লো-ফি মিউজিক কীভাবে এল

—এটা কী বানিয়েছে? ডেমো ভার্সনটাই রিলিজ দিয়ে দিল?

—এই অংশটা খেয়াল করো, মনে হচ্ছে ফ্যান চলছে!

—রেকর্ড করার সময় বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল মনে হয়, হা হা হা।

—এটা কিসের আওয়াজ? ড্রামের তো মনে হচ্ছে না।

—মনে হয় সামনে যা পেয়েছে, তা-ই বাড়ি দিয়েছে!

—এত ইকো! আর ভোকালও তো অস্পষ্ট।

—বন্ধ করো তো এসব ‘লো-ফিডালিটি’র গান।

ধরে নেওয়া যাক, এটি ষাটের দশকের দৃশ্য। মিউজিক স্টুডিওতে বসে হাসছেন দুই প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী। বিদ্রূপাত্মক মন্তব্যও করছেন মাঝেমধ্যে। ঠাট্টার বিষয় এক উঠতি সংগীতশিল্পীর গান। তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন, ‘প্রথম অ্যালবাম বের করলাম। শুনে কেমন লাগল, জানাবেন প্লিজ।’

খ্যাতিমান দুজনের মতে, গানগুলোর মান খুব একটা ‘ভালো’ নয়। অডিওগুলোয় নানা ধরনের ত্রুটি আছে। কোনোটায় হয়তো ‘ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ’ (আশপাশের আওয়াজ) ঢুকে পড়েছে। গিটারের ভুল নোট রেকর্ড হয়ে গেছে কোনোটায়; আবার কোনোটিতে হয়তো অর্থের অভাবে ব্যবহার করা হয়নি ভালো মানের যন্ত্র। সব মিলিয়ে একটি ‘হোমমেড’ প্রোডাকশন।

দুজন কি সেদিন ভুলেও ভাবতে পেরেছিলেন, যে ‘লো-ফিডালিটি’ ধরনের গানকে তাঁরা তাচ্ছিল্য করছেন, সেটি একদিন নতুন মোড়কে পুরো বিশ্ব মাতাবে? শ্রোতাদের বড় একটি অংশ আক্রান্ত হবে ‘লো-ফি’ জ্বরে?

জনপ্রিয়তা পেল যেভাবে

আশির দশক পর্যন্ত লো-ফির যে চিরায়ত সংজ্ঞা ছিল, তা বদলাতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে। আর তা উসকে দেন নুজাবেস। ২০০৪ সালে মুক্তি পাওয়া সামুরাই চ্যামপ্লুর সংগীত পরিচালকের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। অ্যানিমে সিরিজটির জন্য নুজাবেস এমন সব মিউজিক নির্মাণ করেছিলেন, যা আধুনিক লো-ফির জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তিনি ছাড়া এতে প্রভাব রেখেছেন অন্য জাপানি পিয়ানিস্ট, জ্যাজ আর্টিস্ট, এমনকি স্টুডিও জিবলির চলচ্চিত্রগুলোও।

বিকাশ পর্ব শেষ। এল ২০১৩। ইউটিউবে একের পর এক লাইভস্ট্রিম চ্যানেলগুলোর অভিষেক হতে লাগল। সমৃদ্ধ হতে থাকল ওদের প্লে লিস্ট। শ্রোতারাও যেন লুফে নিলেন। চ্যানেলগুলোর মালিকদের তখন সুসময়। ১৩ বছরের লুক প্রিচার্ড আর জনি ল্যাক্সটনের কথাই ধরা যাক। তাদের চ্যানেল ‘কলেজ মিউজিক’ সে সময়ই মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার পেয়ে যায়। পরবর্তীকালে নিজস্ব রেকর্ড লেবেলই খুলে বসে তারা। ‘লো-ফি গার্ল’সহ অন্যান্য চ্যানেলের জনপ্রিয়তাও তখন চোখে পড়ার মতো। আর করোনাকাল লো-ফি কমিউনিটিতে নতুন মুখের আনাগোনা বাড়িয়ে দিল বহুগুণে।

রেসিপিটা কী

২০০০ সালের আগের লো-ফির সঙ্গে একালের লো-ফির বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। সবচেয়ে বড় তফাত উদ্দেশ্যে। আগে দেখা যেত দক্ষতা বা ভালো উপকরণের অভাবে সংগীতশিল্পীরা যে গান তৈরি করতেন, তা লো-ফির তকমা পাচ্ছে। আর এখন সেটি হচ্ছে ইচ্ছাকৃত।

মাঝারি টেম্পোতে (mid-tempo range) ক্রমাগত ড্রামস বিট, কণ্ঠ মিলিয়ে যাওয়ার আবহ, স্লো-রিভার্ভ আর এক চিমটি প্রকৃতি, সমুদ্র বা দৈনন্দিন কোনো কিছুর আওয়াজ। সঙ্গে হিপহপ, ইন্ডি বা জ্যাজ ঘরানার গানের প্রভাব থাকলে ভালো। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল মিলিয়ন ভিউ পাওয়ার সম্ভাবনা–জাগানিয়া লো-ফি মিউজিক।

কেউ বলে দেয়নি, লো-ফি তৈরি করতে চাইলে এই রেসিপি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে; নইলে শাস্তি শিরোধার্য। কিন্তু আজকাল এ ধরনের রীতি অনুসরণের চল বেশি; এমনকি ইনস্ট্রুমেন্টালের ক্ষেত্রেও।

লোকে কেন লো-ফি শোনে

নির্ভার হতে চাওয়া, ক্লান্তিকে বিদায় জানানো বা মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে লো-ফি হতে পারে সহযোগী। মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির গবেষণাও সে কথাই বলে। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, লো-ফির মতো ধীর ও স্বস্তিদায়ক ঘরানার গান ডোপামিন লেভেলকে ৯ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে মনোযোগ ধরে রাখা কিছুটা সহজ হয়।

তা ছাড়া লো-ফি গান শোনার অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যাতীত মানেন কেউ কেউ, ‘আর্টসেলের ভাষায় বলি, অনুভূতির ব্যবচ্ছেদ করতে বসলে লো-ফি নিয়ে যায় অলস সময়ের পাড়ে।’

আছে সমালোচনাও

আগে লো-ফি তৈরি করলে লোকে হাসত। এখন বিদ্রূপ করা হয় শ্রোতার ভূমিকায় থাকলে, ‘ওহ্‌, তুমি তাহলে লো-ফি শোনো!’ ব্যাপারটি আপেক্ষিক। তবে লো-ফির গুরুতর সমস্যাটি সর্বজনীন। সেটির কথাই বলছি এবার।

গত এক দশকে লো-ফির জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণে। একই সময়ে সহজলভ্য হয়েছে অডিও সম্পাদনার সফটওয়্যার। এমনকি পাওয়া যাচ্ছে টেমপ্লেটও। ফলে, যে কেউই হতে পারছেন লো-ফি নির্মাতা। তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। মুশকিল হয়েছে, নব্য নির্মাতারা যখন নিজেরা মৌলিক গান তৈরি করছেন না; মহাসমারোহে মুক্তি দিচ্ছেন পুরোনো গানগুলোর লো–ফি সংস্করণ।

এর ফলে দেখা দিচ্ছে দুই ধরনের সমস্যা। এক, কোনো গানের লো–ফি সংস্করণ জনপ্রিয় হলে মূল শিল্পীর তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। অর্থ যাচ্ছে লো–ফি নির্মাতার পকেটে। ভারতের এসভিএফের মতো রেকর্ড লেবেলগুলো তাই নিজেরাই প্রকাশিত গানের লো–ফি সংস্করণ মুক্তি দিচ্ছে। দ্বিতীয় ধরনের সমস্যার সূত্রপাতও এখানেই।

সংগীতশিল্পীদের একটি অংশের আশঙ্কা, লো-ফির এমন জয়জয়কার ক্রিয়েটিভ মিউজিক তৈরি করাকে নিরুৎসাহিত করবে।

সংগীতশিল্পীদের ধারণা অমূলক মনে হচ্ছে? নাকি যৌক্তিক? সময়ই উত্তর জানাবে। গান শোনার আগে শুধু নিজেকে প্রশ্ন কোরো, গানটির প্রকৃত শিল্পী কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না তো? আমার একটি ভিউ কি সেই ক্ষতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে?