হাওয়াই মিঠাই! নামটা কী মিষ্টি, তা–ই না? তুলার মতো আঁশ আর ভীষণ মিষ্টি! মুখে দিলেই গলে যায়। মিষ্টি স্বাদে ভরে ওঠে মুখ। অরিনের হাওয়াই মিঠাই খেতে ভীষণ ভালো লাগে। মা–বাবার সঙ্গে কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে হাওয়াই মিঠাই দেখলেই হয়েছে। একনাগাড়ে দুই–তিনটা খেয়ে তবেই থামবে ও। অতিরিক্ত হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার কারণেই কি না কে জানে, ইদানীং দাঁতে ভীষণ ব্যথা করে অরিনের। আজ ও এসেছে ডেন্টিস্ট আঙ্কেলের কাছে। ডেন্টিস্ট আঙ্কেল এমনিতে খুব ভালো করে কথা বলেন। দাঁত তোলার সময় ব্যথাও দেন না। তারপরও অরিনের খুব একটা ভালো লাগে না ওনাকে। মাঝেমধ্যে তো রাগই হয়। কারণ, উনি হাওয়াই মিঠাই খেতে নিষেধ করেন। হাওয়াই মিঠাই খেতে কেউ নিষেধ কীভাবে করে, সেটা বুঝতে পারে না অরিন। তোমরা কি বুঝতে পারো? অরিন অবশ্য জানে না, হাওয়াই মিঠাইয়ের আবিষ্কারকও কিন্তু এক ডেন্টিস্ট ভদ্রলোক। জানলে নির্ঘাত রাগটা আরও চড়ে যেত। না, রাগ করা ভালো নয়। অরিন এ কথা জানে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো তাই বেশি রাগ করল না ও। সামান্য যে রাগ করেছিল, সেটাও পানি হয়ে গেল একটু পরই। আচ্ছা, অরিন আপাতত ডেন্টিস্টের আঙ্কেলের কাছে থাকুক, তোমাদের বরং হাওয়াই মিঠাই আবিষ্কারের গল্পটা শোনাই।
এ জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ১৮৯৭ সালে। মনে রাখার জন্য বলি, এর ঠিক দুই বছর পরই ১৮৯৯ সালে জন্ম নেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অর্থাৎ কবির জন্মের দুই বছর আগের কথা বলছি। ডেন্টিস্ট বা দন্তচিকিৎসাবিদ উইলিয়াম মরিসন ও ক্যান্ডি তৈরির কারিগর জন সি. হোয়ারটন প্রথমবারের মতো তৈরি করেন কটোন ক্যান্ডি বা হাওয়াই মিঠাই। প্রশ্ন হলো, ডেন্টিস্ট কেন হাওয়াই মিঠাই আবিষ্কার করতে গেলেন? মিষ্টি জিনিস তো ডেন্টিস্টদের শত্রু হওয়ার কথা, তা–ই না?
কথা অনেকটা সত্যি। তবে, মজার ব্যাপার কী জানো? হাওয়াই মিঠাই জিনিসটা আসলে দাঁতের জন্য এত বেশি ক্ষতিকর নয়। কারণ, একটি হাওয়াই মিঠাইয়ে খুবই সামান্য পরিমাণ চিনি থাকে। বেশির ভাগটাই আসলে বাতাস। চকলেট, কেক, আইসক্রিম, জিলাপি বা রসগোল্লার চেয়ে অনেক কম মিষ্টি থাকে এতে।
১৯০৪ সালে মরিসন আর হোয়ার্টন সেন্ট লুইস ওয়ার্ল্ডস ফেয়ারে নিয়ে যান তাঁদের তৈরি হাওয়াই মিঠাই। ইংরেজিতে তখন অবশ্য তাঁরা এটাকে কটন ক্যান্ডি বলতেন না। নাম দিয়েছিলেন ফেয়ারি ফ্লস। যা হোক, হাওয়াই মিঠাইয়ের প্রতিটি বাক্স তাঁরা বিক্রি করছিলেন মাত্র ২৫ সেন্টের বিনিময়ে। এখনকার দিনে ২৫ সেন্ট তেমন বেশি একটা টাকা নয়। কিন্তু সে সময় মেলায় ঢোকার টিকেটের অর্ধেক ছিল এর দাম। দামি হওয়ার পরও মানুষ খুব আগ্রহ করে কিনছিলেন হাওয়াই মিঠাই। মেলা শেষে মরিসন ও হোয়ার্টন ৬৮ হাজার হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে ফেলেন!
তোমরা অনেকেই হাওয়াই মিঠাই বানানোর প্রক্রিয়াটা দেখেছ। বনবন করে ঘুরতে থাকা যন্ত্রের ওপর প্রথমে চিনি দিতে হয়। তারপর মেশানো হয় পছন্দের খাওয়ার উপযোগী রং। শেষে যন্ত্র থেকে তৈরি হওয়া মাকড়সার জালের মতো চিনির সূক্ষ্ম তন্তুগুলো কাঠিতে পেঁচিয়ে নেন বিক্রেতা।
প্রথম হাওয়াই মিঠাই তৈরির যন্ত্রটা খুব একটা ভালো ছিল না। অনেক বেশি শব্দ করত। ভেঙে অকেজো হয়ে পড়ত হরহামেশাই। ১৯৪৯ সালে হাওয়াই মিঠাই তৈরির জন্য স্প্রিংভিত্তিক একটি মেশিন বাজারে আনে মার্কিন কোম্পানি ‘গোল্ড মেডাল প্রোডাক্টস’। বর্তমানেও তারা এ কাজ করে যাচ্ছে। বাজারের বেশির ভাগ হাওয়াই মিঠাই বানানোর মেশিন তারাই বানায় এখনো।
নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগছে, হাওয়াই মিঠাই বানানোর মেশিনের ভেতর আসলে কী চলে? যন্ত্রের মধ্যে চিনি দেওয়ার পর শুরুতেই সেটা গলে যায়। এরপর সেই চিনির সিরা ঘোরানো হয় মেশিনের সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত পাত্রের মধ্যে রেখে। ঘোরানোর কারণে পাত্রের ছিদ্র দিয়ে খুবই সরু ধারায় ছিটকে বেরিয়ে চিনির সিরা। বাতাসের সংস্পর্শে দ্রুতই তা ঠান্ডা ও শক্ত হয়ে যায়। তৈরি হয় চিনির সূক্ষ্ম তন্তু। এবার এগুলো কাঠিতে পেঁচিয়ে নিলেই তৈরি হয়ে যায় হাওয়াই মিঠাই।
বাজারে নানা রঙের হাওয়াই মিঠাই পাওয়া যায়। কিন্তু চিনির মতোই হাওয়াই মিঠাইয়ের আসল রং কিন্তু সাদা। বাকি সব রং মেশানো হয় আলাদাভাবে।
এখন কথা হলো, একজন ডেন্টিস্ট হাওয়াই মিঠাই আবিষ্কারের পেছনে অবদান রেখেছেন, এটা ঠিক। তাই বলে হাওয়াই মিঠাইকে খুব স্বাস্থ্যকর খাবার ভেবে বোসো না। মিষ্টিজাতীয় অনেক খাবার থেকে এর মধ্যে চিনির পরিমাণ কম। এটা তো আগেই বলেছি। কিন্তু এই ‘কম’টাও আসলে অনেক বেশি। গড়পড়তা একটা ২৫০ গ্রাম কোকের মধ্যে যে পরিমাণ চিনি থাকে, প্রায় ততটা চিনি থাকে একেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ে। তাই মাঝেমধ্যে একটা–দুইটা খেলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু অরিনের মতো হাওয়াই মিঠাই ঘন ঘন খাওয়া একদমই ঠিক নয়। তাতে দাঁতের সমস্যা তৈরি হতে পারে। আসলে সবকিছুই এমন। কোনো কিছুই অতিরিক্ত খাওয়া বা করা ভালো নয়।
সূত্র: ওয়ান্ডারোপোলিস ডটঅর্গ, উইকিপিডিয়