মাঝেমধ্যে চাঁদের রং কেন লাল হয়
রাতের আকাশে যখন হাজারো তারা জ্বলজ্বল করে, তখন তাদের সবার মাঝেও চাঁদ আলাদা করে নজর কাড়ে। কখনো চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি, কখনো চাঁদ যেন মায়ের মিষ্টিমুখ। প্রাচীনকাল থেকেই চাঁদ মানুষের কল্পনা, কাব্য আর ভালোবাসার প্রতীক। রবি ঠাকুরও 'জাগি রহে চাঁদ' কবিতায় একটুখানি কাব্য করেছেন—
'জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন সারাটি রজনী!
শ্রান্ত জগৎ ঘুমে অচেতন সারাটি রজনী!'
চাঁদ নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার অন্ত নেই। আজও চাঁদ আমাদের মুগ্ধ করে তার স্নিগ্ধ আলো আর নিঃশব্দ সৌন্দর্যে। মনে হয়, দূরে থেকেও কত আপন!
কখনো কখনো চাঁদ এমন এক রূপে ধরা দেয়, যা আমাদের তাক লাগিয়ে দেয়—অর্ধচন্দ্র বা পূর্ণচন্দ্র যেমন মনকাড়া, তেমনি এর লালচে রূপ যেন একেবারেই অন্য রকম! চাঁদ যখন এক অদ্ভুত লাল আভা ছড়ায়, তখন সেটা যেন কোনো অলৌকিক বলে মনে হয়। কিন্তু না, এতে ভয়ের কিছু নেই। এই 'ব্লাড মুন' বা 'রক্তিম চাঁদ'-এর পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
চলো এবার জানা যাক ব্লাড মুন আসলে কী, কেন চাঁদ লাল হয়, আর কত দিন পরই পরই-বা লাল চাঁদ দেখা যায় আকাশে।
রক্তিম চাঁদ বা ব্লাড মুন কী?
চাঁদ সাধারণত সাদা দেখালেও, কখনো কখনো এর রং লাল হয়ে যায় এবং তখন তাকে রক্তচাঁদ বা ব্লাড মুন বলা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, চাঁদ কখন লাল হয়?
রক্তিম চাঁদ হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। এই সময় চাঁদ পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে পুরোপুরি ঢুকে পড়ে, আর তখন চাঁদের রং লালচে হয়ে যায়।
কেন চাঁদ লাল হয়?
পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবী সূর্য ও চাঁদের মাঝে অবস্থান করে এবং পৃথিবীর ছায়া চাঁদের ওপর পড়ে। সরাসরি সূর্যের আলো চাঁদে পৌঁছাতে না পারলেও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে সূর্যের আলো বেঁকে (প্রতিসরণ) চাঁদের ওপর পড়ে। বায়ুমণ্ডল নীল রঙের আলো বেশি ছড়িয়ে দেয়, আর লাল রঙের আলো কম বিচ্ছুরিত হয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে পৌঁছায়। তাই চাঁদ লালচে দেখায়।
বায়ুমণ্ডলের ভূমিকা কী
সূর্যের রশ্মি বিভিন্ন রঙের (বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল) আলোর তরঙ্গ নিয়ে গঠিত।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সূর্যের আলোকে বিভিন্ন রঙে ভেঙে ছড়ায়। ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলো বেশি ছড়িয়ে যায়, আর বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল ও কমলা আলো কম ছড়িয়ে পড়ে এবং বায়ুমণ্ডলের মাধ্যমে বেঁকে চাঁদের ওপর পড়ে। বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণা ও দূষণের মাত্রার ওপরও চাঁদের লাল রঙের তীব্রতা নির্ভর করে।
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ বিরল কোনো ঘটনা নয়, তবে সব সময় যে এটা ঘটে থাকে, বিষয়টি সে রকম নয়। এক দশকে কয়েকবার পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী ব্লাড মুন ঘটবে ২০২৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, তবে এটি কেবল এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপ ও আফ্রিকার কিছু অংশ থেকে দেখা যাবে।
ইউনিভার্সিটি অব টলেডোর পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের খ্যাতনামা প্রভাষক জিলিয়ান বর্নাক বলেন, 'যখন পৃথিবী সূর্যের আলো আটকে দেয়, তখন মনে হয় চাঁদ সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢেকে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না, কারণ সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে একটু বেঁকে চাঁদের গায়ে পড়ে। এই আলোতে লাল রং বেশি থাকে, তাই চাঁদকে রক্তচাঁদের মতো লালচে দেখায়। এর মূল কারণ হলো আমাদের বায়ুমণ্ডল।'
ব্লাড মুন কতটা লাল হয়?
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের রং সাধারণত রক্তলাল নয় বরং গাঢ় কমলা ধরনের হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রতিটি পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণে এই রঙের ছায়া কিছুটা ভিন্ন হয়, কারণ প্রতিবার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সামান্য বদলে থাকে।
জিলিয়ান বর্নাক বলেন, 'এই রঙের পরিবর্তনের মানে হলো, বিজ্ঞানীরা প্রতিটি চন্দ্রগ্রহণকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একটি ঝলক হিসেবে ব্যবহার করেন।'
অন্যদিকে 'আকুওয়েদারের' একজন আবহাওয়াবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ব্রায়ান লাডা মনে করেন, 'আকাশে দূষণ, মেঘ, ধুলাবালু বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে নির্গত কণাগুলোর মতো বিষয় এই রঙে প্রভাব ফেলে।'
পরবর্তী ব্লাড মুন কবে?
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ বিরল কোনো ঘটনা নয়, তবে সব সময় যে এটা ঘটে থাকে, বিষয়টি সে রকম নয়। এক দশকে কয়েকবার পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের ঘটনা ঘটে। পরবর্তী ব্লাড মুন ঘটবে ২০২৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, তবে এটি কেবল এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপ ও আফ্রিকার কিছু অংশ থেকে দেখা যাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে পরবর্তী ব্লাড মুন দেখা যাবে ২০২৬ সালের ৩ মার্চ। এরপর আবার ব্লাড মুন দেখার জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৯ সালের ২৬ জুন পর্যন্ত!
সূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট