শব্দ-সমুদ্র ৩

বাংলা পড়তে গেলে এমন অনেক শব্দের সম্মুখীন হতে হয়, যে শব্দগুলো আমরা কখনো শুধু পড়েই যাই কিন্তু গভীরের অর্থ জানি না। অথচ, সেই শব্দগুলোতে আছে সমুদ্রের মতো ব্যাপ্তি আর গভীরতা। ডুবুরি হয়ে শব্দ-সমুদ্রে নেমে তুমিও পেতে পারো মূল্যবান অর্থ-রত্ন।

অক্ষর

‘অক্ষর’ আমরা কে না চিনি! ছোটবেলা থেকেই তো নানা ভাষার অক্ষর চিনে চিনে সবাই এদ্দুর এসেছি, তাই না? এখনো অন্য কোনো ভাষা যদি শিখতে চাই, অক্ষর দিয়েই শুরু করতে হবে। আবার তর্ক উঠলে প্রায়ই ‘অক্ষরজ্ঞান’ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অনেকে বলে বসেন, ‘তোমার কি অক্ষরজ্ঞান নেই?’ ‘সাক্ষরতা দিবস’ বলেও একটি ধারণা আমাদের আছে। সেখানেও ‘স’ যুক্ত ‘অক্ষর’ হলো ‘সাক্ষর’ (স+অক্ষর); অর্থাৎ ‘অক্ষর’ শব্দটি বিরাজমান এখানেও। লেখাপড়া যাঁরা জানেন না, ‘সাক্ষরতা দিবস’-এ তাঁদের বর্ণ শিখিয়ে লেখাপড়ায় আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা চলে। কিন্তু কী করে ‘অক্ষর’ শব্দটি বাংলায় এল? সাধারণভাবে বাংলায় ‘বর্ণ’ আর ‘অক্ষর’ শব্দ দুটো সমার্থক ধরা হয়। অভিধান একে ভুল বলে গণ্য করে না। তবে এখন শব্দ দুটো ব্যবহারগুণে বেশ পৃথক হয়ে পড়েছে। তাই শব্দ দুটো নিয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার।

অক্ষর অর্থ ‘বর্ণ’, ইংরেজিতে ‘Letter’। বর্ণ অর্থে অক্ষর শব্দটি গৃহীত হয়েছিল বাংলা লেখনরীতি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে। ‘ক্ষর’ অর্থ নশ্বর বা যা নাশ হয়। ‘অক্ষর’ অর্থ যা নাশ হয় না। বর্ণ আবিষ্কারের ফলে তো ধ্বনির রূপটি বিনাশের হাত থেকে বেঁচে যায় এবং তা স্মরণযোগ্য হয়। তাই এই প্রতীকচিহ্নটির নাম অক্ষর, মানে বিনাশ নয়। সমাস হিসেবে এটি বহুব্রীহি সমাস: ‘ন (নেই) ক্ষর (নাশ) যার।’ আগে ধ্বনি শুধু উচ্চারণ হতো এবং এর কোনো স্থায়ী রূপ ছিল না। অক্ষর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ধ্বনি আর ক্ষর বা নাশ হলো না। কিন্তু বেধে গেল অন্য এক সমস্যা।

কবিতার যে ছন্দ আছে, সেই ছন্দকে ব্রিটিশ ও আমেরিকান ইংরেজিতে বলা হয় একই, কিন্তু লেখা হয় ব্রিটিশ ইংরেজিতে Matre, আর আমেরিকান ইংরেজিতে Mater। এই ‘Matre বা Mater’ অথবা বাংলায় ছন্দ পরিমাপের ক্ষেত্রে একনিশ্বাসে উচ্চারিত ধ্বনিটুকু হলো: ‘Syllable’। Syllable-এর বাংলা করা হয়েছে ‘অক্ষর’। আর গোল বাধে তাতেই। বাংলা পঠনপাঠনে ‘অক্ষর’ বললে এখন Syllable-ও বোঝানো হয়, আবার Letter-ও বোঝায়। এই ‘গোল’ এড়ানোর জন্য বাংলায় Letter বলতে ‘বর্ণ’ এবং Syllable বলতে ‘অক্ষর’ শব্দের ব্যবহার সচেতনভাবেই বেশি করা হচ্ছে।

অক্ষৌহিণী

বাংলা সন্ধি পড়তে গেলে ‘অক্ষৌহিণী’ বলে একটি শব্দ আসে। নিপাতনে সিদ্ধ স্বরসন্ধির দৃষ্টান্ত হিসেবে সবাই এটি মুখস্থ করে, অনেকেই জানে না এটি কী? আজকাল পত্রপত্রিকায় প্রায়ই লেখা হয়: এক ‘প্লাটুন’ পুলিশ নিয়ে চোরাকারবারির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। এই ‘প্লাটুন’ কী? ‘প্লাটুন’ হলো সর্বোচ্চ ৫০ জনের একটি ইউনিট। লাতিন শব্দ ‘পিল্লুলা’ থেকে ফরাসি শব্দ হয়েছে ‘পেলতন’। সেখান থেকে ইংরেজরা ‘প্লাটুন’ শব্দটি সৃষ্টি করে। কয়েক ‘প্লাটুন’ সৈন্য নিয়ে সৃষ্টি হয় এক ‘কোম্পানি’ সৈন্য। এগুলো ব্রিটিশদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি এবং এই ধারা আমাদের এখানেও চর্চিত। কিন্তু যুদ্ধ আর সৈন্যের ব্যাপারটি তো শুধু ফরাসি বা ব্রিটিশদের নয়, এটি ভারতীয়দেরও ছিল। প্রাচীন কিংবা পৌরাণিককালেও যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে ভারতীয় সমাজে। ‘মহাভারত’-এর আদিপর্বে অক্ষৌহিণীর কথা আছে, আছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখাতেও। তাই শব্দটি সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

‘অক্ষ’ অর্থ হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি; আর ‘ঊহ্’ মানে প্রাপ্ত হওয়া। ‘ঊহিনী’ ‘ঊহ্’-এর স্ত্রীলিঙ্গে বিশালত্ব বোঝায়। তাহলে, ‘অক্ষ’ যুক্ত ‘ঊহিনী’ (অক্ষ+ঊহিনী) হলো ‘অক্ষৌহিণী’। প্রাচীন ও পৌরাণিক রাজরাজড়াদের সৈন্য হিসেবে একটি হাতি, একটি রথ, তিনটি ঘোড়া ও পাঁচজন পদাতিক সৈন্য নিয়ে প্রাথমিক ইউনিট গঠিত হয়; একে বলা হয় ‘পত্তি’। তিনটি ‘পত্তি’ একত্র হলে গঠিত হয় এক ‘সেনামুখ’ ইউনিট। ‘গুল্ম’ ইউনিট গঠিত হয় তিনটি ‘সেনামুখ’ নিয়ে। তিন ‘গুল্ম’ একত্র হলে এক ‘গণ’ ইউনিট হয়। তিনটি ‘গণ’ একত্রে সমাবেশ ঘটলে গঠিত হয় এক ‘বাহিনী’। ‘গুন্ডা বাহিনী’, ‘ক্যাডার বাহিনী’ এ রকম যেকোনো কিছুতেই ‘বাহিনী’ শব্দটি আমরা বলি বটে, প্রাচীন ও পৌরাণিক সৈন্য হিসাব অনুসারে কিন্তু ‘বাহিনী’র হিসাবটি পৃথক। সে রকম তিন ‘বাহিনী’ একত্র হলে হয় এক ‘পৃতনা’ ইউনিট। তিন ‘পৃতনা’য় হয় এক ‘চমূ’। তিন ‘চমূ’তে এক ‘অনীকিনী’ আর দশ ‘অনীকিনী’তে হয় এক ‘অক্ষৌহিণী’। রাজার ক্ষমতা ও সামর্থ্যের ওপর নির্ভর করে অনেক ‘অক্ষৌহিণী’ থাকতে পারে। ‘অক্ষৌহিণী’র প্রধানকে বলা হয় ‘অক্ষৌহিণীপতি’। একজন সেনাপতি থাকেন সবার ওপর এবং তাঁর অধীনে অনেক অক্ষৌহিণীপতি থাকতে পারেন। অন্য ইউনিটগুলোর প্রধানদের বলা হয় ‘পত্তিপতি’, ‘সেনামুখনেতা’, ‘গুল্মনায়ক’, ‘গণনায়ক’, ‘বাহিনীপতি’, ‘পৃতনাপতি’, ‘চমূপতি’, ‘অনীকিনীপতি’।

