখন তুমি খুব বোর হয়ে যাও, তখন করা উচিত এমন একটা কিছু, যা তুমি করতে ভালোবাসো কোনো ধরনের চাপ ছাড়াই। যেটায় তুমি নিমগ্ন হয়ে যেতে পারো, মনপ্রাণ ঢেলে দিতে পারো। সেটা যেকোনো ধরনের কাজই হতে পারে। ছবি আঁকা থেকে শুরু করে রান্না করা, সেলাই করা বা যেকোনো কিছু। ধরো, তুমি যদি গাছপালা ভালোবাসো তবে বাড়ির সামনে, বারান্দায় বা ছাদে বাগান শুরু করতে পারো। বীজ থেকে একটা গাছের জন্ম হওয়া, তার বড় হওয়া, ফুল দেওয়া, ফল দেওয়া, দেখা কতই না আনন্দের। অজানা কোনো এক রোগে যখন গাছ মৃত্যুশয্যায়, তখন সেই দুঃখে দুঃখী হয়ে ওঠো তুমি। গাছে গাছে যখন নীল ফুল ফোটে সে আনন্দের কি কোনো তুলনা হয়! ছোট্ট টবে নিজের হাতে লাগানো বেগুনগাছের বেগুনটা কি অন্য বেগুনের থেকে একটু বেশিই সুস্বাদু হয় না!
নিজের আনন্দ ছাড়াও শখের বশবর্তী হয়ে করা কাজ তোমার আশপাশের সবাইকে, দেশের মানুষকে গর্বিত করে তুলতে পারে। ধরো, তোমার শখ হলো ঘুড়ি ওড়ানো। তুমি দিনকে দিন ঘুড়ি ওড়ানোয় এমনই পারদর্শী হয়ে উঠলে যে একসময় আন্তর্জাতিক ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে গেলে। এতে সারা পৃথিবীতে তোমার নামের পাশাপাশি দেশের নামও উজ্জ্বল হলো। মুস্তাফিজের কথাই ধরো, সে ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসত, খেলাই ছিল তার শখ। এতে সে এমনই নিমগ্ন হয়ে গেল যে এখন সে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মহাতারকা।
শখ থেকে কি কিছু শেখা যায়? উত্তর হলো—হ্যাঁ। যে কুকুর-বিড়াল-মাছ পোষে, সে দায়িত্বশীল হয়, যে ডাকটিকিট জমায় সে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে শেখে, যে কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখে, পাখি দেখে বা ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করে সে হয়ে ওঠে ধৈর্যশীল। হাইকিং বা র্যাফটিং এর মতো যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারধর্মী শখ তোমাকে করে তুলবে সাহসী ও পরিশ্রমী। পোস্টকার্ড বা মুদ্রা সংগ্রহ শখের কল্যাণে তুমি ঘরে বসেই বন্ধুর তুলনায় অনেক বেশি জানতে পারবে দেশ-বিদেশ সম্পর্কে। যাদের শখ বই পড়া, তারা এই শখ থেকে কী কী শিখবে, সে কথা তো বলারই প্রয়োজন নেই। আমার পরিচিত একজন আছেন, যিনি তাঁর ১৫ বছর বয়স থেকে পত্রিকায় ছাপা হওয়া মৃত্যু সংবাদগুলো কেটে ফাইল করে রাখেন। এখন তাঁর লাইব্রেরি ঘরের একটা বড় অংশজুড়ে সেসবের ফাইল কাটিং। তিনি এত দিনের সংগ্রহ করা মৃত্যু সংবাদগুলো ডিজিটালাইজড করে ছকে ফেলে দেখিয়ে দিয়েছেন গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের কোন এলাকার রাস্তায় কোন ধরনের গাড়িতে কতজন নারী, কতজন পুরুষ, কতজন বাচ্চা মারা গেছে। তিনি একটা তথ্য দিলেন যেটা বেশ চমকপ্রদ। আগেকার দিনে রোড অ্যাকসিডেন্টে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি মারা যেতেন। কারণ কী? তখনকার বাসগুলোয় মহিলা সিট থাকত বাসের সামনের দিকে ড্রাইভারের পাশে। ফলে দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ সময়ই বাসের সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতো আর নারীরা বেশি মারা যেতেন। এই তথ্য-উপাত্তগুলো তুমি-আমি জানি না, কিন্তু উনি ঠিকই জানেন।
যেকোনো একটা বিষয়ে নিবিষ্ট থাকলে সে বিষয়ে তুমি অন্য সবার থেকে বেশি জানবে এটাই তো স্বাভাবিক। এমনকি একটা সময় পরে তুমি হয়ে উঠবে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। ভবিষ্যতে নিজেকে একজন সত্যিকারের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কে না দেখতে চায়।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, শখের সঙ্গে নিজের পেশাকে মিলিয়ে ফেলা ঠিক কি না। অবশ্যই ঠিক। সেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ, যে তার জীবনধারণের জন্য নিজের শখকে পেশায় পরিণত করতে পারে। মুস্তাফিজের কথা তো আগেই বলেছি। ক্রিকেট খেলে সে এখন টাকা পায় আবার নিজের শখও মেটায়। দুই বছর আগে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে এলোমেলোভাবে হাঁটছি। হঠাৎ চোখে পড়ল এক বিশাল দোকান। সাহস করে ঢুকে গেলাম। চারদিকে হাজার হাজার স্বচ্ছ কাচের বয়ামে সাজানো রয়েছে রংবেরঙের লাখ লাখ বোতাম। আমি তো দেখে মুগ্ধ। কথা হলো দোকানমালিকের সঙ্গে। ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর শখ ছিল নানা ধরনের বোতাম সংগ্রহ করা। একপর্যায়ে তাঁর সংগ্রহ এমন হলো যে বোতাম আর ঘরে রাখার জায়গা হয় না। তত দিনে বিভিন্ন দেশের বোতাম উৎপাদক কারখানার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছে। বোতামের উৎপাদন আর চাহিদা সম্পর্কেও ভালো ধারণা তার। পরে একটা দোকানই দিয়ে বসলেন বোতামের। এখন তিনি লিসবনের সবচেয়ে বড় খুচরা বোতাম বিক্রেতা। আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন ইংল্যান্ডের কোন রাজা তাঁর পোশাকে কোন বোতাম ব্যবহার করতেন, কোন বোতামটি হাতির দাঁত থেকে তৈরি। আমিও মুগ্ধ হয়ে বেশ কিছু বোতাম কিনে ফেললাম সে দোকান থেকে। ঢাকায় ফিরে এসে একদিন ফুটপাতে বসে চা খাচ্ছি। দেখি পাশেই একটা ছোট্ট সবুজ রঙের বোতাম পড়ে আছে। তুলে নিয়ে দেখলাম সেটায় ইংরেজিতে লেখা—পুলিশ। আমি টুক করে সেটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। আমি এখন এ রকম পাঁচ শতাধিক বোতামের সংগ্রাহক। জানি না কোনো একদিন হয়তোবা বোতামের দোকানও দিয়ে দিতে পারি।
শখ নিয়ে আরেকটি বিষয়ে হয়তোবা তোমরা ঝামেলায় পড়তে পারো—খেলতেও ভালো লাগে আবার কবুতর পুষতেও ভালো লাগে, আবার মৌমাছি পুষতেও সমান আগ্রহ আর বইপড়া ছাড়া তো তোমার চলেই না। একসঙ্গে কি এতগুলো শখ থাকা উচিত? কোনো সমস্যা নেই। যখন যেটা করতে তোমার ভালো লাগে তখন সেটাই করো। এ জন্যই তো এটা তোমার শখ, কোনো চাপ নেই।
আবার শখ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে, পুরোনো শখ মরে যেতে পারে, জন্মাতে পারে নতুন শখ । কোনোটাতেই কোনো সমস্যা নেই। যেমন একসময় আমার শখ ছিল পত্রিকায় ছাপা হওয়া নানা ধরনের বিজ্ঞাপন কাঁচি দিয়ে কেটে পুরোনো প্র্যাকটিক্যাল খাতায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা। সময়ের অভাবে সেই শখটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। জন্ম নিয়েছে নতুন শখ—বোতাম সংগ্রহ।
তবে শখ নির্বাচনে সব সময় একটু পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখা ভালো। ধরো, টিভিতে র্যাফটিং দেখে তোমারও এটার প্রতি আগ্রহ জন্মাল। এখন বাংলাদেশে র্যাফটিংয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। তাহলে? সেটা মনে মনে জমিয়ে রাখো। পরে কোনো একসময় সুযোগ পেলে মনের সুখে র্যাফটিং করো। আবার আকাশে প্লেনের ওড়াউড়ি দেখে তোমারও প্লেন চালানোর শখ জন্মাল। সেটা তো আর এখনই সম্ভব নয়, এর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে ধীরে ধীরে—টাকাপয়সা জমাতে হবে, প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তবেই না একদিন পাখির মতো ডানা মেলতে পারবে আকাশে। আবার ধরো তুমি থাকো শহরের ছোট্ট একটা বাসায়। সেখানে যদি খুবই চঞ্চল, দৌড়াদৌড়ি করতে পছন্দ করে এমন কুকুর পুষতে চাও, তাহলে কিন্তু বেশ সমস্যাই হবে। তাই নানা ধরনের শখ সম্পর্কে জেনে তোমার ভালো লাগার শখ বা শখগুলো বেছে নিতে পারো।
শখ কত রকমের আছে? সে তালিকা করতে গেলে সেটা কিন্তু বেশ লম্বাই হবে। তবে বিশেষ কিছু শখের কথা তোমাদের বলাই যেতে পারে।
কিছু শখ আছে যেগুলো তুমি ঘরে বসেই করতে পারো। যেমন অ্যামেচার রেডিও চালানো, অভিনয়, বিভিন্ন ধরনের বোর্ড গেমস খেলা, সেলাই-সুতো, ক্যালিগ্রাফি করা, মোমবাতি তৈরি, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, রান্না, রং করা, কসপ্লে, লেখালেখি, ক্রসওয়ার্ড পাজল মেলানো, ক্রিপ্টোগ্রাফি, নাচা, ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি তৈরি, এমব্রয়ডারি করা, ফুল সাজানো, বিদেশি ভাষা শেখা, কম্পিউটারে গেম খেলা, লেগো সাজানো, জাদু দেখানো, গান, অরিগ্যামি, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, জন্তু-জানোয়ার পোষা, ম্যাজিক, মাটি দিয়ে নানা কিছু বানানো, ধাঁধা মেলানো, ভাস্কর্য তৈরি, স্ট্যান্ড আপ কমেডি, টেবিল টেনিস খেলা, দাবা খেলা, কাঠ খোদাই করে নানা কিছু বানানো।
ঘরের বাইরে গিয়ে করতে হবে এমন কিছু শখ হলো ধনুর্বিদ্যা, বাস্কেটবল খেলা, মৌমাছি সংগ্রহ, পাখি দেখা, শরীরচর্চা, সাইকেল চালানো, ক্যাম্পিং, ড্রাইভিং, মাছ শিকার, গাছ লাগানো, ভূত খোঁজা, দেয়ালে ছবি আঁকা, হাইকিং, ঘুড়ি ওড়ানো, চিঠি জমানো, পাহাড়ে চড়া, ফটোগ্রাফি, রোলার স্কেটিং, স্যান্ড আর্ট, স্কাউটিং, স্কুবা ডাইভিং, স্কাই ডাইভিং, পাথর খোঁজা, সার্ফিং, সাঁতার কাটা, মার্শাল আর্ট, গাড়ি মেরামত শেখা।
এগুলো সবই তো গেল ‘অ্যাকটিভিটি’ ধরনের শখ। সংগ্রহ ধাচের কিছু শখের কথাও চলো জেনে নিই।
নানা ধরনের অ্যাকশন ফিগার সংগ্রহ, মোবাইল স্ক্র্যাচ কার্ড সংগ্রহ, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার হার্ড ড্রাইভ, ফ্লপি ডিস্ক, কলম, পেনসিল-ইরেজার, ছবি, বই, কার্ড, মুদ্রা, কমিক বই, ডাকটিকিট, মুভি, রেকর্ড, স্ট্যাম্প, ভিডিও গেমস, পুরোনো গাড়ি, গাড়ি বা জাহাজের রেপ্লিকা, ফুল, খনিজ পদার্থ, পোকামাকড়, পাথর, কাচের গ্লাস, দেশলাই, ব্লেড, মোজা, ঝিনুক সংগ্রহ ইত্যাদি।
এর বাইরে রয়েছে নানা ধরনের প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার শখ। যেমন ব্যাডমিন্টন, বিলিয়ার্ড, বোউলিং, বক্সিং, ব্রিজ, ডার্টস, বিতর্ক, ফেন্সিং, ফুটবল, হ্যান্ডবল, ক্রিকেট, ভলিবল, সুইমিং, টেনিস।
আরেক ধরনের শখ আছে পর্যবেক্ষণমূলক। যেমন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে নানা জিনিস দেখা, এয়ারক্রাফট স্পটিং, আকাশের তারা দেখা, বার্ডওয়াচিং, বাস স্পটিং, মানুষ দেখা, ভ্রমণ ইত্যাদি।
তবে এসবের মধ্যে পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় শখ হলো ডাকটিকিট সংগ্রহ, কয়েন সংগ্রহ, পত্রমিতালি, খেলাধুলা, বইপড়া, ছবি আঁকা, পাখি দেখা, ছবি তোলা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো ইত্যাদি। তোমার কারও যদি এই জনপ্রিয় শখগুলোর কোনোটি থাকে তাহলে তুমি একদমই একা নয়। কিন্তু তুমি যদি একটু অন্য রকম শখে ডুবে যাও সেটার মজাও আবার আলাদা, তুমি হবে ইউনিক।
এসবের বাইরেও নানা মানুষের নানা ধরনের শখের খবর তোমরা এরপরের পাতাগুলোয় পাবে। তবে সেসবে যাওয়ার আগে শুরুতে বমির ব্যাগ সংগ্রহের যে গল্পটা বলেছিলাম, সেটার শেষটা বলে নিই।
ফয়সালের অনুরোধে বিমান ভ্রমণ শেষে আমি আমার নিজের এবং আশপাশের বেশ কয়েকটা সিট থেকে বমির ব্যাগ নিয়ে হাঁটছি লাইন ধরে, বিমান থেকে বের হওয়ার জন্য। বিমানের গেটে এক বিমানবালা ‘এই বিমানে ভ্রমণ করার জন্য অনেক ধন্যবাদ’ বলে মাথা নাড়তেই আমার হাতে দেখতে পেল বমির ব্যাগগুলো। সেদিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বলল, ‘ঘটনা কী, এগুলো নিয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি কি অসুস্থ বোধ করছ?’ আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। কেন জানি বলে ফেললাম, ‘ইয়ে মানে আমি না, ঢাকায় আমার এক বন্ধুর বমি বমি লাগছে। তার জন্য নিয়ে নিচ্ছি।’
বিমানবালা কী বুঝল জানি না। আমি দ্রুত বিমান থেকে বের হয়ে টার্মিনালের দিকে হাঁটা ধরলাম। পাছে যদি আবার সেগুলো রেখে দেয়।
আর মনে মনে বললাম, ফয়সালসহ পৃথিবীর তাবৎ মানুষের শখ পূরণ হোক।