স্মৃতির পাতায় হুমায়ূন আহমেদ

ছোট দুই ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীবের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ
ছোট দুই ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আহসান হাবীবের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ

ছোটবেলায় আমাদের বাসায় প্রচুর বই আর পত্রপত্রিকা ছিল। সব বাবার নিজস্ব কালেকশন। বই তো পড়তামই, বাবার নির্দেশ ছিল পত্রিকাও পড়তে হবে। গুরুত্বপূর্ণ খবর থাকলে জানাতে হবে তাঁকে। সে কারণে আমরা ছোটরা মাঝেমধ্যেই গম্ভীর মুখে পত্রিকা নিয়ে বসতাম। একদিন একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পেলাম পত্রিকায়। সেই খবর পড়ে আমার হাত-পা যেন ঠান্ডা হয়ে গেল! খবরটা হচ্ছে খুব দ্রুতই নাকি পৃথিবীর অক্সিজেন ফুরিয়ে যাচ্ছে! তার মানে খুব শিগগির আমরা অক্সিজেনের অভাবে দম আটকে মারা পড়ব। সত্যি কথা বলতে কি, তখনই কেমন যেন অক্সিজেনের অভাবে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হতে শুরু করল বলে মনে হলো। বাবা ট্যুরে ছিলেন বলে এই খবর মাকে জানালাম। মা রান্নাঘরে রান্না করছিলেন। এই রকম একটা ভয়ানক খবর শুনেও তার মধ্যে কোনো উত্তেজনা দেখতে পেলাম না, মুখে ‘হুম’-জাতীয় একটা শব্দ করে রান্নাই করতে থাকলেন। বড় ভাইবোনদের জানালাম। তারাও বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখাল না। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকায়, ঢাকা কলেজে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। তাকেই শুধু জানাতে পারলাম না।

বরং কদিন পর আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা শুরু হয়ে গেল, ‘শাহীন তো (আমার ডাকনাম) অক্সিজেনের অভাবে খুব শিগগির মারা যাচ্ছে...!’ ওদিকে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুভয়ে আমার ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার অবস্থা! শেষমেশ দাদাভাইকে (বড় ভাইকে আমরা সবাই দাদাভাই বলে ডাকি) ঢাকায় চিঠি দিলাম এই গুরুতর সমস্যার কথা জানিয়ে।

খুব শিগগির তার চিঠি এসে হাজির হলো। না, সে আমার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে, অন্যদের মতো ঠাট্টা-তামাশা করেনি। সে ছবি এঁকে বিভিন্ন পয়েন্টস দিয়ে বুঝিয়েছে যে পৃথিবীর অক্সিজেনের উত্স অফুরন্ত, এটা কখনোই শেষ হবার নয়। আমার জানে যেন পানি ফিরে এল। অক্সিজেনের অভাবে যে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল, তা-ও যেন মুহূর্তে দূর হয়ে গেল।

আসলে বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমার সব সময় চিঠি লেখালেখি চলত। এর কারণ হচ্ছেন আমার মা, তাঁর কড়া নির্দেশ ছিল, সবাই বাচ্চুকে চিঠি লিখবি, ছেলেটা একা একা ঢাকায় আছে (বাচ্চু হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের আরেকটা ডাকনাম, যেটা মা ডাকতেন। আর বাবা ডাকতেন কাজল বলে)। তো, বাসার অন্য সবাই চিঠি না লিখলেও আমি আর মা নিয়মিতই লিখতাম। আমার চিঠিতে তাকে নানা রকম খবর দিতাম। যেমন যেবার আমাদের বাসায় একটা বাছুরসহ গরু কেনা হলো, তখন সেই গরু ও বাছুরের বর্ণনা দিয়ে সচিত্র চিঠি লিখলাম কিংবা গ্রাম থেকে বেড়াতে আসা ছোট চাচা এরশাদ কাকু (আমরা বলি কাক্কু) আমাদের বাসার পাশের পুকুর থেকে বড়শি দিয়ে বিশাল এক শোল মাছ ধরে ফেলল। সেই শোল মাছের বর্ণনা, এটাও সচিত্র। সব চিঠিরই সে জবাব দিত এবং আশ্চর্য হচ্ছে সে-ও আমাকে সচিত্র চিঠি দিত। সে যে ভালো ছবি আঁকত, সেটা তখনই টের পেয়েছিলাম।

একদিন বাইপোস্টে আমার নামে একটা বেশ বড়সড় চিঠি এসে হাজির। খুলে দেখি চিঠি নয়, একটা বই। বইয়ের নাম বাবা যখন ছোট, অসাধারণ একটা রাশিয়ান বই। বইয়ের প্রথম পাতায় লেখা, ‘দাঁভাস-এর জন্মদিনে—দাদাভাই’। বলা বাহুল্য, সে আমাকে মাঝেমধ্যেই অদ্ভুত সব নামে  ডাকত, যেমন ‘দাঁভাস’। দাঁভাস নামে ডাকার কারণটা এখন আর মনে নেই। তবে কিছু সময় সে আমাকে ‘কাঁকড়া-বিছা’ নামে ডেকেছে, সেটার কারণটা এখনো মনে আছে। তখন চোস্ত পায়জামা ছেলেদের ফ্যাশন হিসেবে বেশ চলছে। আমি ঈদের সময় বায়না ধরলাম আম্মার কাছে, আমাকে চোস্ত পায়জামা বানিয়ে দিতে হবে। চোস্ত পায়জামা হচ্ছে স্কিনটাইট পায়জামা, কোমরের কাছে আবার বিরাট ঢিলা। মা ঈদে আমাকে চোস্ত পায়জামা আর পাঞ্জাবি বানিয়ে দিলেন। সেই পায়জামা পরে যখন ঈদের দিন বের হলাম, তখন দাদাভাই বলল, আমাকে দেখতে নাকি ‘কাঁকড়া-বিছার’ মতো লাগছে। স্কিনটাইট পায়জামার কারণে পা দুটি নাকি দেখাচ্ছে কাঁকড়া-বিছার দুই দাড়ের মতো। ব্যস, আমার নাম হয়ে গেল ‘কাঁকড়া-বিছা’। এই নামে আমাকে বেশ কিছুদিন কাটাতে হয়েছে তার কাছে।

হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

যাহোক, আবার বইয়ের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমি তো হতবাক! বাইপোস্টে যে বই উপহার পাওয়া যায়, এটাই আমার মাথায় আসছিল না। আর আমাদের সময় আমাদের কারও জন্মদিন-টন্মদিন হতো না। সেই আমার জন্মদিনে পাওয়া প্রথম উপহার। তা-ও আবার চমত্কার একটি বই। এই ফাঁকে আরেকটা গল্প বলে ফেলি। বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা ছিলেন বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন। মাঝেমধ্যে থাকতেনও। একদিন তিনি আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে একটা ঘড়ি দিলেন। সবুজ ডায়ালের ঘড়ি। আমি অবাক! তিনি বললেন, ‘নে, তোর জন্য একটা ঘড়ি!’ আমার জীবনে পাওয়া প্রথম ঘড়ি। ওই ঘড়ি হাতে পরে যেন হঠাত্ বড় হয়ে গেলাম। (তখন স্কুলে এইট কি নাইনে পড়ি)। কিন্তু কী আশ্চর্য! কদিন পর ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর যখন ছফা ভাই আবার এলেন, আমি তাঁকে জানালাম, ঘড়ি বন্ধ। তিনি আবার আমাকে আড়ালে নিয়ে ৫০ টাকা দিলেন। বললেন দোকানে নিয়ে ঠিক করে ফেলতে। ৫০ টাকা পেয়ে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। তখন ৫০ টাকা অনেক! কে ঘড়ি ঠিক করে, ওই টাকায় নাজ সিনেমা হলে (তখন গুলিস্তান হলের পাশে ‘নাজ’ নামে খুব সুন্দর ছোট্ট একটা সিনেমা হল ছিল) গিয়ে ওয়েস্টার্ন সিনেমা দেখি বন্ধুদের সঙ্গে, এটা-সেটা খাই কিন্তু ঘড়ি আর ঠিক করি না। ঘড়ি তো হাতেই আছে, সমস্যা কী? ঘড়ি নষ্ট না ঠিক, কে দেখতে যাচ্ছে। ছফা ভাই একদিন ধরলেন, ‘কিরে, ঘড়ি ঠিক করেছিস?’ আমি মাথা ঝাঁকাই। দেখাই তাকে। ওই সবুজ ডায়ালের ঘড়িটার সেকেন্ডের কাঁটা ছিল না বলে বোঝার উপায় নেই ঘড়ি বন্ধ, না সচল। তবে তখনই জেনেছিলাম, একটা নষ্ট ঘড়িও দিনে দুবার অন্তত সঠিক সময় দেয় (পরে অবশ্য ঘড়িটা ঠিক করেছিলাম)।

বই আর ঘড়ি—এই দুটি উপহার ছিল আমার সারা জীবনের দুটি সেরা উপহার।

ভাইবোনদের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ, সবাইকে তাঁকে ডাকতেন ’দাদাভাই’ বলে। ছবি: সংগৃহীত
ভাইবোনদের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ, সবাইকে তাঁকে ডাকতেন ’দাদাভাই’ বলে। ছবি: সংগৃহীত

