ফারাও তুতেনখামেনের অভিশাপ গুজব না সত্য
খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৩২ সাল। প্রাচীন মিসর। পবিত্র মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোর। অপেক্ষা করে আছে সে, কখন একজন পুরোহিত এসে তার মাথায় ঝলমলে সোনার মুকুট পরিয়ে দেবে, আর সে পরিণত হবে মিসরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষে। ৯ বছর বয়সী এই কিশোরের নাম তুতেনখামেন।
মাত্র ৯ বছর বয়সে মিসরের ফারাও বা ফেরাউন হয়েছিল কিশোর তুতেন। সময়টা ছিল তখন অস্থির। সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে মিসর ও প্রতিবেশী নুবিয়ার মধ্যে। খুব অল্প বয়সে সিংহাসনে বসায় সেই অর্থে নিজের হাতে রাজ্য পরিচালনা করতে পারেনি কিশোর তুতেনখামেন। প্রকৃত ক্ষমতা ছিল উপদেষ্টা আয় এবং সেনাপতি হোরেমহেবের হাতে। তাঁদের সাহায্যে রাজ্যের স্থিতিশীলতা ফেরাতে এবং পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তুতেনখামেন। তুতেনখামেনের পিতা ছিলেন আখেনাতেন।
তবে সেই সময়ের সুনির্দিষ্ট কোনো লিখিত তথ্য না থাকায় তাঁর শাসনকাল সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। রাজত্বের প্রায় ১০ বছর পর, মাত্র ১৮ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তরুণ তুতেনখামেনের।
১৯২২ সালের আগপর্যন্ত এই কিশোর ফারাও সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানত না মানুষ। সেই বছর মিসরের ফারাওদের উপত্যকায় তুতের সমাধি আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টার। মরুভূমির নিচে একটা গোপন সমাধি খুঁজে পাওয়ার পর, প্রায় দুই বছর ধরে সমাধিকক্ষের ভেতরে খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যান তিনি। একটা কফিন খুঁজে পান। কফিন খুলতেই দেখা যায়, ভেতরে আছে আরেকটা কফিন। দ্বিতীয় কফিন খুলতে দেখা গেল—এটার ভেতরেও আছে আরেকটা কফিন! আর এই কফিনটা ছিল খাঁটি সোনার তৈরি। এই সোনার কফিনের ভেতরেই ছিল রাজা তুতের মমি। তিন হাজার বছরের বেশি সময় ধরে অক্ষত অবস্থায় ছিল মমিটা!
মমি আবিষ্কারের পরপরই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কফিনের ভেতরে জমে থাকা তেল থেকে দেহটা আলাদা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অসাবধানতাবশত বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় মমিটা, ফলে রাজা তুতের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা কঠিন হয়ে পড়ে।
অনেকে ধারণা করেছিলেন, রাজা তুতকে হয়তো বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন থ্রিডি স্ক্যানিংয়ের সাহায্যে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে বোঝা যায় যে ক্ষমতাধর এই ফারাও আদতে খুবই দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন—এমনকি তাঁর একটা পা ছিল ভাঙা। তাঁর সমাধিতে বিপুল ধনরত্নের পাশাপাশি বেশ কয়েকটা রথও ছিল। হতে পারে, সমাধিতে সেগুলোর কোনো একটা থেকে পড়ে গিয়েই পা–টা ভেঙেছিল তাঁর। যেহেতু আগে থেকেই তাঁর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল দুর্বল, তাই দুর্ঘটনায় মারা না গেলেও, সম্ভবত সংক্রমণ থেকে মৃত্যু হয় তাঁর। তবে পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের অভাবে, তরুণ এই ফেরাউনের মৃত্যুর সঠিক কারণ সম্ভবত কোনো দিনই জানা যাবে না।
তবে তিনি যেভাবেই মারা গিয়ে থাকুন না কেন, তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত মমিতে পরিণত করেছে তাঁর সমাধি থেকে পাওয়া বিপুল ধনসম্পদ।
তুতেনখামেনের অভিশাপ: বাস্তব, না গুজব
গত শতাব্দীর বেশ কয়েক দশকজুড়ে তুতেনখামেনের সমাধি নিয়ে অনেক গুজব বাজারে ছড়িয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত একটি হলো, মমি আবিষ্কারের পর থেকে রহস্যময়ভাবে একে একে মারা যেতে থাকে সেই অভিযানের সঙ্গে জড়িত মানুষেরা। ঝড়ের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ফেরাউনের অভিশাপের গুজব। বিজ্ঞানীরা এগুলোকে কাকতাল এবং অতিরঞ্জিত গুজব বলে মনে করেন।
গুজব ছড়ায়, তুতেনখামেনের সমাধির পাথরের দেয়ালে নাকি খোদাই করে লেখা ছিল একটা সতর্কবাণী:
‘যে এই সমাধির গোপনীয়তা ভাঙবে, তার ওপর নেমে আসবে মৃত্যু।’
বলা হয়, তুতেনখামেনের অভিশাপের প্রথম শিকার হন লর্ড কারনারভন। অভিজাত ধনাঢ্য এই ব্রিটিশ ভদ্রলোক ছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ হাওয়ার্ড কার্টারের পৃষ্ঠপোষক। তিনি এই খননকাজে অর্থায়ন করেছিলেন। সমাধি আবিষ্কারের কিছুদিন পর মশার কামড়ে আক্রান্ত হন তিনি। আক্রান্ত স্থানে রেজার দিয়ে কাটার ফলে সংক্রমণ তৈরি হয়, যার ফলে মৃত্যু হয় তাঁর। লর্ড কারনারভনের মৃত্যুর পর সংবাদমাধ্যমে ‘তুতেনখামেনের অভিশাপ’ বা ‘মমির অভিশাপ’ নিয়ে ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। শার্লক হোমসের স্রস্টা বিখ্যাত লেখক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল বলেন, সমাধির পবিত্রতা রক্ষার জন্য তুতেনখামেনের পুরোহিতরা অতিপ্রাকৃত শক্তি সৃষ্টি করেছিল, যেটা কারনারভনের মৃত্যু ঘটিয়েছে। ৩ এপ্রিল ১৯২৩, হাওয়ার্ড কার্টার সমাধিকক্ষ উন্মুক্ত করার ছয় সপ্তাহ পর, কোনান ডয়েল নিউইয়র্কে আত্মিকবাদ নিয়ে তাঁর লেকচার ট্যুর শুরু করেন। ৫ এপ্রিল কারনারভনের মৃত্যুর পর এক সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেন যে ‘ফারাওদের অভিশাপ’–এর সঙ্গে এই মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক আছে কি না। ডয়েল বলেন, এটা তাঁর বন্ধু বার্ট্রাম ফ্লেচার রবিনসনের মৃত্যুর মতোই একটা ‘রহস্যজনক ঘটনা’। ৭ এপ্রিল ১৯২৩-এ ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকায় তাঁর এই বক্তব্য ছাপা হলে ‘মমির অভিশাপ’ তত্ত্ব আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এরপর আরও কিছু লোক মারা যান, যাঁরা এই মমি খননের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
জর্জ হবার্ট: সমাধি খননের সহকারী। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যা করেন।
আর্চিবাল্ড ডগলাস রিড: তুতেনখামেনের মমি এক্স-রে করার পর অজানা রোগে মারা যান।
হিউ ইভলিন-হোয়াইট: প্রত্নতত্ত্ববিদ। সমাধি পরিদর্শনের পরে আত্মহত্যা করেন।
রিচার্ড বেথেল: কার্টারের ব্যক্তিগত সচিব। হোটেলের ঘরে রহস্যজনকভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
তবে বিজ্ঞানীরা এসব মৃত্যুর পেছনে খুঁজে পেয়েছেন বাস্তব ব্যাখ্যা। প্রাচীন সমাধির ভেতর ছড়িয়ে থাকে বিষাক্ত ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ জায়গায় জমে থাকা এসব বিষাক্ত ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। অনেকের মৃত্যুর কারণ ছিল স্বাভাবিক রোগবালাই বা মানসিক চাপজনিত আত্মহত্যা। কয়েকজন স্রেফ বার্ধক্যজনিত কারণেই মারা গিয়েছিলেন। কাজেই বিজ্ঞানীদের কথা হচ্ছে, এসব মৃত্যুর পেছনে অভিশাপ নয়, বরং স্বাভাবিক কারণই দায়ী।