অগস্ত্যযাত্রা

তুমি শ্রেণিকক্ষে বসে পড়া শুনছ। স্যার বাংলা পড়াতে পড়াতে হঠাৎ নক্ষত্র নিয়ে আলাপ শুরু করলেন।

তিনি বললেন, ‘ক্যারিনা’ (Carinae) কিন্তু নক্ষত্রমণ্ডলের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই নামে ডাকা হয়। ইংরেজিতে একে বলে Canopus। ক্যানোপাস হলো গ্রিক দেবতা, নামটি সেখান থেকেই নেওয়া। এর অবস্থান দক্ষিণ আকাশে এবং এটি খুবই উজ্জ্বল। এর আরবি নাম ‘সুহালি’। বাংলায় এই নক্ষত্রটির নামকরণ করা হয়েছে ভারতীয় ঋষি অগস্ত্যের নামে। অর্থাৎ ক্যারিনা, ক্যানোপাস, সুহালি, অগস্ত্য একই এবং এটি একটি নক্ষত্রের নাম, যে নক্ষত্রটি সূর্যের চেয়ে ৬৫ গুণ বড়।

তুমি জিজ্ঞেস করলে স্যারকে—

: আজ কি আমরা বাংলা রেখে গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে শুনব স্যার? মহাকাশ নিয়ে আলোচনা আমার ভালোই লাগে।

তুমি নিশ্চিত থাকো, স্যার তোমাকে আর এগোতে দেবেন না। কারণ, তিনি মহাকাশ নিয়ে আলাপ শুরু করেননি, তিনি বাংলাই পড়াচ্ছিলেন। বাংলার সঙ্গে এখানে নক্ষত্রের সামান্য যোগ আছে। ভারতীয় পুরাণমতে, মুনি অগস্ত্য দক্ষিণ আকাশে নক্ষত্ররূপে অবস্থান করছেন। কিন্তু কেন এই মুনি আকাশে? এ নিয়ে পৌরাণিক কথকতা হলো এই:

অগস্ত্য খুবই প্রভাবশালী মুনি ছিলেন। তিনি দেবগণের উপকার করেছেন; পিতৃপুরুষের ইচ্ছা পূরণ করেছেন; মানবজাতির জন্য কল্যাণকর কর্ম করেছেন। তিনি বিন্ধ্য পর্বতেরও গুরু। এই পর্বত আর সূর্যের মধ্যে একসময় বাদানুবাদ হলে বিন্ধ্য পর্বত সিদ্ধান্ত নেয়, সূর্যকে সে নিয়ন্ত্রণ করবে। তাই বিন্ধ্য মহাদেবের প্রার্থনা করে। মহাদেবের বরপ্রাপ্ত হয়ে বিন্ধ্য লম্বা ও চওড়ায় বড় হতে থাকে। এমনভাবে সে বড় হয়, যাতে সূর্যও আড়াল হওয়ার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় দেবগণ গুরু অগস্ত্য মুনির কাছে শিষ্য বিন্ধ্য পর্বতকে থামাতে অনুরোধ করেন। অগস্ত্য মুনি তখন বিন্ধ্য পর্বতের সামনে উপস্থিত হন। গুরুকে দেখে শিষ্য বিন্ধ্য মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানায়। অগস্ত্য মুনি তখন বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি দক্ষিণে যাচ্ছি; ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি এ অবস্থায় থাকো।’ এই বলে তিনি ভাদ্র মাসের প্রথম দিনে দক্ষিণ পথে যাত্রা করেন এবং আর ফিরে আসেন না। এ কারণে, ফিরে না আসার মতো যাত্রা হলে বা চিরতরে যাত্রা হলে অথবা মৃত্যুর ঘটনা হলে বাগ্‌ধারা হিসেবে ‘অগস্ত্যযাত্রা’ কথাটি বাংলায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বিন্ধ্য পর্বত মধ্য ভারতের নিম্ন-উচ্চতার একটি পর্বত। পুরাণমতে, বিন্ধ্য মাথা নিচু করে থাকায় তার এই নিম্ন-উচ্চতা। আর এ কারণে সূর্যালোকের গতিও অবাধ হতে পেরেছে। প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে, পয়লা ভাদ্র বাড়ি থেকে কোথাও গমন করা হতো না। অগস্ত্য মুনির দক্ষিণ পথে যাত্রাকে ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত দ্রাবিড়ালয়ের মানবকুলের জন্য জ্ঞানালোকের প্রবহমানতা হিসেবেও মনে করা হয়।