দাদাভাইকে নিয়ে আমাদের ভাইবোনদের কত না মজার স্মৃতি। ছোটবেলায় সে যে সাহিত্যিক হয়ে উঠবে, সে রকম কোনো আলামত কিন্তু আমরা পাচ্ছিলাম না। বরং তার এক বন্ধু ছিল মঞ্জু ভাই, সে ছিল সেই সময় সিয়িয়াস লেখক। সে গল্প-উপন্যাস-কবিতা দুহাতে লিখত, কোথাও ছাপা হওয়ামাত্র সেগুলো পড়ে শোনাত আমার মাকে। কিন্তু দাদাভাইয়ের কোনো আগ্রহ ছিল না এসব লেখালেখিতে। বরং একদিন তার ছবি আঁকার প্রতিভা আমরা টের পেলাম। সেটা এ রকম—হঠাত্ করে আমরা ভাইবোনেরা আবিষ্কার করলাম, সে স্কুল থেকে ফিরে এসে বাসার ছাদে উঠে যায়। ওই ছাদে ওঠা আবার খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার, সে-ই শুধু পারে, আর কেউ ওই ছাদে উঠতে পারে না। বেশ কদিন তার ছাদে ওঠা আমরা লক্ষ করলাম। একদিন সে ছাদ থেকে নেমে এল একটা সাদা কাগজ নিয়ে, দেখি সেখানে তার আঁকা একটা পোর্ট্রেট। নিজেই নিজেকে এঁকেছে, অসাধারণ একটা পেনসিল স্কেচ।

—এটা তোমার আঁকা? আমরা ছোট ভাইবোনেরা সব হতভম্ব!

সে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ে। ব্যস, এবার তার দেখাদেখি আমরাও যার যার চিত্রপ্রতিভা স্ফুরণে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কিন্তু আমাদের স্বেচগুলো আর কিছুতেই তার মতো সুন্দর হয় না। আমাদের আঁকাআঁকি দেখে বাবা ঘোষণা দিলেন, বাসায় ছবি প্রদর্শনী হবে। সত্যি, কত-না মজার স্মৃতি আমাদের! ঘরের দেয়ালে আঠা দিয়ে টানানো ইনহাউস চিত্র প্রদর্শনীর পর অচিরেই সে রং-তুলো নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করল (তুলি না কিন্তু, তুলো)। তুলি ছাড়াই সে তুলো ভিজিয়ে তাতে রং লাগিয়ে টেনে টেনে এক অদ্ভুত কায়দায় ছবি আঁকত। সব ছবি আবার সূর্যাস্তের ছবি। কিছুদিনের মধ্যে বাসা ছেয়ে গেল শত শত সূর্যাস্তের ছবিতে। সেই ছবিগুলোও কিন্তু মুগ্ধ হওয়ার মতো ছবিই ছিল। সূর্য ডুবছে, লাল হলুদ কমলা আকাশ, সামনে দিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি, মানুষ, ঘরবাড়ি। গাছপালাও দেখা যাচ্ছে, তবে সবই সিলিয়ুয়েট টাইপ ড্রয়িং। তবে শেষের দিকে সে সাহায্যকারী হিসেবে মেজ ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হায়ার করল। ভাইয়া সূর্যাস্তের সামনের সিলিয়ুয়েট ড্রয়িংগুলো করত (মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আমরা ভাইয়া ডাকি)। ভাইয়াও সুন্দর ছবি আঁকত। এখনো আঁকে। তবে এই সূর্যাস্ত ড্রয়িং সিনড্রম শেষ পর্যন্ত বন্ধ হলো একটা বিশেষ কারণে। কে যেন সন্দেহ প্রকাশ করল, এই ছবি সূর্যাস্ত, না সূর্যোদয়ের? তৈলধার পাত্র, না পাত্রধার তৈল অবস্থা আরকি! সূর্যাস্ত, না সূর্যোদয়?  সূর্যোদয়, না সূর্যাস্ত? এই বিতর্কের কারণে একদিন দাদাভাই বিরক্ত হয়ে ঘোষণা দিয়ে ছবি আঁকা বন্ধ করে দিল।

তারপর হঠাৎ একদিন সে একটি কবিতা লিখে ফেলল—

দিতে পারো এক শ ফানুশ এনে?
আজন্ম সলজ্জ সাধ
একদিন আকাশেতে কিছু ফানুশ উড়াই...

সেই কবিতা আবার মেজ বোন মমতাজ আহমেদ শিখুর নামে দৈনিক পাকিস্তান-এ ছাপা হলো। ছাপার অক্ষরে তার কবিতা দেখে আমরা সবাই উত্তেজিত। কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, সে তখন উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে। বরং মেজ বোন শিখু মহা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন সে-ই এই কবিতা লিখেছে! বলেও বেড়াচ্ছে তার বান্ধবীদের ওটা তারই লেখা!

এত বছর পর এখন যখন পেছনে ফিরে তাকাই, কত না স্মৃতি এসে ভিড় করে! আনন্দ আর বেদনার সব স্মৃতি। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই তার কোনো একটা লেখায় লিখেছে, ‘স্মৃতি সে আনন্দেরই হোক, বেদনারই হোক, স্মৃতি সব সময় বেদনার!’

হ্যাঁ, সেই বেদনার স্মৃতি নিয়েই আমাদের বাস করতে হবে এই নন্দিত নরকে। জীবন তো এমনই।

(কিশোর আলোর নভেম্বর ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত)