সান্ডা নিয়ে যত কাণ্ড
কত বছর আগের কথা ঠিক মনে নেই। তবে ২০-২২ বছর হতে পারে। বাসা থেকে বের হয়ে কোথাও যাচ্ছিলাম। সঠিকভাবে মনে নেই। আমাদের গলির ঠিক মুখে কবিরাজের মতো এক লোককে দেখলাম ভ্যান গাড়িতে বিভিন্ন আকারের বোতল সাজিয়ে কড়াইয়ে কিছু ভাজছেন। সামনে গিয়ে দেখি বোতলে গাঢ় বর্ণের তেলের মতো পদার্থ। ভ্যানের একপাশে স্টোভ চুলা জ্বলছে। চুলার উপর যে কড়াইটি রাখা তার অর্ধেক তেলজাতীয় পদার্থে ভরা, তেলের মধ্যে ভাসছে কিছু গিরগিটি জাতীয় প্রাণী (সরীসৃপ)।
কবিরাজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন এগুলো খুব দামি প্রাণী। এর তেল মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী। সর্বরোগের মহৌষধ। পাশেই একটি ঝুড়ির ভেতর সাত-আটটি জীবিত প্রাণীও দেখলাম। এই প্রজাতির গিরগিটি এদেশে পাওয়া যায় কি-না জিজ্ঞেস করতেই উনি বললেন ভারত থেকে আনতে হয়। আমি তাকে বললাম এভাবে প্রাণীগুলোকে মেরে তেল বানানো কি ঠিক? বন্যপ্রাণী আইনে কি এটা নিষিদ্ধ নয়? আমার এই কথার কোন সদুত্তর সে দিতে পারল না। বরং কিছুটা বিরক্তই হলো বলে মনে হলো।
এভাবে সরীসৃপ প্রাণীগুলো মেরে সেগুলো থেকে তেল বের করাটা আমার কাছে পৈশাচিক কাজ বলে মনে হলো। এর আগে মৃত ও শুঁটকি করা বনরুই (স্তন্যপায়ী) দিয়ে তাবিজে তৈরি করে বিক্রি করতে দেখেছি। আর কত ভণ্ডামি করবে এরা? অনেকেই এই সর্বরোগের মহৌষধ কিনছেন। কিন্তু কেউ তাকে কিছু বলছেন না। বলেই বা কী হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হস্তক্ষেপ ছাড়া ওদের নিবারণ করা যাবে না। কিন্তু তারা কি সেই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন? এরপরও বেশ কয়েকদিন আমি তাকে একই জায়গায় তেল বিক্রি করতে দেখেছি।
দিনের বেশিরভাগ সময় রোদ পোহায়। রাতে এবং বিপদের সময় ভূগর্ভস্থ ঘরে লুকিয়ে থাকে। মরুভূমির পাহাড়ি বা পাথুরে এলাকায় যেখানে গাছপালা সহজলভ্য, সেখানে বসবাস করে।
যে প্রাণীগুলো থেকে এই তেল বের করা হচ্ছিল কারা তারা, কী তাদের পরিচয়? নিশ্চয়ই তোমাদের জানতে ইচ্ছে করছে। এরা হলো এক ধরনের কাঁটাযুক্ত লেজওয়ালা গিরগিটি বা লিজার্ড যারা সরীসৃপ বা রেপটালিয়া শ্রেণীভুক্ত। সরীসৃপের একটি গোত্র আগামিডি-এর সদস্য এই গিরগিটিগুলো Hardwicke's spiny-tailed lizard বা Indian spiny-tailed lizard নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম Saara hardwickii। অত্যন্ত নিরীহ এই প্রাণীগুলোকে ভারত ও পাকিস্তানের থর মরুভূমি, কচ্ছ এবং আশেপাশের শুষ্ক অঞ্চল জুড়ে পাওয়া যায়। এক সময় এই প্রজাতিটিকে Uromastyx গণের অন্তর্ভুক্ত করা হত, কিন্তু ২০০৯ সালে জীববিজ্ঞানীরা এটিকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত প্রজাতি Saara asmussi ও Saara loricata-এর সঙ্গে Saara গণে স্থানান্তর করেন।
Uromastyx গণের গিরগিটিগুলো মূলত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের (পশ্চিম এশিয়া) বাসিন্দা। এরা সাধারণতভাবে Spiny-tailed lizard অর্থাৎ কাঁটাযুক্ত লেজযুক্ত টিকটিকি, ইউরোমাস্টাইস, মাস্টিগুর বা ড্যাব গিরগিটি নামে পরিচিত। জানামতে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য মিলিয়ে সর্বমোট মোট ১৫টি প্রজাতির ড্যাব গিরগিটি পাওয়া যায়। কাজেই ড্যাব ও সান্ডা মিলিয়ে মোট ১৮টি প্রজাতির অস্ত্বিত্ত্ব রয়েছে।
এরা মূলত মরুভূমির তৃণভোজী গিরগিটি, তবে মাঝেমধ্যে কীটপতঙ্গ ও বাচ্চা গিরগিটিও খেয়ে থাকে। সচরাচর একসঙ্গে অনেকগুলো প্রাণী না থেকে ছাড়া ছাড়া দলে বাস করে, তাই প্রায়শই শিকারি পাখি, যেমন- লগ্গর ফ্যালকন ও চিল বা ইগলজাতীয় পাখিদের টার্গেটে পরিণত হয়। তাছাড়া কিছু স্থানীয় লোকজনও এদের শিকার করে এই বিশ্বাসে যে ওদের থেকে নিষ্কাশিত চর্বি/তেল কামোদ্দীপক ও সর্বরোগের মহোৗষধ। তাছাড়া কিছু উপজাতীয় মানুষ আমিষের চাহিদা মিটাতে ওদের মাংস খেয়ে থাকেন।
এদের মধ্যে Uromastyx ornata অর্থাৎ রঙিন ড্যাব গিরগিটি সৌদি আরব, ইয়েমেন, ইসরায়েল ও মিশরের ঊষর মরুভূমিতে বাস করে। দিনের বেশিরভাগ সময় রোদ পোহায়। রাতে এবং বিপদের সময় ভূগর্ভস্থ ঘরে লুকিয়ে থাকে। মরুভূমির পাহাড়ি বা পাথুরে এলাকায় যেখানে গাছপালা সহজলভ্য, সেখানে বসবাস করে।
যাহোক এদের পরিচয় তো জানা হলো। এবার এদের নিয়ে বর্তমানে ফেইসবুকে যেসব কাণ্ড হচ্ছে সে প্রসঙ্গে আসা যাক। ক’দিন ধরেই ফেসবুকে দেখছি সৌদি আরবের কফিল বা তাদের সন্তান ও আত্মীয়স্বজনেরা নাকি মরুভূমির খামারে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের হাতে রান্না করা সান্ডা বিরিয়ানি, সান্ডা পোলাও বা সান্ডার মাংস খাচ্ছেন। আর বাংলাদেশি কর্মীরা এগুলো রান্না না করলে নাকি চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন। সৌদি কফিল বা তাদের আত্মীয়রা এগুলো খেয়ে খুশি থাকলে বাংলাদেশি কর্মীরা ভিসা নবায়ন ও আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। যদিও সৌদি আরব সরকার সাইটেস (CITES- Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Fauna and Flora) অর্থাৎ বন্যপ্রাণী কেনা-বেচা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলেন, কিন্তু তাদের চাহিদার কারণে স্বল্পপরিচিত এই প্রাণীটি ভবিষ্যতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। আর এতে আমাদের বাংলাদেশি কর্মীদেরও বিপদের পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ তো গেল মধ্যপ্রাচ্যে সান্ডা সমাচার। আমাদের দেশে কী হচ্ছে সান্ডা নিয়ে। এদেশের প্রকৃতিতে তো সান্ডা বসবাস করে না। কিন্তু সান্ডার তেল বিক্রি হচ্ছে বহু আগে থেকেই। অবশ্য সেটা সর্বরোগের মহৌষধ হিসেব। আমার বাসার সামনে ছাড়াও আমার বয়স যখন ১২-১৪ বছর তখনও আমি সান্ডার তেল বিক্রি করতে দেখেছি। যদিও তখন আমি এ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতাম না। বন্যপ্রাণী সম্পর্কে তেমন একটা সচেতনও ছিলাম না। কিন্তু ভারত থেকে তখনও চোরাপথে এগুলো আসতো। এখনও আসে। কিছুক্ষণ আগেও একটি চ্যানেলের খবরে দেখলাম ভারতে থেকে চোরাচালানকৃত ১৭টি সান্ডাসহ একজন গ্রেফতার।
যাহোক, সবচেয়ে হাস্যকর এবং দুঃখের একটি সংবাদ হলো ২-৩দিন আগে ফেইসবুকে দেখলাম সান্ডা মনে করে গুইসাপ (Monitor Lizard) খেয়ে এক ব্যক্তি হাসপাতালে। আসলে আমাদের দেশের মানুষ হুজুগে কেন এতটা মাতাল হয় এটাই আমার প্রশ্ন। বন্যপ্রাণী সম্পর্কে আমাদের জানার অনাগ্রহতা এবং ওদের সংরক্ষণে অনীহা মূলত এজন্য দায়ী। আশা করি তোমরা বন্যপ্রাণী সম্পর্কে জানবে, ওদেরকে রক্ষার জন্য গণসচেতনাতা সৃষ্টি করবে এবং দেশের পরিবেশ সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।