পানির নিচে শ্বাস বন্ধ করে বেশি সময় থাকতে পারে যারা

পানির নিচে অক্সিজেন পাওয়া বেশ কঠিন। মাছসহ অনেক জলজ প্রাণী ফুলকার সাহায্যে সরাসরি পানি থেকে অক্সিজেন নিতে পারে। কিন্তু অনেক প্রাণী আছে, যারা পানির উপরিভাগ থেকে বাতাসের বুদ্‌বুদ টেনে নেয় বা নিজেদের শরীরের চারপাশে বাতাস আটকে রাখে। আর কিছু প্রাণী এর চেয়েও কঠিন কাজ করে—নিশ্বাস আটকে রেখে ডুব দেয়, তারপর বাতাসের জন্য আবার পানির ওপরে ভেসে ওঠে। এই প্রক্রিয়া এরা বারবার করতে থাকে।

এসব প্রাণীর মধ্যে কোনো কোনোটা অবিশ্বাস্য রকম দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোন প্রাণী সবচেয়ে বেশি সময় নিশ্বাস আটকে রাখতে পারে? এসব প্রাণীর কি আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য আছে?

নেদারল্যান্ডসের রাডবাউড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক উইলকো ভারবার্ক বলেন, ‘পানির নিচে বেঁচে থাকা আর নিশ্বাস আটকে রাখার মধ্যে পার্থক্য আছে। একটা হলো মৃত্যুর আগে কতক্ষণ টিকে থাকা যায়। আরেকটা স্বেচ্ছায় কতক্ষণ পানির নিচে থাকা যায়।’

অনেক মিঠাপানির কচ্ছপ তাপমাত্রা কমে গেলে সবকিছু বন্ধ করে দেয়। তারপর মাসের পর মাস এরা পানির নিচে থাকতে পারে
যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক প্রাণিবিদ জন স্পাইসার

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিছু পিঁপড়াকে জোর করে পানির নিচে রাখলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু ডুবসাঁতারে পারদর্শী পিঁপড়ারা স্বেচ্ছায় এক মিনিটের বেশি পানির নিচে থাকবে না।

যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক প্রাণিবিদ জন স্পাইসার জানান, নিশ্বাস আটকে রাখতে হলে ফুসফুস থাকতে হয়। শুধু যেসব প্রাণীর ফুসফুস আছে, সেগুলোই নিশ্বাস আটকে রাখতে পারে।

ডলফিন পানির নিচে নিশ্বাস আটকে রাখতে পারে
ছবি: গেটি ইমেজেস

ফুসফুস আছে—এমন প্রাণীদের মধ্যে পানির নিচে সবচেয়ে বেশি সময় থাকতে পারে মিঠাপানির কিছু কচ্ছপ। যেমন ব্ল্যান্ডিং কচ্ছপ। শীতকালে এই সরীসৃপরা নদী আর হ্রদের তলদেশে হাইবারনেশন করে। বরফের নিচে আটকে গেলেও এরা মাসের পর মাস পানির নিচে থাকতে পারে।

কচ্ছপরা ঠান্ডা রক্তের প্রাণী। তাই ঠান্ডা আবহাওয়ায় ওদের বিপাকক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। ফলে শক্তি খরচ হয় কম। অক্সিজেনও কম লাগে। স্পাইসার বলেন, ‘অনেক মিঠাপানির কচ্ছপ তাপমাত্রা কমে গেলে সবকিছু বন্ধ করে দেয়। তারপর মাসের পর মাস এরা পানির নিচে থাকতে পারে।’

প্রকৃতির বিভিন্ন প্রাণী ওদের নিজস্ব কৌশলে পানির নিচে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। মানুষ যেখানে এক মিনিট পানির নিচে থাকলে শ্বাস বেরিয়ে যায়, সেখানে এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় পানির নিচে।

প্রাণীর আকার নিশ্বাস আটকে রাখার ক্ষমতায় বড় ভূমিকা রাখে। বড় প্রাণীরা বেশি সময় নিশ্বাস আটকে রাখতে পারে। কারণ, এদের অক্সিজেনের মজুত বেশি থাকে। আর শরীরের ওজনের তুলনায় এদের অক্সিজেনের চাহিদাও কম।

