কোনো প্রাণীর কামড় কতটা শক্তিশালী, তা নির্ভর করে ওই প্রাণীর চোয়ালের পেশি, চোয়ালের হাড় ও দাঁতগুলোর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের ওপর। পাশাপাশি কোনো প্রাণী মধ্যাহ্নভোজনে কোন আকারের প্রাণী বা খাবার খায়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, কামড়ের জোর নির্ভর করে প্রাণীর চোয়াল কতটা প্রসারিত হয়েছে তার ওপর। আরও সহজ করে বললে, প্রাণীটি খাদ্য হিসাবে কী খাচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে চোয়াল কতটা প্রসারিত হবে। কামড়ের শক্তি প্রতি বর্গ ইঞ্চি পাউন্ডে নির্ণয় করা হয়। একে সংক্ষেপে বলে পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি)। মানে এক বর্গ ইঞ্চি জায়গায় কত পাউন্ড শক্তিতে কামড় দিচ্ছে তা বোঝায়। এখন এমন ১০টি প্রাণীর সঙ্গে পরিচিত হই, যাদের কামড়ের শক্তি সবচেয়ে বেশি। এখানে বলে রাখি, মানুষের কামড়ের শক্তি প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে মোটামুটি ১৬০ পাউন্ড। অর্থাৎ ১৬০ পিএসআই। আমাদের কামড়ের শক্তি জানা থাকলে অন্যান্য প্রাণীর কামড়ের শক্তির সঙ্গে তুলনা করতে সুবিধা হবে।
হায়েনা মাংসাশী প্রাণী। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে এদের দেখা যায়। মাঝেমধ্যে প্লানেটস লাইভ দেখলে সেখানে দেখে থাকবে, চিতা বা সিংহের দলের পেছনে এদের ঘুরতে দেখা যায়। অনেক সময় সিংহের খাবার চুরি করে এরা। মাঝেমধ্যে আবার তাদের রেখে যাওয়া বাকি খাবার খেতে দেখা যায়। আসলে হায়েনার চোয়ালে প্রচণ্ড শক্তি থাকলেও ওয়াইল্ডবিস্ট বা মহিষজাতীয় বড় প্রাণী শিকার করা ওদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। তাই এই চুরি পদ্ধতি অবলম্বন করে। তাই বলে সিংহ বা চিতাকে কিন্তু তারা ভয় পায় না। প্রায়ই দেখা যায়, একসঙ্গে সিংহের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে। এদের চোয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী। কামড় দিয়ে যেকোনো প্রাণীর হাড় ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। এদের পেটে থাকে শক্তিশালী হাইড্রোক্লোরিক এসিড। ফলে হাড়ও হজম হয়ে যায়।
উত্তর আমেরিকার বাদামি ভালুকের একটা উপপ্রজাতি হলো গ্রিজলি ভালুক। অনেকে এ দুটি ভালুককে একই মনে করে। যদিও তেমন কোনো পার্থক্য নেই এদের মধ্যে। কানাডায়ও এ ভালুক দেখা যায়। একটা আলাস্কান পুরুষ গ্রিজলি ভালুকের ওজন প্রায় ৩৮০ কেজি হয়। এদের রয়েছে ধারালো নখ। চোয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী। এতটাই যে মানুষের মাথার খুলি কামড়ে গুঁড়া গুঁড়া করে ফেলতে পারে।
মেরু ভালুক সাধারণত মেরু অঞ্চলেই দেখা যায়। হিমশীতল পরিবেশে বাঁচারা জন্য তারা একদম উপযোগী। এদের চামড়া অত্যন্ত পুরো ও সাদা। চামড়ার নিচে থাকে চর্বির পুরো স্তর। পুরুষ মেরু ভালুক ৬৮০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। তবে মেয়ে ভালুকের ওজন পুরুষের প্রায় অর্ধেক। ভালুকের মধ্যে এই প্রজাতি সবচেয়ে শক্তিশালী। তাদের বড় কাইনিন দাঁত ৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
আফ্রিকার বনে পাওয়া যায় গরিলা। এদের প্রায়ই শক্ত ডাল বা গাছের ছাল চিবাতে দেখা যায়। চোয়াল অত্যন্ত শক্ত বলেই তা সম্ভব হয়। এদের ওজন ২৭০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত বন্য পরিবেশে ৩৫-৪০ বছর বাঁচে। তবে এদের চোয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী হলেও এরা মাংসাশী নয়। সধারণত পাতা, গাছের ডালপালা, ফুল, ফল ও জলজ উদ্ভিদ খায়।
বাংলায় এদের ষাঁড় হাঙর বলে। এরা অন্যান্য হাঙরের তুলনায় লম্বা হয়। পুরুষ হাঙর গড়ে ৭ ফুট লম্বা ও প্রায় ৯০ কেজি ওজন হয়। তবে স্ত্রী হাঙরের ওজন হয় প্রায় ২৩০ কেজি ও লম্বায় ১২ ফুট। সাধারণত নদীর তীরবর্তী এলাকায় এদের বাস। মানুষকে আক্রমণ করার বদভ্যাস আছে এ হাঙরের। অন্য হাঙরের তুলনায় এদের দাঁতও বেশি থাকে। যেকোনো সময় এদের অন্তত ৩৫০টি দাঁত থাকে। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, সারা জীবনে এদের প্রায় ৫০ হাজার দাঁত গজায়। বারবার দাঁত ওঠে ও পড়ে।
জাগুয়ার বড় বিড়ালজাতীয় প্রাণী। বর্তমানে চারটি বাঘজাতীয় প্রাণীদের মধ্যে জাগুয়ার একটি। বাকি তিনটি হলো বাঘ, সিংহ ও চিতা। জাগুয়ারকে দেখতে চিতার মতোই লাগে। এদের গায়েও রয়েছে কালো ছোপ ছোপ দাগ। তবে অন্য তিনটির তুলনায় জাগুয়ার অনেক বড় ও বলিষ্ঠ হয়। এরা বিভিন্ন প্রকার মাছ, হরিণ, বানর, কুমিরসহ প্রায় ৮০ প্রজাতির প্রাণী শিকার করে। সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় এদের পাওয়া যায়। এরা কামড় দিয়ে কুমিড়ের মোটা চামড়া ছিড়ে ফেলতে পারে। কচ্ছপের শক্ত খোলস ছাতুর মতো হয়ে যায় তাদের কামড়ে।
আফ্রিকান তৃণভোজী স্তন্যপায়ী প্রাণী জলহস্তি। সাধারণত পানিতে নেমে জলজ উদ্ভিদ খায়। বেশিরভাগ সময় পানিতেই থাকে। এদের দুই পাশের বড় কাইনিন দাঁত প্রায় ৭১ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এখন পর্যন্ত জলহস্তির সবচেয়ে বড় কাইনিন দাঁতের রেকর্ড করা হয়েছে ১২২ সেন্টিমিটার। এমন বড় দাঁতের কামড় সহ্য করা যে কোনো প্রাণীর পক্ষে অসম্ভব। এরা মুখ হাঁ করতে পারে ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত। এই হাঁ-এর মধ্যে একটা রেসিং কার ঢুকে যেতে পারে অনায়েসে।
এরা পানিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। শিকার পেলে এক কামড়ে ভবলীলা সাঙ্গ করে। দক্ষিণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এদের পাওয়া যায়। এদের প্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে কুমির। ও হ্যাঁ, কুমির আর অ্যালিগেটরকে কিন্তু এক ভেবো না। এদের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। তা অন্য কোনো লেখায় আলোচনা করব। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা পরীক্ষা করে বলেছেন, এই অ্যালিগেটর যেকোনো ছোট ট্রাককে গুঁড়িয়ে ফেলতে পারে।
বিশ্বের বৃহত্তম জীবিত সরীসৃপ এই লোনা পানির কুমির। ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় এই কুমির পাওয়া যায়। উপকূলীয় এলাকার অল্প লবণাক্ত পানি ও নদীতে এদের বাস। উপকূলীয় এলাকার ম্যানগ্রোভ জলাভূমিও এই কুমির দেখা যায়। পুরুষ কুমির ৭ ফুট লম্বা ও ১ হাজার কেজি ওজন হতে পারে। এই প্রজাতির কুমিরকে জীবন্ত জীবাশ্মও বলা হয়। কারণ ১০ কোটি বছর ধরে এরা পৃথিবীতে এভাবে টিকে আছে।
নাইল কুমির মূলত নীল নদের কুমির। এদের আবার মানুষ-খেকো কুমিরও বলা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী চোয়াল এদের। এর চেয়ে শক্তিশালী কামড় আর কোনো প্রাণী দিতে পারে না। এরা ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ওজন হতে পারে প্রায় ১ হাজার কেজি পর্যন্ত। মূলত মিশরেই এ কুমির পাওয়া যায়। তবে কিছু কুমির যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও ২৪টি দেশে পাওয়া যায়। নাইল কুমির এতটাই শিকারী যে এদের এলাকা থেকে কোনো শিকার ফিরে আসতে পারে না। কোনো শিকার ধরতে কয়েক ঘণ্টা, দিন এমনকি সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করে।
সূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস