ঘুরে এলাম পৃথিবীর প্রাচীন ও গভীরতম হ্রদ বৈকাল

পৃথিবীর প্রাচীন ও গভীরতম হ্রদ বৈকালছবি: হুমায়ূন কবীর

সম্প্রতি আমি ঘুরে এসেছি রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর প্রাচীন ও গভীরতম হ্রদ বৈকাল। বৈকাল তার নানান বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ও ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে এক রোমাঞ্চকর জায়গা। শুধু ভ্রমণপ্রিয় মানুষই নন, গবেষকদেরও আগ্রহের জায়গা বৈকাল হ্রদের ইতিহাস ও জীববৈচিত্র্য। তোমরা জেনে বিস্মিত হবে যে ভূপৃষ্ঠের মিঠাপানির ২০ ভাগ হ্রদ বৈকালের একক দখলে। প্রায় ২৫ মিলিয়ন বছরের প্রাচীন এই হ্রদের গভীরতা ১ হাজার ৭০০ মিটার, যা বৈকালকে পৃথিবীর গভীরতম হ্রদের মুকুট এনে দিয়েছে। বৈকালের ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য গবেষকদের কাজে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে, ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ প্রজাতির প্রাণিকুল বিভিন্ন গভীরতায় পানির তলদেশে বসবাস করে, এসবের মধ্যে মিঠাপানির সিল অন্যতম ও জনপ্রিয় প্রাণী।

বৈকাল হ্রদ নিয়ে ক্রমে তোমাদের আরও তথ্য জানাব। তবে তার আগে আমার বৈকাল হ্রদে যাওয়ার রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনি শোনাতে চাই। আমি যখন রাশিয়ায় পড়তে গেলাম, তখন রাশিয়ার রোমাঞ্চকর জায়গাগুলো ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করি এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার নোটবুকে লিখে রেখেছিলাম। পড়াশোনার ফাঁকে একে একে চষে বেড়িয়েছি পূর্ব ইউরোপের ককেশাস পর্বতমালা থেকে উত্তর এশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল, বৈচিত্র্যময় কৃষ্ণসাগর থেকে ভূবেষ্টিত কাস্পিয়ান সাগর, আজারবাইজানঘেঁষা প্রাচীন দাগেস্তান প্রজাতন্ত্র থেকে মঙ্গোলিয়ার সীমান্তঘেঁষা আদিবাসীদের বাসস্থান বুরিয়াত প্রজাতন্ত্র। চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ করে গ্রীষ্মের শেষাংশে বৈকাল হ্রদে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। দক্ষিণ সাইবেরিয়ায় এই সময়ে তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করে, যা খুবই আরামদায়ক ও ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত সময়। রাশিয়ার গণপরিবহন যথেষ্ট সুশৃঙ্খল ও সাশ্রয়ী। বাস, রেল ও বিমানপথে প্রায় সব অঞ্চলে ভ্রমণ করা যায়। ভ্রমণে বাড়তি উত্তেজনা যোগ করতে আমি বেছে নিই জগদ্বিখ্যাত ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ে, যা পৃথিবীর সব থেকে লম্বা রেলপথ। বিশ্বের ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়েতে যাত্রা স্বপ্নের মতো সুন্দর। এই ট্রেন ছেড়ে যায় রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে সর্বপূর্বের শহর ভ্লাদিভস্তক, ভ্লাদিভস্তক চীন ও উত্তর কোরিয়ার সীমান্তঘেঁষা শহর। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ বৈকালে যাওয়ার এই পথ কতটা লম্বা ও রোমাঞ্চকর। আমি যাত্রা শুরু করেছিলাম মস্কোর ইয়ারোস্লভাস্কায়া রেলস্টেশন থেকে, গন্তব্য সাইবেরিয়া অঞ্চলের শহর ইরকুতস্ক।

তোমাদের এর মধ্যে একটা মজার কথা বলি, রুশ ভাষা শিক্ষায় কোনো ব্যক্তির নামে যখন কোনো রাস্তা, মেট্রোস্টেশন বা রেলস্টেশনের নামকরণ করা হয়, তখন সেই ব্যক্তির নামের শেষে কায়া যুক্ত করা হয়, যেমন রুশ ঔপন্যাসিক দস্তয়েভস্কির নামে দস্তয়েভস্কায়া মেট্রোস্টেশন। যা-ই হোক, ফিরে আসি আমার যাত্রাপথে, ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথে ইরকুতস্ক যেতে আমার সময় লেগেছিল ৩ দিন ২২ ঘণ্টা। পুরোটা সময় আমি ট্রেনে ভ্রমণ করেছি নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। কখনো ট্রেন চলেছে নির্জন বনাঞ্চলে, কখনো লোকালয়ে। ট্রেনেই সকাল দেখি, ট্রেনেই সন্ধ্যা, খাওয়া-গোসল। জানালা দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে, বই পড়ে আর পছন্দের গান শুনে সময় কাটাই। মাঝেমধ্যে আমার কামরার বিভিন্ন যাত্রীর সঙ্গে মেতে উঠি গল্পে। মজার বিষয়, ট্রেনে আমি রাশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই ট্রেনের কামরাতে বসেই। আমার রাশিয়ান ভাষাদক্ষতা হলো আমি শ্রবণে পারদর্শী, বলায় খুব একটা পটু নই। ঘটনাবহুল যাত্রায় ইতিমধ্যেই পেরিয়ে এসেছি অনেকগুলো প্রজাতন্ত্র ও অবলাস্ট। পেরিয়ে এসেছি তিনটি ভিন্ন টাইমজোন। আমি বেরিয়েছিলাম মস্কো সময়ে, যা তখন আমাকে এগিয়ে নিয়েছিল মস্কো থেকে আরও পাঁচ ঘণ্টা। মস্কো তখন আমার পাঁচ ঘণ্টা পেছনে ছিল, ভাবতে পারো? একই দেশের আরেক প্রান্তে ভ্রমণ করেই পাঁচ ঘণ্টা সময় এগিয়ে যাওয়া যায়। আমার বন্ধু ভ্যালেন্টিন এ অবস্থার বর্ণনা দিতে গেলে নিশ্চিত ব্যঙ্গ করে বলত, ‘ওয়েলকাম টু রাশা’।

আরও পড়ুন

যাত্রা শুরু করার প্রায় চার দিন পর সন্ধ্যায় এসে পৌঁছালাম ইরকুতস্ক শহরে, রাতের খাবার সেরে কোনো কিছু না ভেবে ঘুমাতে গেলাম। পরের দিনের পরিকল্পনা ইরকুতস্ক শহর থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে বৈকালের বুকে অবস্থিত সবচয়ে বড় দ্বীপ অলখনে যাওয়া। পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই যাত্রা শুরু করি অলখন দ্বীপের উদ্দেশে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে চলছিল আমাদের গাড়ি। রাস্তার দুই ধারে সবুজ ঘাসের বিস্তৃত মাঠ, চারণভূমিতে গরু ও ঘোড়ার পাল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বনাঞ্চল। দুপুরের আগে আগেই পৌঁছে গেলাম ফেরিঘাটে। মূল ভূখণ্ড থেকে বৈকাল হ্রদের একাংশ পার হয়ে যেতে হয় অলখন দ্বীপে। বৈকাল হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশি, গ্রীষ্মের রোদ আর শঙ্খচিলের ওড়াউড়িতে চারপাশ চিকচিক করছে। ফেরি পার হয়ে দ্বীপে প্রবেশ করলাম, আবার গাড়িতে করে পাহাড়ি পথে এগিয়ে চললাম অলখন দ্বীপের সবচেয়ে জনবহুল গ্রাম খুজিরের উদ্দেশে। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম খুজির গ্রামে। চারপাশে বৈকাল হ্রদের জলরাশি, গ্রামঘেঁষা পাহাড় আর বন দেখে অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে উঠল।

ছবি: হুমায়ূন কবীর

অলখন দ্বীপের খুজির গ্রামে বুরিয়াত আদিবাসীদের বাস। সাইবেরিয়ার দুটি বৃহৎ আদিবাসীর একটি বুরিয়াত, অন্যটি ইয়াকুতস্ক। বৈকালে বসবাসরত বুরিয়াতদের প্রধান পেশা হ্রদ থেকে মাছ শিকার করা, কালের বিবর্তনে তারা ঘোড়া পালন ও বর্তমানে পর্যটনে জড়িয়েছে। দুপুর হয়ে এসেছে, আমি দুপুরের খাবার খেলাম বুরিয়াত রান্নাঘরে প্রস্তুত মোমো-জাতীয় খাবার বুজ, গরুর মাংস, সবজি ও আঞ্চলিকভাবে প্রস্তুত সেমাইজাতীয় মসলাদার খাবার শুইভান, সঙ্গে খেলাম স্যুপ-জাতীয় রাশিয়ার জনপ্রিয় খাবার বোর্শ। দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে বাইসাইকেল নিয়ে বের হলাম সূর্যাস্ত দেখার জন্য। সন্ধ্যা হতে হতে তাপমাত্রা ক্রমে কমে আসছে, আরামদায়ক এক হিমেল হাওয়া মনটাকে ঠান্ডা করে দিল। সব মিলিয়ে শারীরিকভাবে ক্লান্ত হলেও মানসিকভাবে অনেক উৎফুল্ল লাগছিল। সেদিনের মতো হোটেলে ফেরত এলাম এবং পরের দিনের পরিকল্পনা করে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিনের পরিকল্পনা, বৈকালে ও দ্বীপের চারপাশে চষে বেড়ানো। হোটেলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জুলিয়া পরদিন দ্বীপে ঘুরে বেড়ানোর জন্য একটি অফরোড গাড়ি ভাড়া করতে আমাকে সাহায্য করলেন।

আরও পড়ুন

পরদিন সকালে হোটেলের সামনে গাড়ি হাজির। গাড়িচালক একজন বুরিয়াত আদিবাসী, তাঁর নাম লনিয়া। তোমাদের মনে আছে, নিশ্চয়ই আমি বুরিয়াত আদিবাসীর কথা বলেছিলাম, যারা কালের বিবর্তনে আজ পর্যটন খাতে জড়িয়েছে। লনিয়া আমাকেসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে গেল একের পর এক সামান পাথরে। সামান নামটি এসেছে সামান ধর্মবিশ্বাস থেকে। বৈকালের কূলে খাড়া এই পাথরগুলোর উচ্চতা ৩০ থেকে ৪০ মিটার। সামান পাথরে বাদামি রঙের একটি পাথরের আকার ড্রাগনের মতো দেখতে। লনিয়া গাড়িতে ভ্রমণকারী সবাইকে তাঁর সাধ্যমতো বর্ণনা করলেন সামান পাথর সম্পর্কে। তারপর আমি ও বাকি সবাই গাড়িচালক লনিয়ার পরামর্শে পাড়ি জমালাম বৈকাল হ্রদের মাঝের দিকে দ্বীপের অংশ কেপ হবইয়ে। কেপ হবই অলখন দ্বীপের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত। কেপ হবই থেকে বৈকাল হ্রদের অন্য পাশে অবস্থিত বুরিয়াত প্রজাতন্ত্রের রাজধানী উলান উডে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার বনজঙ্গল ও পাহাড়ি উপত্যকা পাড়ি দিয়ে আমি পৌঁছালাম কেপ হবইয়ে। কেপ হবই থেকে পুরো বৈকাল হ্রদ দেখা যায়। সামনে, ডানে, বাঁয়ে অপরূপ সুন্দর স্বচ্ছ পানি, আকাশের নীলে একদম নীলাভ জলরাশি। অপর প্রান্তের পাহাড় দেখা যায় আবছা, কিন্তু দেখলে মনে হবে এর কোনো শেষ নেই। হঠাৎ তোমার মনে হবে, সীমাহীন এই জলরাশি হ্রদ কেন হলো? সমুদ্র কেন নয়? বস্তুত, দেখতে সমুদ্রের মতো; কিন্তু মিঠাপানির হ্রদ। আমি যখন কেপ হবই থেকে বৈকালদর্শনে মুগ্ধ, তখন ডাক এল গাড়িচালক লনিয়ার। তিনি ইতিমধ্যে সাইবেরিয়ার জনপ্রিয় মাছের স্যুপ উখা প্রস্তুত করেছেন, উখাতে সাধারণত থাকে বৈকাল থেকে শিকার করা মাছ আর সবজি। খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু এই স্যুপ। উখা খেয়ে আবার কেপ হবইয়ে বসে থাকি অনেকক্ষণ। তারপর এলাম দ্বীপের আরেক অংশে, ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলাম কিছুক্ষণের জন্য। সূর্যাস্তের আগে আগে সেদিনের মতো ফিরে এলাম হোটেলে। পরদিনের পরিকল্পনা পানিকেন্দ্রিক। তার মানে হচ্ছে, স্পিডবোটে ঘুরব, সাঁতার কাটব, সার্ফিং বোর্ড নিয়ে সার্ফ করব।

বৈকালের কূলে খাড়া এই পাথরগুলোর উচ্চতা ৩০ থেকে ৪০ মিটার
ছবি: হুমায়ূন কবীর

শেষ দিন সকালে উঠে সকালের খাবার সেরে ফেলি প্যানকেক ও বোর্শ দিয়ে। খাওয়ার পর ফলমূলসমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী চা। তারপর একটি স্কুটার নিয়ে দ্বীপে বৈকালের কূল ঘেঁষে পাহাড়ি পথে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। দুপুরের আগে আগে সাঁতারের উদ্দেশ্য নিয়ে বৈকাল হ্রদে নেমে পড়লাম। তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও পানি হালকা ঠান্ডা বলে মনে হলো। তবে পানি হালকা ঠান্ডা হলেও স্বচ্ছ পানি আর নীল আকাশ তোমার মন কেড়ে নেবে। সাঁতার দিতে দিতে আকাশের দিকে মুখ করে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছা করবে তোমার। আমি অনেকক্ষণ ভেসে বেড়ালাম। তারপর হোটেলে এসে আবার বের হলাম স্পিডবোটে দ্বীপের চারপাশে বৈকালে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। তুমুল স্পিডে ঘুরে বেড়ালাম এপাশ-ওপাশ। তবে আমার মনে হয়, স্পিডবোটের থেকে দ্বীপ ও পাহাড় থেকেই বৈকাল হ্রদ দেখতে সুন্দর। বিকেলে আমি গেলাম সার্ফিং করতে, সার্ফিং বলতে ঢেউয়ে সার্ফিং নয়, শুধু সার্ফিং বোর্ডটাতে ঘুরে বেড়ানো, নৌকার মতো। আমি অবশ্য সার্ফিং বোর্ডে শুয়েছিলাম অনেকক্ষণ। কী যে সুন্দর অনুভূতি, তুমি ও রকমটা না শুয়ে থাকলে অনুভব করতে পারবে না। ওপরে নীল আকাশ আর চারপাশে বৈকাল হ্রদের স্বচ্ছ জলরাশি। মনে হবে, জাগতিক সব হিসাব-নিকাশ ওখানেই শেষ, জীবন অনেক সুন্দর। এভাবেই এক চমৎকার অনুভূতির মধ্য দিয়ে শেষ হলো আমার বৈকাল হ্রদ ভ্রমণ। আমি ফিরে এলাম কর্মব্যস্ত মস্কোর জীবনে।

লেখক: পিএইচডি শিক্ষার্থী, মস্কো ইনস্টিটিউট অব ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি

আরও পড়ুন