চাঁদে গিয়ে কী লাভ

শিরোনামের প্রশ্নটা আক্ষরিক অর্থেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। সেই ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা চাঁদে যাওয়ার পেছনে খরচ করেছে ২৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। যত দিন যায়, টাকা বা ডলার, মানে অর্থের মূল্যমান তত পড়ে। আগে যে টাকায় এক হালি ডিম কেনা যেত, এখন তার কয়েক গুণ টাকা লাগে। সেই সময়ের ২৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন তাই ২০২০ সালের অর্থমূল্যে ২৫৭ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। নাহ, বিলিয়নে বললে আমরা বাঙালিরা বিষয়টা ঠিক অনুভব করতে পারি না। কোটিতে বললে ভালো বোঝা যায়। ১ বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি। ২৫৭ বিলিয়ন মানে তাহলে কত? হিসাবটা নাহয় তোমরাই করে নাও! দাঁড়িয়ে অঙ্ক মেলাতে গিয়ে মাথা ঘোরাতে শুরু করলে হিসাবটা বরং বসেই করো, সমস্যা নেই।

তোমরা হয়তো জানো, ৫০ বছর পর আবার চাঁদে যাচ্ছে মানুষ। এই তো কিছুদিন আগেই নাসার নতুন প্রকল্প আর্টেমিসের প্রথম নভোযান আর্টেমিস ১ চাঁদের কক্ষপথ থেকে ঘুরে এল। অবশ্য এই নভোযানে কোনো মানুষ ছিল না। ২০২৪ সালের দিকে আর্টেমিস ২ নামের আরেকটি নভোযান চাঁদের কক্ষপথ থেকে ঘুরে আসবে। তবে এতে ৪ জন নভোচারী থাকবেন। ২০২৬ সালের দিকে আর্টেমিস ৩ নভোচারীদের নিয়ে যাবে চাঁদের কক্ষপথে। সেখান থেকে একটি ছোট্ট ল্যান্ডারে চেপে নভোচারীরা চাঁদে নামবেন। এটার জন্যও বিপুল অঙ্ক বরাদ্দ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থাসহ আরও বেশ কিছু দেশ একসঙ্গে কাজ করছে এ প্রকল্পে।

তবে অনেক কম খরচেও যে চাঁদে যাওয়া যায়, সেটা দেখিয়েছে ভারত। চন্দ্রযান ৩ নামের একটি নভোযান সম্প্রতি চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নেমেছে। ইতিহাস হওয়ার জন্য অতটুকুই যথেষ্ট ছিল। কারণ, এর আগে কোনো দেশই চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে নভোযান নামাতে পারেনি। কিন্তু কারণ আরও আছে। সেটা হেলাফেলা করার মতোও নয়। যেকোনো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানাতে যে খরচ পড়ে, তার চেয়ে কম খরচে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এই নভোযান পাঠিয়ে দিয়েছে দেশটি! ভারতীয় রুপিতে সংখ্যাটা ৬১৫ কোটি, মার্কিন ডলারে ৭৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন। ১০০ মিলিয়নের নিচে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানো কঠিনই বটে। কাজেই বিষয়টা যে ঘটা করে উদ্‌যাপন করার মতো, তা বলাই বাহুল্য!

সে জন্যই দুনিয়াজুড়ে হইচই পড়ে গেছে। অনেকেই জানতে চাচ্ছেন, এত কম খরচে কীভাবে চাঁদে গেল ভারত? তার ওপর আবার দক্ষিণ মেরুতে! আচ্ছা, দক্ষিণ মেরুর বিষয়টা কী? এটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন সবাই? বিষয়টা খুলেই বলি।

চাঁদ সব সময় পৃথিবীকে শুধু একটা মুখ দেখায়। ধরো, তুমি হাতের এক আঙুলে একটা রশি বেঁধে, রশির অন্য মাথায় একটা পাথর বেঁধে দিলে। তারপর সেটাকে ঘোরাতে শুরু করলে জোরে। পাথরের একটা মুখই কিন্তু ফিরে থাকবে তোমার আঙুলের দিকে। পাথরের জায়গায় এবার একটা ছোট্ট ফ্যানের কথা ভাবো। ফ্যানের যে অংশ ধরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, তুমি সে অংশটায় আঙুল বেঁধে দিলে। একদিকে ফ্যানটার শুধু একটা মুখই তুমি দেখতে পাচ্ছ। অন্য দিকে ফ্যানের পাখা তিনটাও ঘুরছে আড়াআড়ি। চাঁদ ঠিক এভাবেই পৃথিবীকে শুধু একটা মুখ দেখায়। কিন্তু সে নিজেও ঘোরে, আড়াআড়ি। এ জন্যই চান্দ্রমাস হয়। বাংলা ও আরবি মাসগুলো আমরা এই চান্দ্রমাসের হিসাবেই গণনা করি। এভাবে কোনো কিছু বাঁধা থাকলে বিজ্ঞানীরা সেটাকে একটা কঠিন নামে ডাকেন—টাইডাল লক। আমরা শুধু বলব, বহু দুঃখ চাঁদ অন্য পিঠে লুকিয়ে রেখেছে। তাই সে আমাদের ওই মুখটা দেখায় না।

কিন্তু মানুষ সেই মুখটাও দেখতে চায়। জানতে চায়, ওখানে কী আছে। সে জন্য অনেক দেশই ওই অংশে নভোযান পাঠানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো নভোযানই সেখানে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে নামতে পারেনি। হয় একদম বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, নয়তো অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোনোরকমে গিয়ে নেমেছে। ভারতই প্রথম স্বাভাবিকভাবে ধীরেসুস্থে চন্দ্রযান ৩–কে নামিয়েছে চাঁদের ওই পাশের একদম দক্ষিণ বিন্দুতে—দক্ষিণ মেরুতে।

মেরু কী, সেটা যদি না বোঝ, তাহলে একটু ছোট্ট করে বলি। ধরো, একটা ক্রিকেট বল। ওটার একদম মাঝখানে ৩টা সুতার মতো থাকে না, ওপরের চামড়ার আবরণটা যেখানে সেলাই করা হয়? সেলাইটাকে ধরলে বলটাকে দুই ভাগ করা যায়। বিজ্ঞানীরা চাঁদ বা পৃথিবীর মতো গোলকের জন্যও এই সেলাইয়ের মতো একটা রেখা কল্পনা করেছেন। রেখাটা গোলকটাকে মাঝখানে দুই ভাগ করে। এই রেখাকে তাঁরা বলেন বিষুব রেখা। রেখার এক পাশে উত্তরাঞ্চল বা গোলকের উত্তর অংশ বা অর্ধেক। বিজ্ঞানীরা এটাকে বলেন উত্তর গোলার্ধ (মানে গোলকের অর্ধেক)। আর অন্য পাশটা দক্ষিণাঞ্চল বা দক্ষিণ গোলার্ধ। এইটুকু যদি বুঝে ফেলে, তাহলে বাকিটা বোঝা পানির মতো সহজ। উত্তরাঞ্চলের একদম উত্তরের বিন্দুতে—ক্রিকেট বলটার উত্তর পাশের ফোলা অংশটার একদম মাঝের জায়গাটা—এটাই উত্তর মেরু। আর দক্ষিণ গোলার্ধের একদম দক্ষিণের জায়গাটা দক্ষিণ মেরু।

এই দক্ষিণ মেরুতেই নভোযান পাঠিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে ভারত। কিন্তু এত কম টাকায় কীভাবে করল?

আসলে কী, ভারত তো ৭০ বছর ধরে মহাকাশ গবেষণায় টাকা বিনিয়োগ করছে। সেটা কিন্তু এই হিসাবে নেই। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় ভারতে শ্রমের মূল্য কম। কয়েক হাজার মানুষ কয়েক বছর ধরে কম টাকা বেতন নিলেই তো টাকাটা অনেক কমে যায়! তার ওপর এই অভিযানের সব প্রযুক্তি ভারত নিজে বানিয়েছে। দোকান থেকে খাবার কিনে না খেয়ে বাসায় বানালে দাম কম পড়ে না? সে রকম। তার ওপর ভারত একটা মজার কাজ করেছে।

তোমরা তো মহাকর্ষ বলের কথা জানো। পৃথিবী বা চাঁদের মতো বিশালাকার জিনিসগুলো এই বল দিয়ে সবকিছুকে টানে। এই মহাকর্ষের জন্যই চাঁদ পৃথিবীর সঙ্গে বাঁধা। আবার পৃথিবীও এ কারণেই সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এই বলের কারণেই আমরা পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে পারি, ওপরে উড়ে যাই না বা নিচে পড়ে যাই না। এই বলকে খুব চালাকি করে ব্যবহার করেন বিজ্ঞানীরা।

অ্যাপোলো ১১ নভোযানের কম্পিউটারসহ নানা যন্ত্রপাতি

ওই যে তোমার আঙুলে সুতা দিয়ে বাঁধা পাথরটাকে ঘোরাচ্ছিলে না? এই ঘোরানোর সময় তুমি যদি প্রতিবার আঙুলটায় একটু করে টান দাও, আর সঙ্গে সুতাটা একটু করে গুটিয়ে নাও, তাহলে কী হবে? পাথরটা ধীরে ধীরে তোমার আঙুলের কাছে চলে আসবে। চাঁদ বা গ্রহের মহাকর্ষকেও এভাবে ব্যবহার করা যায়। এটারও একটা কঠিন নাম আছে—স্লিং শট। কিন্তু এ রকম বারবার টেনে সুতা গুটিয়ে কাছে আনতে অনেক সময় লাগে। তবে সুবিধাটা হলো, তোমার আঙুল ছাড়া পাথরটাকে আর কোনো ধাক্কা কারও দিতে হবে না। ভারত এ রকম করেই চাঁদ ও পৃথিবীর মহাকর্ষকে ব্যবহার করেছে। তাই বাড়তি জ্বালানি ব্যবহার করে ওটাকে ধাক্কা দিয়ে চাঁদের কাছে নিতে হয়নি। কিন্তু অনেক সময় লেগেছে। এ জন্য চাঁদের কক্ষপথে ১৭ দিন ঘুরেছে চন্দ্রযান ৩।

ভারতের চন্দ্রবিজয়ের রহস্য তো বোঝা গেল। কিন্তু আমাদের শিরোনামের প্রশ্নটার জবাব তো হলো না! এবার তাহলে প্রশ্নটায় ফেরা যাক, কী বলো? তা–ই তো, চাঁদে গিয়ে আসলে আমাদের লাভ কী? মানে, এই টাকা পৃথিবীর গরিব দেশগুলোর মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিলে কী চমৎকার হতো, না? কিংবা অন্য কোনোভাবে উন্নয়ন খাতে ব্যয় করলে?

আমার খুব বলতে ইচ্ছা করছে, ঠিক ধরেছ। আসলেই চাঁদে গিয়ে কোনো লাভ নেই! কিন্তু কথাটা বলা যাচ্ছে না। যদিও শুরুতে চাঁদে যাওয়ার বিষয়টা মানুষের মাথায় এসব লাভের কথা ভেবে আসেনি। এসেছে খুব অসুস্থ এক প্রতিযোগিতার ফলে। এই প্রতিযোগিতার নাম স্নায়ুযুদ্ধ। কোল্ড ওয়ার! অনেকে একে শীতল যুদ্ধও বলেন। আসলে এ যুদ্ধে কেউ বরফ নিয়ে মারামারি করেনি। অ্যান্টার্কটিকা বা এ রকম বরফের দেশে কোনো লড়াইও হয়নি। লড়াইটা বেধেছিল রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। এ যুদ্ধ ছিল তাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পেছনে ছিলেন মূলত অ্যাডল্‌ফ হিটলার। জার্মানির তৎকালীন এই প্রধান সাধারণ নিরীহ মানুষদের ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার চালাতে শুরু করেন। তাঁর এই ভয়ংকর প্রচেষ্টা যুদ্ধে রূপ নেয়। দাবানলের মতো ইউরোপ হয়ে জাপান, রাশিয়া, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও একসময় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের কিছু দেশ যেমন রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে মিলে গঠন করে মিত্র বাহিনী। ওদিকে জার্মানি, জাপান, ইতালিসহ বেশ কিছু দেশ একসঙ্গে মিলে তৈরি করে অক্ষশক্তি। পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ। আগেও একবার এমন যুদ্ধ হয়েছে, যেখানে পৃথিবীর বেশির ভাগটায় যুদ্ধের আঁচ লেগেছে। কাজেই, এই যুদ্ধের নাম হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মিত্রবাহিনী এই যুদ্ধে জিতে গেল। তখন গোটা পৃথিবীর সামনে হাজির হলো নতুন এক প্রশ্ন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে? কোন দেশ আসলে শ্রেষ্ঠ? মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে এই ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াইটা ভয়ংকরভাবে বেঁধে যায়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে তত দিনে পুঁজিবাদ—সহজ করে বললে, ব্যবসা ও লাভনির্ভর একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ওদিকে রাশিয়ায় গড়ে উঠেছে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। দেশ দুটোর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামই স্নায়ুযুদ্ধ। তখন তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই। পৃথিবীকে দেখানো—আমি পারি।

মূল কম্পিউটারের ইন্টারফেস—এর মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করা হতো অ্যাপোলো ১১ নভোযানের

রাশিয়া প্রথম মহাকাশে একটা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে দেয়—স্পুৎনিক ১। প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে গিয়ে ঘুরে আসেন ইউরি গ্যাগারিন। প্রথম নারী হিসেবে মহাকাশে গেলেন ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা। মানে, রাশিয়া বুঝিয়ে দিল, তারা পারে।

যুক্তরাষ্ট্র এতবার নাকানিচুবানি খেয়ে ঠিক করল, সরাসরি চাঁদে মানুষ পাঠাবে। এ কারণেই অত টাকা বিনিয়োগ করে তারা। চাঁদের মাটিতে পা রাখেন নীল আর্মস্ট্রং। যুক্তরাষ্ট্র চাঁদকে জয় করে নেয়। রাশিয়াও কিন্তু এ সময় চাঁদে মানুষ পাঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। ব্যর্থ হয়।

তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কী লাভ হলো? প্রথম লাভ হলো, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, ক্ষমতায় বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠল সে। গোটা পৃথিবী জেনে গেল, তার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য কোথায় ভালো হয়? যে দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বেশি, সেখানে! কাজেই, নানা দেশ থেকে মেধাবী মানুষেরা ভিড় জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। বড় বড় ব্যবসার সুযোগ তৈরি হলো। যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠল পরাশক্তি। মানে সুপারপাওয়ার।

পরাশক্তি হয়ে তারা টের পেল, বিশ্বের ক্ষমতা ধরে রাখতে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে-প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে হবে। তারা সেটাই করেছে। ধীরে ধীরে তাই আরও বেড়েছে তাদের ক্ষমতা। তখন অন্য দেশগুলোও এই খাতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। কারণ, প্রযুক্তি উন্নত হলে মানুষের জীবন সহজ হয়। ব্যবসার সুযোগ বাড়ে। আর উন্নত প্রযুক্তির জন্য চাই জ্ঞান-বিজ্ঞান।

ফ্রিজ-ড্রাইড ফুড তৈরি করা হয়েছে অ্যাপোলো প্রোগ্রামে

তবে বিজ্ঞানীরা কিন্তু এসব লাভের জন্য বিজ্ঞানচর্চা করেন না। তাঁরা বিশ্বটাকে জানতে চান, বুঝতে চান। তাঁরা খুঁজে ফেরেন মহাবিশ্বের আঁচলে লুকিয়ে থাকা নানা রহস্যের সমাধান। তাঁদের কাছে ওটাই লাভ। মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হলো? শেষ কীভাবে হবে? এই বিশ্ব কীভাবে কাজ করে? এটা কী কী দিয়ে তৈরি? আরও কোনো মহাবিশ্ব কি আছে? এই সবকিছু কি একসুতায় গাঁথা? এ রকম নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া। কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাব পেতে গিয়ে বিজ্ঞানের যে উন্নতি হয়, যার ফলে প্রযুক্তি এগিয়ে যেতে পারে, তাতে আবার মানুষের প্রতিদিনের জীবন সহজ হয়ে ওঠে।

চাঁদে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলোর পরবর্তী লাভ ওটাই—এ রকম কাজের জন্য যে পরিমাণ প্রযুক্তিগত উন্নতির প্রয়োজন পড়ে, তা গোটা মানবজাতির জীবনকে অনেক সহজ করে দেয়। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? তাহলে বলি। তুমি জেনে অবাক হবে যে সেই ১৯৬৯ সালে প্রথম চাঁদ জয় করার সময় নাসার তত্ত্বাবধানে যেসব প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে, সেগুলো তোমারও প্রতিদিনের জীবনে কাজে লাগে!

এই যে ধরো, তোমার হাতে যে মুঠোফোন বা যে টিভিতে তুমি খেলা কিংবা মুভি দেখো, এই টিভির ভেতর ছোট ছোট বৈদ্যুতিক যন্ত্র থাকে। এগুলোর একটা কঠিন নাম আছে, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসি। আসলে, ওটার মধ্য দিয়ে পুরো জিনিসটায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। মানে, যেকোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মেরুদণ্ড হিসেবে এই আইসি কাজ করে। এটা কিন্তু সেই চাঁদ জয়ের জন্যই প্রথম বিপুলভাবে বানানো শুরু হয়! সে সময় বানানো আইসির প্রায় ৬০ শতাংশই কিনে নেয় নাসা। আবার এই যে ধরো, তুমি যে ওয়্যারলেস ইয়ারফোন বা হেডফোন ব্যবহার করো, এটা কিন্তু নাসার অ্যাপোলো–১১ অভিযানেই প্রথম ব্যবহৃত হয়। কারণ, চাঁদে নেমে হেঁটে বেড়ানোর সময় তার দিয়ে কোনো যন্ত্রের সঙ্গে বাঁধা থাকলে চলবে কীভাবে! আবার এখনকার যেসব শুকনো খাবার আছে, যেগুলো ফ্রিজে রেখে খাওয়া যায়, এগুলোও তখনই প্রথম বানানো হয়। এগুলোর নাম ফ্রিজ-ড্রাইড ফুড। যেন গরম বা রান্না না করেই খাওয়া যায়, সে কথা মাথায় রেখেই বানানো হয় এগুলো। অগ্নিনিরোধক কাপড় বা স্যুট, স্মোক ডিটেকটর, এয়ার পিউরিফায়ার, এমনকি আধুনিক কম্পিউটার মাউসের যাত্রাই শুরু হয় চাঁদে অভিযানের জন্য। এ রকম প্রায় ১০ হাজার নতুন প্রযুক্তি সে সময় তৈরি ও বাজারজাত করা হয়েছিল। বুঝতেই পারছ, এসব প্রযুক্তি না থাকলে আমাদের আজকের সভ্যতাটা আর এমন হতো না।

অগ্নিনিরোধক স্যুট তৈরি করেছে মানুষ চাঁদে যাওয়ার জন্য

তা ছাড়া আরেকটা বিষয় হলো, এ রকম বড় বড় প্রকল্প নিজেই মানুষের জন্য কাজ ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে। এই যেমন ধরো মেট্রোরেল বা পদ্মা সেতু। জিনিসটা বানালে কত মানুষের চলাচলে সুবিধা হবে, সেটা তো একটা বিষয়। কিন্তু এসব প্রকল্পে যত মানুষ কাজ করছেন, বেতন পাচ্ছেন নিয়মিত, তাঁদের কথাও তো ভাবতে হবে। চাঁদে অভিযানের মতো বড় প্রকল্পে তাহলে কত মানুষের কাজের ব্যবস্থা হয়, সেটা ভেবে দেখো!

যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত কিংবা অন্যান্য দেশ যে এত বছর পর আবার চাঁদে যাচ্ছে, এ জন্যও নতুন প্রযুক্তি বানাতে হচ্ছে। তবে সেগুলোর ফল হয়তো আমরা এখনই পাব না। আরও কয়েক বছর বা দশক পরে পাব। কিন্তু এসব ফল মানুষেরই কাজে লাগবে। তা ছাড়া ভারত এত কম খরচে চাঁদে নভোযান পাঠিয়ে যখন নিজেদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রমাণ করল, তখন তাদের দেশে আরও বড় বড় বিনিয়োগও নিশ্চয়ই আসবে (আসলে ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছে)। আর এই প্রকল্পে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের বিষয়টা তো রয়েছেই!

এ ছাড়া চাঁদ বা গ্রহাণুগুলোয় অভিযান চালানোর আরও কিছু লাভ আছে। যেমন চাঁদের ধূলিকণায় হিলিয়াম রয়েছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তির জন্য এগুলো কাজে লাগতে পারে। কিংবা গ্রহাণুগুলোয় আছে মূল্যবান খনিজ। এগুলো পৃথিবীতে আনতে পারলে কাজে লাগবে। অবশ্য এগুলো এখনো সম্ভাবনার পর্যায়ে রয়েছে, নিশ্চিতভাবে বলার উপায় নেই।

আরেকটা বিষয় নিয়েও ছোট্ট করে বলা প্রয়োজন। আমাদের অনেকেরই একটা ভুল ধারণা আছে, এ ধরনের প্রকল্পগুলোর পেছনে ব্যয় না করলে সেই অর্থ সরাসরি গরিবদের দিয়ে দেওয়া যেত। আসলে এটা করা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের সম্পদ সীমিত। অসীম নয়। সে জন্য যেখানে টাকা বিনিয়োগ না করলে নতুন টাকা আসে না, সেখানে আসলে চাইলেও অনেক টাকা দেওয়া যায় না। যেমন তোমার কাছে কিছু টাকা আছে। তুমি যদি সেই টাকা একটা ব্যবসায় বিনিয়োগ করো, তাহলে সেখানে লাভ করে তুমি আরও অনেককে টাকা দিতে পারবে। পাশাপাশি এই ব্যবসায় যাঁদের কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেবে, তাঁদের বিষয়টা তো রয়েছেই। কিন্তু তুমি চাইলেও সব টাকা দান করে দিতে পারবে না। যদি দাও, তাহলে তুমি অল্প কিছু মানুষকেই সাহায্য করতে পারবে। এই সাহায্যের পরিমাণ বাড়বে না। পাশাপাশি, সেই সব মানুষও স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না, নিজে আয় করতে শিখবে না। অর্থাৎ, বড় পরিসরের হিসাবে ভাবলে, এভাবে কাউকে টাকা দিয়ে দেওয়া যায় না। সরকারগুলোও সেভাবেই কাজ করে। যদি শুধু টাকা দান করে যায়, তাহলে একসময় সব টাকা ফুরিয়ে যাবে। সে জন্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু গরিবদের জন্যও সে কাজ করে। তাদের বিনা মূল্যে বা কম খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, কম খরচে বিভিন্ন পণ্য কেনার ব্যবস্থা করে দেয়—এ রকম। কিন্তু সরাসরি দান করে দিতে পারে না। অর্থাৎ, এ ধরনের গবেষণা প্রকল্পগুলো আর দশটা প্রকল্পের মতোই কাজ করে। এসব প্রকল্প না করলে এ থেকে আমরা যে লাভ পাই, তা তো পেতামই না; আবার সরকারও ঢালাওভাবে দান করতে পারত না।

অর্থাৎ, এ ধরনের প্রকল্পগুলোর লাভ-ক্ষতির হিসাব এককথায় বা সরলভাবে করা সম্ভব নয়। এখানে রাজনৈতিক বিষয় আছে, নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মতো বিষয় আছে, প্রযুক্তি বা উন্নয়নের বিষয় আছে। আছে আরও নানা কিছু।

সবচেয়ে বড় বিষয়টা হলো, মানুষ বিজ্ঞানচর্চা করে মহাবিশ্বকে জানতে, বুঝতে। এ ধরনের গবেষণাগুলো ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। এ ধরনের গবেষণাগুলো না করলে আমরা কখনোই পৃথিবীর বাইরের কিছু জানতে পারতাম না। জানতে পারতাম না মহাবিশ্ব বা পৃথিবীর নানা রহস্যের সমাধান। সত্যি বলতে, নিজেদেরও জানতে পারতাম না আমরা। মহাবিশ্বের রহস্যগুলোর সমাধান ও পেছনের নিগুঢ় সত্যটা খুঁজে ফেরে বিজ্ঞান। ২০ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে এ নিয়ে। কথাটাকে সরল করে বলা যায়, মহাবিশ্বের রহস্য ও সত্যগুলো জানার মতো আনন্দের আসলে আর কিছু নেই।