স্তন্যপায়ীদের মধ্যে বেশি সময় পানির নিচে থাকতে পারে কুভিয়ার বিকড তিমির। এটি ২২২ মিনিট বা ৩ ঘণ্টা ৭ মিনিট টানা পানির নিচে ছিল। অন্য তিমিরাও অনেক সময় পানির নিচে থাকতে পারে। যেমন আর্নক্স বিকড তিমি ১৫৩ মিনিট আর স্পার্ম তিমি ১৩৮ মিনিট পানির নিচে ছিল।

তিমিরা এই অসাধারণ কাজ করতে পারে কয়েকটি বিশেষ অভিযোজনের কারণে। এরা হৃৎস্পন্দন আর বিপাকক্রিয়া ধীর করে দেয়। শরীরের কিছু অংশ থেকে রক্তপ্রবাহ সরিয়ে নেয়। সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় লিভার আর কিডনির মতো অঙ্গের কাজ। এদের পেশি আর রক্তে প্রচুর শ্বাসযন্ত্রের প্রোটিন থাকে যা অক্সিজেন সংরক্ষণ আর নিঃসরণ করে।

এ ছাড়া এই প্রাণীরা অক্সিজেন ছাড়াই শক্তি তৈরি করতে পারে। তবে এটা ওদের জন্য মোটেও ভালো পদ্ধতি নয়। খাবার থেকে শক্তি রূপান্তর হয় ধীরে। এ ছাড়া খাবার হজমের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়। আমরা এই ল্যাকটিক অ্যাসিড সহ্য করতে পারলেও ডুবসাঁতারু স্তন্যপায়ীরা এই অ্যাসিড সহ্য করতে পারে না।

এলিফ্যান্ট সিলও দুই ঘণ্টা পর্যন্ত ডুব দিয়ে থাকতে পারে। তবে এরা শুধু বিপদে পড়লেই এত সময় পানির নিচে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় এদের এত সময় পানির নিচে থাকতে দেখা যায় না।

উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের মধ্যে তিমিরা ডুব দিয়ে থাকার ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়ন হলেও ঠান্ডা রক্তের প্রাণীরা সবচেয়ে বেশি সময় পানিতে ডুবে থাকতে পারে। মিঠাপানির কুমিরের ৪০২ মিনিট বা ৬ ঘণ্টা ৭ মিনিট পানির নিচে থাকার রেকর্ড আছে। পানির উপরিভাগে কোনো বিপদের আঁচ পেলে কুমির অনেক সময় পানির নিচে ডুব মেরে থাকে। তবে এর চেয়েও বেশি সময় পানির নিচে থাকার রেকর্ড আছে লগারহেড সামুদ্রিক কচ্ছপের। এটি প্রায় ৬১০ মিনিট বা ১০ ঘণ্টা ২০ মিনিট পানির নিচে ছিল। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, এরা সর্বোচ্চ ৪৮০ মিনিট বা ৮ ঘণ্টা ডুবে থাকতে পারে।

লেদারব্যাক কচ্ছপরা বেশির ভাগ তিমির চেয়েও গভীরে ডুব দিতে পারে
ছবি: গেটি ইমেজেস

এই ঠান্ডা রক্তের প্রাণীদের স্তন্যপায়ীদের মতোই অক্সিজেন সাশ্রয়ের কৌশল আছে। কিন্তু এদের অতিরিক্ত সুবিধা হলো, নিজেদের গরম রাখতে শক্তি খরচ করতে হয় না। একই আকারের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীর তুলনায় এদের শক্তি খরচ হয় অর্ধেক। কারণ, এরা শরীর গরম রাখতে শারীরবৃত্তীয় উপায় ব্যবহার করে না।

লেদারব্যাক কচ্ছপরা বেশির ভাগ তিমির চেয়েও গভীরে ডুব দিতে পারে। ঠান্ডা পানিতে এরা বিপাকক্রিয়া এতট কমিয়ে দেয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমুদ্রের তলায় শুয়ে থাকতে পারে। মাঝেমধ্যেই এরা এই প্রক্রিয়ায় পানির নিচের গুহায় বিশ্রাম নেয়।

এভাবেই প্রকৃতির বিভিন্ন প্রাণী ওদের নিজস্ব কৌশলে পানির নিচে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেয়। মানুষ যেখানে এক মিনিট পানির নিচে থাকলে শ্বাস বেরিয়ে যায়, সেখানে এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় পানির নিচে!

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

আরও পড়ুন