পৃথিবীর মতো চাঁদেও করা হবে আলাদা টাইম জোন

পৃথিবীর মতো চাঁদেরও একটি একক ও সর্বজনীন সময়মান নির্ধারণের সময় এসেছে। এ বছরের এপ্রিল মাসের ২ তারিখ মঙ্গলবার এক ঐতিহাসিক ঘোষণায় হোয়াইট হাউস মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাকে চাঁদ ও অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তুর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়মান তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছে। এই অভিনব পদক্ষেপ মহাকাশ অন্বেষণের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত, যা মহাকাশে সহযোগিতা ও অগ্রগতির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে বলে জানিয়েছে নাসা। চাঁদে এই নতুন সময়কে ডাকা হবে ‘কো-অর্ডিনেটেড লুনার টাইম’ বা ‘এলটিসি’ নামে।

চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। দীর্ঘদিন ধরে মানুষের কল্পনা ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এটি। রহস্যময় এই উপগ্রহ আমাদের গ্রহ থেকে অনেক দিক দিয়েই আলাদা। তবে এর সময় পরিমাপের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সময় ধরেই সময়মান নির্ণয় করা হয়েছে এত দিন ধরে। পৃথিবীর সঙ্গে তুলনা করে চাঁদের ঘূর্ণন ও কক্ষপথের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো একটি আকর্ষণীয় প্রশ্নের জন্ম দেয়, চাঁদের নিজস্ব টাইম জোন থাকা কি প্রয়োজন?

এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য, আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে যে পৃথিবীতে টাইম জোন কীভাবে কাজ করে। আমরা জানি, সারা বিশ্বে সময়ের হিসাব রাখা হয় গ্রিনিচ মিন টাইম বা জিএমটি মান অনুসারে। ইংল্যান্ডের গ্রিনিচে অবস্থিত রয়েল অবজারভেটরি থেকে বিশ্বব্যাপী সময় গণনা করার জন্য ব্যবহৃত একটি মান হলো গ্রিনিচ মান। এই মান পৃথিবীর ঘূর্ণন অনুসারে নির্ধারণ করা হয়। পৃথিবী নিজের অক্ষে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘোরে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে সূর্যের আলো আলাদা আলাদা সময়ে পৌঁছায়। জিএমটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উপাত্ত বিশ্লেষণকে সমন্বয় করতে সাহায্য করে। ১৮৪৭ সালে এটির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এই পার্থক্যকে সমন্বয় করার জন্য আমরা টাইম জোন ব্যবহার করি, যা পৃথিবীকে নির্দিষ্ট দ্রাঘিমাংশের ওপর ভিত্তি করে সময়ের অঞ্চলে বিভক্ত করে।

চাঁদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি একটু জটিল। পৃথিবীর সময় (জিএমটি) চাঁদে ব্যবহার করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদের সময় পৃথিবীর সময় থেকে অনেক দূরে সরে যাবে। এর কারণ হলো চাঁদ ও পৃথিবীর সময়ের গতি ভিন্ন। চাঁদে পৃথিবীর তুলনায় সময় প্রায় ৫৮ দশমিক ৭ মাইক্রোসেকেন্ড দ্রুত চলে। কারণ, পৃথিবীর তুলনায় চাঁদে মাধ্যাকর্ষণ কম। মনে হতে পারে যে এটি খুব কম সময়, কিন্তু মহাকাশযানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষার ক্ষেত্রে এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।

পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে চাঁদের যে সময় লাগে, তা এর নিজস্ব ঘূর্ণনের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। এর মানে হলো যে চাঁদের একটি নির্দিষ্ট বিন্দু সূর্যের সম্মুখীন হতে প্রায় ২৮ দিন সময় নেয়, যাকে একটি ‘চন্দ্র দিন’ বলা হয়। এই দীর্ঘ দিনের ফলে চাঁদের বিভিন্ন অংশে সূর্যের আলো পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। উদাহরণস্বরূপ, চাঁদের একটি বিন্দুতে সূর্যোদয়ের পর ১৪ দিন অতিবাহিত হলে, সেই বিন্দুতে আবার সূর্যোদয় হতে আরও ১৪ দিন অপেক্ষা করতে হবে। মূলত এই সময়ের পার্থক্যের জন্য এবং সঠিক সময় নির্ধারণের জন্য এই সময়মান প্রয়োজন।

নাসা এতকিছু করছে, কারণ তারা চাঁদে একটি স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনের জন্য মহাকাশ অভিযান চালাচ্ছে, যা ‘আর্টেমিস প্রোগ্রাম’ নামে পরিচিত। এই প্রোগ্রামের লক্ষ্য হলো ২০২৬ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানো। যদিও প্রকল্পটি একটু দেরিতে হচ্ছে, তবু নাসা পরিকল্পনা করছে ক্রমেই সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহ ও মহাকর্ষীয় বস্তুর সময়ের জন্য একক মান নির্ধারণ করার। পৃথিবীর সঙ্গে সময়ের অসংগতির কারণে চাঁদে অবস্থান বা প্রদক্ষিণকালে মহাকাশযানের সময়ত্রুটি দেখা দিতে পারে। এই অসঙ্গতির কারণ হলো, চাঁদে কোনো নির্দিষ্ট সময় মান না থাকা। কো-অর্ডিনেটেড লুনার টাইম শুরু হলে মানুষ যখন চাঁদ ও অন্যান্য গ্রহে অভিযানে যাবে, তখন স্থানীয় গ্রহের দিন ও বছরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সময়বিষয়ক তথ্য সংরক্ষণ করতে পারবে।

চাঁদকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক নীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে। নতুন টাইম জোনের বিষয়ে নাসার শীর্ষ যোগাযোগ ও নেভিগেশন কর্মকর্তা কেভিন কগিন্স বলেন, চাঁদে স্থাপন করা হবে একটি পারমাণবিক ঘড়ি, যা পৃথিবীর ঘড়ির চেয়ে ভিন্ন গতিতে সময় গণনা করে। এ কারণে যখন চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহের মতো অন্য গ্রহে অভিযান হবে, তখন সেখানকার সময় পৃথিবীর চেয়ে ভিন্ন হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সময় ভিন্ন। চাঁদেও কিছুটা এমনই।

আর্টেমিস প্রোগ্রাম একটি আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্রের নাসা এই প্রোগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এতে ৩৬টি দেশ যুক্ত। বেশ কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করছে। যদিও চীন ও রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, আর্টেমিস চুক্তিতে সই করেনি। তারাও চাঁদে নিজস্ব অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে। চার দশক পর নাসা আবারও চাঁদের পৃষ্ঠে মানুষ পাঠানোর জন্য আর্টেমিস-৩ মিশন চালু করছে। এই ঐতিহাসিক অভিযান ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।