শব্দের অর্থ পরিবর্তন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
শব্দের অর্থ চিরকাল এক রকম বা একটাই থাকে না। শব্দ ও তার অর্থের সম্পর্ক চিরস্থায়ী নয়। বহু শব্দ তার মূল অর্থ পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন অর্থ নিয়ে দেখা দেয়। একটি ভাষার শব্দভান্ডারে জমা হওয়া বিদেশি শব্দও যে ঠিকঠাক থাকে, তা নয়। সেসব শব্দেরও পরিবর্তন ঘটে যায়। বদলায় তার অবয়বও। যেমন ইংরেজি জেনারেল বাংলায় হয়ে যায় জাঁদরেল। কিংবা গার্ড হয়ে যায় গারদ। ভাষার সঙ্গে সম্বন্ধ মানুষের মনের। মানুষের মনের বিচিত্র মতিগতির কারণে শব্দ তার মূল অর্থ ছেড়ে দিয়ে নতুন অর্থ ধারণ করে। অর্থাৎ শব্দ তার অর্থ বদলায়। তবে শুধু মানুষের মন নয়, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণেও শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটতে পারে। ‘অভিধানের গল্প’তে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের নানা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় এবং তা যে বাংলা শব্দভান্ডারের শব্দ, তা বলা বাহুল্যমাত্র।

সামান্য

সামান্য শব্দটা এককালে নিতান্তই যে সামান্য ছিল, তা কিন্তু নয়। অসামান্য ছিল, এমন কথাও অবশ্য বলা যাবে না। অতি সামান্য বলতে যৎসামান্য শব্দটারও ব্যবহার ছিল না। কালের গতিকে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের ফলে কোনো শব্দ জাতে ওঠে। কোনোটা আবার দুর্গতির মধ্যে পড়ে যায়। সামান্য শব্দটার বেলায় ঘটেছে সেই দুর্গতি। সামান্য বলতে আমরা এখন বুঝি সাধারণ, নগণ্য, অল্প, অত্যল্প, তুচ্ছ ইত্যাদি। এগুলোর কোনোটাই সামান্য শব্দের মূল অর্থ নয়। ছিলও না। তারপর কী যে হলো, বাঙালি সামান্য শব্দটাকে একেবারে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার শুরু করে দিল। বাঙালি সামান্য কারণে চটে ওঠে, উত্তেজিত হয়, খুশিও হয়। সামান্য ব্যাপারে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে তোলে। যত কিছুই হোক, সামান্য শব্দের মূল অর্থ এসবের ধারেকাছে নেই। সামান্য শব্দের মূল অর্থ হলো সমানতা, সমানভাব অর্থাৎ সমান সমান। সমান থেকে তৈরি হয়েছে সামান্য। দুটিই বিশেষণ।

পদ্ধতি

পদ্ধতি শব্দের বর্তমান অর্থ প্রণালি, রীতি, নিয়ম, নীতি ইত্যাদি। অনেককাল ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে পদ্ধতি শব্দটা বর্তমান অর্থ লাভ করেছে।

পদ্ধতি শব্দের বর্তমান অর্থ যেটাই হোক, শব্দটির মূল অর্থ হলো সরণি, সড়ক, পথ।

শব্দ তৈরি হয় ব্যাকরণের নিয়ম মেনে। পদ্ধতি শব্দের ব্যাকরণ বিশ্লেষণ করে যে অর্থ পাওয়া যায়, তা হলো পদ দ্বারা হননীয় অর্থাৎ কিনা পা দিয়ে আঘাত করার যোগ্য।

পদ্ধতি শব্দটার জন্মের সময় কংক্রিটের বা পিচঢালা পথ ছিল না। ছিল হেঁটে হেঁটে তৈরি করা পায়ে চলার পথ। সে পথে একজন, দুজন নয়, শত শত লোকের চলাচল হতো। পায়ের নিচে পড়ে ঘাস উঠে যেত অর্থাৎ মারা পড়ত। মারা যেত পোকামাকড়। পায়ে হেঁটে পথ চললে এগুলো অবশ্যই হননীয় অর্থাৎ হত্যার যোগ্য। নইলে নিরাপদ পথ তৈরি হবে কী করে? তখন তো মানুষের পায়ে জুতো-স্যান্ডেলও ছিল না। 

তৈরি হয়ে যাওয়া পায়ে চলার পথ ধরে মানুষ হেঁটে চলে সামনে এগোনোর জন্য, গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য। পথ তৈরি হয়ে গেলে সেই পথ ধরে চলাটাই মানুষের স্বভাব, মানুষের সাধারণ রীতি।

সম্ভবত এই পথ ধরেই ধীরে ধীরে পদ্ধতি শব্দের অর্থ বদলে গেল। পদ্ধতি হয়ে গেল রীতি, ধারা, প্রণালি ইত্যাদি। শব্দের অর্থের এ রকম বিবর্তন কোনো অবাক কাণ্ড নয়, নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কাবু

বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারে স্থান করে নেওয়া তুর্কি কাবু শব্দটির আচরণ বেশ রহস্যময়।

বাঙালি প্রচণ্ড শীত কিংবা প্রচণ্ড গরমে কাবু হয়। অনেকে অন্যকে কাবু করার চেষ্টা করে। বাংলায় কাবু হওয়ার অর্থ পরাস্ত হওয়া। আর, কাবু করার অর্থ পরাস্ত করা। কাউকে যদি কাবুতে পাওয়া যায়, তখন তার অর্থ দাঁড়ায় বাগে পাওয়া।

বাংলায় কাবু শব্দের প্রধান অর্থ বশীভূত, পরাস্ত ইত্যাদি। কিন্তু মূল তুর্কি ভাষায় কাবু শব্দের অর্থ হলো সুযোগ, সুবিধা। বাঙালি যখন কাউকে কাবু করতে চায় কিংবা কাবুতে পেতে চায়, তখন তাকে অপেক্ষা করতে হয় সুযোগের, সুবিধাজনক অবস্থার। বাঙালির এই মনস্তাত্বিক অবস্থার কারণেই সম্ভবত তুর্কি কাবু শব্দের অর্থের এই পরিবর্তন।

অনুবাদ

অনুবাদ এখন একটি পারিভাষিক শব্দ। এটি ইংরেজি Translation শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। পারিভাষিক শব্দের বৈশিষ্ট্য হলো, এই শব্দের কোনো বিকল্প অর্থ হয় না। অর্থ থাকে একটাই। তাই অনুবাদ শব্দটিকে ভাষান্তর বা তর্জমা অর্থেই ব্যবহার করতে হবে, ভিন্ন কোনো ভাব বোঝাতে নয়।

পারিভাষিক শব্দ হিসেবে অনুবাদ শব্দের ব্যবহার শুরু প্রায় দেড় শ বছর আগে। তার আগে অনুবাদ সাধারণ শব্দই ছিল। তখন ভাষান্তর বলতে তর্জমা শব্দটাই চালু ছিল। সংস্কৃতিপ্রেমী পণ্ডিতদের হাতে পড়ে চালু হয় অনুবাদ শব্দটি। অনুবাদ শব্দের পাশাপাশি তর্জমা বা তরজমা শব্দটি বহুদিন চালু ছিল। এখনো রয়েছে, তবে কম। তরজমা শব্দটি আরবি ভাষা থেকে আগত।

সাধারণ শব্দ হিসেবে অনুবাদ এখন অপ্রচলিত একটি শব্দ। এর ঠাঁই এখন অভিধানে, তা–ও আবার আধুনিক বা ব্যবহারিক অভিধানে নয়, বিশেষায়িত অভিধানে।

অনুবাদ পারিভাষিক শব্দে পরিণত হওয়ার আগে কী তার অর্থ ছিল, কোথায় কীভাবে তা ব্যবহৃত হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানে।

অনুবাদ তৎসম শব্দ। শব্দটির মূল অর্থ কথিত বিষয় পুনরায় বলা, পুনরুক্তি, সর্বক্ষণ কথা বলা, প্রশংসা করা, কিংবদন্তি, জনশ্রুতি ইত্যাদি।

মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে অনুবাদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে প্রতিকূলতা, নিন্দা, শত্রুতা অর্থে। এর উল্টোটাও হয়েছে, যেমন প্রশংসা বা স্তুতিবাদ অর্থেও অনুবাদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

অনুবাদ শব্দটি এখনো টিকে আছে বাদানুবাদ শব্দের মধ্যে। আলাদা করে চেনা মুশকিল। চেনার দরকারও পড়বে না। যা–ই হোক, বাদানুবাদ শব্দের অর্থ কথার উত্তর, প্রত্যুত্তর—যা প্রায় ঝগড়ারই শামিল।

ব্যাপার

ব্যাপার শব্দটির ব্যাপারস্যাপার বেশ রহস্যময়। শব্দটি তৎসম। অর্থও অনেক এবং নানা রকমের। যেমন ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান, ক্রিয়া, কাজ, সাহায্য, পেশা, বাণিজ্য, ব্যবসা, ব্যবসার লাভ ইত্যাদি।

বাংলা ভাষায় এসে শব্দটির মূল অর্থের প্রায় সবটাই ঝরে পড়েছে। টিকে আছে শুধু একটি জায়গায়—সেটি হলো ব্যাপারী। বাংলায় এখন ব্যাপার শব্দের অর্থ হলো বিষয়, ঘটনা, কাণ্ড ইত্যাদি।

ব্যাপার অর্থাৎ ব্যবসা যিনি করেন, তিনি হলেন ব্যাপারী। কথায় আছে, আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর। তো, ব্যাপারী শব্দটা এখনো প্রবলভাবে চালু আছে মফস্বলের হাটে–গঞ্জে। সেখানে আছেন গরু-ছাগলের ব্যাপারী, ভুসিমালের ব্যাপারী থেকে হরেক রকমের ব্যাপারী বা কারবারি। তৎসম শব্দ ব্যাপার থেকে হয়েছে ব্যাপারী। ব্যাপারী শব্দের আরেকটি অর্থ হলো কার্যাসক্ত, ইদানীং ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ওয়ার্কহলিক।