কাউকে যদি আচমকা প্রশ্ন করা হয়, কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো? মা নাকি বাবাকে? তাহলে অনেকেই থতমত খেয়ে যায়। অবশ্য কেউ ঝটপট উত্তর দেয়—মাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আবার বাবাকে বেশি ভালোবাসার দলের মানুষেরও অভাব নেই। অনেকে কুটনীতিকদের মতো দুজনকেই সমান ভালোবাসার কথা বলে।
আসলে সন্তান লালন-পালনে বাবা-মা দুজনের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের ভালোবাসা নিয়ে কোনো তুলনা চলে না। শিশু মায়ের কাছে আদর আর ভালোবাসা নিয়ে সন্তান বড় হয়। পাশে ছায়ার মতো আশ্রয় দেন বাবা। কারও কারও ধারণা, সাধারণত সন্তানদের জন্য মায়ের মতো আত্মত্যাগ বাবারা করেন না। তবে জীবজগতে ব্যতিক্রমের অভাব নেই। মায়ের মতো আত্মত্যাগী এসব বাবারা সেরা বাবাদের জায়গা দখল করেছে। বাবা দিবসে এরকম কয়েকজন বাবার কথা স্মরণ করা যাক।
প্রাণীজগতে সেরা বাবাদের পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকলে প্রথম পুরস্কার জুটতো সাগরের ক্যাটফিসের। কারণ প্রাণিজগতে এমন আত্মত্যাগী বাবা খুব একটা দেখা যায় না। মাগুর মাছের মতো দেখতে মা ক্যাটফিসরা একবারে প্রায় ৫০টির মতো ডিম পাড়ে। ডিম পেড়েই মা ক্যাটফিসের দায়িত্ব মোটামুটি শেষ। এরপরের দায়িত্ব কাঁধে নয়, আক্ষরিক অর্থেই ‘মুখে’ তুলে নেয় বাবা ক্যাটফিস। শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে ছোট ছোট স্বচ্ছ ডিমগুলো মুখে নিয়েই সে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে একটানা প্রায় দুমাস মুখের মধ্যেই থাকে ডিমগুলো। ততদিন তার খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলেই কিছুটা মুক্তি পেলেও তার দায়িত্ব শেষ হয় না। কারণ বড় না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চাদের শিকার ধরা, আত্মরক্ষা শেখানো আর দেখাশোনার দায়িত্বও বাবা ক্যাটফিসের।
ক্যাটফিসের মতো আরেক দায়িত্ববান বাবা থাইল্যান্ডের বেট্টা মাছ। স্বাদুপানির এ মাছের আরেক নাম সিয়ামিজ ফাইটিং ফিস। নাম শুনেই বুঝতে পারছো, এরা ফাইটিং বা মারামারিতে ওস্তাদ। তবে শত্রুর জন্য হিংস্র হলেও সন্তানদের কাছে বাবা বেট্টার তুলনা নেই। মা বেট্টা মাছ ডিম পাড়ার পর সেগুলো মুখে রাখে বাবা। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে তাদের নিরাপদ আস্তানায় রেখে লালন-পালন করে। একইসাথে শত্রুদের কাছ থেকে সন্তানদের রক্ষা করে।
প্রায় একই ধরনের কষ্টকর কাজ করে দক্ষিণ আফ্রিকার বুলফ্রগ। এ ব্যাঙের আরেক নাম ডারউইন ফ্রগ। মা ব্যাঙ ডিম পাড়লে বাবারা তার দায়িত্ব মুখে তুলে নেয়। এই ব্যাঙদের বেশ খাই খাই স্বভাব। মুখের কাছে কিছু পেলেই সেগুলো খাওয়ার চেষ্টা করে। অথচ অবাক ব্যাপার, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রেখে ছোট ছোট প্রায় ছয় হাজার ডিম নিয়ে একটানা ছয় সপ্তাহ কাটিয়ে দেয় বাবা ব্যাঙ। ডিম ফুটে ছানা হলে সেগুলো বমি করে বাইরে বের করে দেয়।
ক্যাটফিস আর ডারউইন ফ্রগের মতো ডিম পেড়ে দায়িত্ব শেষ করে মা ঘোড়ামাছ। এরপর ডিমগুলো তা দেয়া আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বাবা ঘোড়ামাছের। তবে মুখে নয়, ডিম রাখার জন্য তাদের রয়েছে বিশেষ এক ধরনের থলে। ডিম ফুটে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত এই থলেতেই ডিম বয়ে বেড়ায় বাবা ঘোড়ামাছ। ৪৫ দিন পর বাচ্চা ফোটার পরও তাদের দেখেশুনে রাখে বাবা। প্রাণিবিদদের মতে, পুরুষ হয়েও প্রায় সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা পায় বাবা ঘোড়ামাছ।
সন্তানের জন্য বেশ কষ্ট স্বীকার করে দক্ষিণ মেরুর বাবা পেঙ্গুইনরাও। পেঙ্গুইনদের ১৭ প্রজাতির মধ্যে একটির নাম এমপেরর পেঙ্গুইন। ডিম পাড়তে গিয়ে মা পেঙ্গুইনরা অনেকদিন না খেয়ে থাকায় তাদের শরীর শুকিয়ে যায়, শক্তিও প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই ডিম পেড়েই খাওয়ার সন্ধানে টানা দুমাসের জন্য সাগরে ছুটে যায় মা। তাহলে ডিমের কী হবে! চিন্তা নেই, সেজন্য আছেন বাবা পেঙ্গুইন। হিমশীতল বরফে টানা দুমাস ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে কোলের মধ্যে নিয়ে ডিমে তা দেয় বাবা। খাওয়ার জন্য নড়াচড়ার উপায় নেয় তাদের। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে মেরুঝড়সহ সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাবা। সাগর থেকে মা ফিরলে তবেই মুক্তি মেলে বাবা পেঙ্গুইনের।
সেরা বাবাদের তালিকায় আরও আছে দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট বানর মারমাসেট। সন্তানদের কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়ানো, খাবার জোগাড় করা কিংবা নিরাপত্তার দায়িত্ব বাবা মারমাসেটের। ভারতের শেয়ালরাও বাবা হিসেবে দায়িত্ববান। সন্তান জন্মের পর মা শেয়াল দুর্বল থাকে। এসময় খাবার জোগাড় আর আস্তানার নিরাপত্তার দায়িত্ব বাবা শেয়ালের। আবার সন্তানদের শিকার আর সহবত শেখানোর দায়িত্বও বাবা শেয়ালের। ঠিক একইরকম দায়িত্ব পালন করে নেকড়ে বাবারা। উটপাখির মতো দেখতে দক্ষিণ আমেরিকার পাখি রিয়া। ডিম ফুটে ছানা বের হলে বড় না হওয়া পর্যন্ত তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব বাবা রিয়া পাখির।