সমুদ্রের পানি কেন পান করা যায় না

এআই আর্ট

পৃথিবীর প্রায় একাত্তর ভাগ জুড়ে রয়েছে নীল সমুদ্র। এই বিপুল জলরাশি দেখে মনে হতে পারে যে পানির অভাব কখনোই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পৃথিবীর পানযোগ্য পানির পরিমাণ মাত্র ৪ ভাগ। সাগরের এই অসীম পানির ভাণ্ডার থেকে একফোঁটা পানিও আমরা পান করতে পারি না। বরং যদি কেউ সমুদ্রের পানি পান করার দুঃসাহস দেখায়, তাহলে তার পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। কিন্তু এরকম হওয়ার কারণ কী?

সমুদ্রের পানি পান করলে প্রথমেই এর তীব্র নোনতা স্বাদ পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে শুরু হয় গলায় জ্বালাপোড়া। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে বমি বমি ভাব ও পেট ব্যথা। কিন্তু এগুলো তো স্রেফ শুরু। কেউ যদি কয়েক গ্লাস সমুদ্রের পানি পান করে ফেলে, তাহলে তার শরীরে ভয়ানক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। তাতে মাত্র তিন দিনের মধ্যে তার মৃত্যুও হতে পারে।

এই ভয়াবহতার মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত অতিরিক্ত লবণে। প্রতিদিন আমরা যে সুপেয় পানি পান করি, তাতে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ থাকে মাত্র ৫০০ পার্টস পার মিলিয়ন বা পিপিএম। অথচ সমুদ্রের পানিতে এই লবণের পরিমাণ ৩৫ হাজার পিপিএম। সোজা কথায়, সাধারণ পানির চেয়ে প্রায় সত্তর গুণ বেশি। এই বিপুল পরিমাণ লবণের মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম ক্লোরাইড, ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম সালফেট, ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড এবং পটাসিয়াম ক্লোরাইডের মতো নানা রাসায়নিক উপাদান।

সাগরের এই অতিরিক্ত লবণযুক্ত পানি আমাদের দেহে ঢুকলেই শুরু হয় একটি জটিল বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যাকে বলা হয় অসমোসিস। আমাদের দেহের প্রতিটি কোষ একটি অর্ধভেদ্য পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। এর মধ্য দিয়ে পানির অণু সহজেই যাতায়াত করতে পারে, কিন্তু লবণের মতো বড় অণুগুলো সহজে যেতে পারে না। সাগরের অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি রক্তে মিশে গেলে রক্তে লবণের ঘনত্ব বেড়ে যায়। এই ভারসাম্যহীনতা ঠিক করার জন্য অসমোটিক চাপের কারণে দেহকোষের ভেতরের পানি বাইরে বেরিয়ে এসে রক্তে মিশতে থাকে।

সমুদ্রের পানি পান করতে পারে তিমি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এই প্রক্রিয়ায় কোষগুলো পানি হারিয়ে আস্তে আস্তে সংকুচিত হতে থাকে। ফলে দেহকোষ স্বাভাবিক কাজকারবার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে ঘনত্বের ভারসাম্য না আসা পর্যন্ত। এভাবে শরীরের সব কোষ থেকে পানি শুকিয়ে যায়। ফলে দেখা দেয় চরম পানিশূন্যতা।

এদিকে শরীরের কিডনি দুটি এই অতিরিক্ত লবণ ছেঁকে বের করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে তাদের প্রয়োজন হয় আরো বেশি পানির। কিন্তু শরীরে তখন চলছে পানিশূন্যতা। ফলে কিডনি দুটি অতিরিক্ত চাপে পড়ে ক্রমশ তাদের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মাত্র তিন দিনের মধ্যে এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ দুটি সম্পূর্ণভাবে বিকল হয়ে যেতে পারে।

শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পায়। হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক ছন্দে স্পন্দিত হতে থাকে। এতে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কারণও হতে পারে। অতিরিক্ত লবণের কারণে মস্তিষ্কের কোষগুলোও সংকুচিত হয়ে যায়। ফলে মাথাব্যথা, বিভ্রান্তি, খিঁচুনি এবং এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। ক্রমে ক্রমে ব্যক্তি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং চেতনা হারিয়ে কোমায় চলে যেতে পারেন।

ইতিহাসে এরকম অনেক ঘটনা দেখা যায়, যেখানে সমুদ্রে জাহাজডুবির পর নাবিকরা পানির অভাবে সমুদ্রের পানি পান করে মারা গেছে। তাই জরুরি অবস্থায় কেউ সমুদ্রে আটকে পড়লে, কখনোই সমুদ্রের পানি পান করা যাবে না। বরং বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে হবে। অথবা সূর্যের তাপ ব্যবহার করে সমুদ্রের পানি বাষ্পীভূত করে তার ঘনীভূত পানি সংগ্রহ করে, তা পান করতে হবে।

তবে মানুষ সাগরের পানি পান করতে না পারলে কিছু সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখি এই পানি পান করতে পারে। যেমন তিমি, সিল, অ্যালবাট্রস পেঙ্গুইন। এর কারণ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী এই প্রাণীদের বিশেষ ধরনের কিডনি থাকে। অন্যদিকে সামুদ্রিক পাখিদের নাকে একটা বিশেষ ধরনের গ্ল্যান্ড থাকে, যা তাদের রক্ত থেকে লবণ দূর করতে পারে।

আধুনিক বিজ্ঞান এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছে ডিস্যালিনেশন বা লবণ অপসারণ প্রযুক্তির মাধ্যমে। বিপরীত অসমোসিস, বাষ্পীভবন কিংবা ইলেক্ট্রোডায়ালিসিসের মতো পদ্ধতি ব্যবহার করে সমুদ্রের পানি থেকে লবণ সরিয়ে তাকে পানযোগ্য করে তোলা হয়। বিশ্বের অনেক দেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে তাদের পানীয় জলের চাহিদা মেটানো হয়।

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান ও লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন