শ্রেয়ার ফেরা

করোনার সঙ্গে বসবাসের প্রায় আড়াই বছর হতে চলল। টিকার কল্যাণে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছি আমরা। তবে ২০২০ সালে করোনাকালের শুরুটা ছিল ভয়াবহ। ঘরবন্দী দুর্বিষহ দিনগুলো পেছনে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে সবাই। শ্রেয়ার গল্পটাও ঘুরে দাঁড়ানোর, শরীর ও মনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার।

ঘরবন্দী ও অদ্ভুত দিনকাল

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শ্রেয়া গোলদারের স্কুলজীবন কেটেছে খুব সুন্দর। সব সময় ক্লাসে প্রথম স্থানটা ছিল শ্রেয়ার দখলে। শুধু পড়ালেখায় নয়, সাংস্কৃতিক ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে তার পুরস্কারের তালিকা বেশ লম্বা। সে সময় পড়ালেখার পাশাপাশি গানবাজনা, আবৃত্তি, আঁকিবুঁকি, খেলাধুলা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত শ্রেয়া। এত এত ব্যস্ততার মধ্যেই সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় ২০২০ সালে। পরীক্ষার পর শুরু হয় লম্বা ছুটি। তবে সেই ছুটিতে পানি ফেলে দেয় করোনাভাইরাস। সবার মতো ঘরবন্দী হয়ে পড়ে শ্রেয়া। ধীরে ধীরে শুরু হয় বিরক্তিকর দিনকাল।

বাসায় শ্রেয়ার লম্বা সময় কাটতে লাগল ঘুমিয়ে। বাকি সময়টা মুঠোফোন কিংবা ল্যাপটপে। একই রুটিনে ঘরবন্দী হয়ে কাটতে লাগল মাসের পর মাস। বেশ কয়েক মাস পর কলেজে ভর্তির সময় এলেও ক্লাসসহ সবকিছুই অনলাইনে চলতে লাগল। তাই শ্রেয়া তখনো ঘরবন্দী। কলেজে ভর্তির পর সারাটা দিন কেটে যেত অনলাইন ক্লাস আর পড়াশোনার মধ্যে।

শ্রেয়ার আকাশ দেখা হতো না, গায়ে রোদটাও লাগত না। প্রায় এক থেকে দেড় বছর ঘরবন্দী থাকার প্রভাবটা ছিল ব্যাপক। শ্রেয়ার ওজন বেড়ে যায় অনেক। সঙ্গে বাড়তে থাকে চোখের চশমার পাওয়ারও। ধীরে ধীরে বিষণ্নতা ঘিরে ধরছিল তাকে।

তত দিনে খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সব সময় ক্লাসে প্রথম হওয়া শ্রেয়া কলেজের প্রথম পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফেল করে বসে। মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়ে সে। কলেজ থেকে বাসা অনেক দূরে হওয়ায় তত দিনে যশোরের ক্যান্টনমেন্ট কলেজের হোস্টেলে থাকতে শুরু করেছে শ্রেয়া। একটা সময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। টানা ছয় মাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় আটকে গিয়েছিল জীবন। তবে সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাবটা পড়েছিল শ্রেয়ার মানসিক স্বাস্থ্যে। অসুস্থ শ্রেয়ার পরের পরীক্ষার ফলাফলটাও ভালো হলো না। খারাপ ফলাফল, শারীরিক অসুস্থতা, একা একা নতুন জায়গায় থাকা—সব মিলিয়ে প্রায় ভেঙে পড়েছিল শ্রেয়া।

ভালো দিনের গল্প

অসুস্থতা ও বিষণ্নতার মধ্য দিয়ে জীবনের সবচেয়ে বাজে সময়টা কাটাচ্ছিল শ্রেয়া। তবু একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে যেতে হচ্ছিল। পরীক্ষার মধ্যেই ‘জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০২২’–এর নোটিশ এল। স্কুলের সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে করে ক্ষীণ আশায় ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী’ বিভাগে সেদিন নাম দিয়ে দিল শ্রেয়া।

অধ্যক্ষের কাছ থেকে ডাক এল। কলেজের রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় কোনোভাবেই তিনি শ্রেয়াকে ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী’ বিভাগে প্রতিযোগিতা করতে দিতে রাজি নন। তবে সর্বশেষ পরীক্ষার ভালো ফলাফল ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে শ্রেয়ার নম্বর সবচেয়ে বেশি ছিল বলে যশোরের ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী’ নির্বাচিত হয় শ্রেয়া। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার শর্তে কলেজ থেকে উপজেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করার অনুমতি পায় সে।

বাকি গল্পটা অর্জনের। সদর উপজেলা ও জেলা পর্যায় জয় করে খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীর স্বীকৃতি পেয়ে যায় শ্রেয়া। জাতীয় পর্যায়ে এক নম্বরের জন্য ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী’র তকমাটা ছুটে যাওয়ায় ঢাকায় এসে শ্রেয়া কোনো পুরস্কার পায়নি। তবে নিজেকে প্রমাণের এই যাত্রা শ্রেয়ার জন্য ছিল অসামান্য!

প্রথমে ভরসা রাখতে না পারলেও শ্রেয়ার এই সাফল্যের পর বেশ খুশি হয়েছেন কলেজের অধ্যক্ষ। স্যারের কাছ থেকে উপহারও পেয়েছে শ্রেয়া। নতুন কলেজে অল্প কিছু বন্ধু হয়েছে তার। জুনিয়র বন্ধুর সংখ্যাই বেশি। বন্ধুরাও তার অর্জনে খুব খুশি। শ্রেয়ার কঠিন সময়ে সব সময় পাশে ছিলেন মা–বাবা। এই ফিরে আসা শুধু শ্রেয়া নয়, তার মা-বাবার জন্যও ছিল স্বস্তির।

পুরোপুরি অসুস্থতা না কাটলেও একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠছে শ্রেয়া। বিষণ্নতা ও অসুস্থতা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে সে। স্কুলশিক্ষক মা–বাবা কখনোই ভরসা হারাননি মেয়ের ওপর থেকে। তাই নিজের সবচেয়ে বড় শক্তি মা-বাবাকেই মনে করে শ্রেয়া। বর্তমানে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছে সে। কলেজের পরীক্ষায় এখন বেশ ভালো ফলাফল করছে শ্রেয়া। সামনেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায় সে। তবে সবকিছুর আগে শ্রেয়া একজন ভালো মানুষ হতে চায়।

শ্রেয়ার যত অর্জন

২০১৪

  • আন্তপ্রাথমিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

২০১৫

  • জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় ভাবসংগীতে জেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

২০১৬

  • জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় নজরুলগীতি ও পল্লিগীতিতে জেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় ও চিত্রাঙ্কনে বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

  • জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে লোকসংগীতে বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

২০১৭

  • জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় ভাবসংগীতে জেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

২০১৮

  • জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় পল্লিগীতিতে বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

  • জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে লোকসংগীতে জেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

  • জাতীয় নজরুল সম্মেলন নড়াইলে রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন।

২০১৯

  • জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্রসংগীত, ভাবসংগীত ও লোকসংগীতে জেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন।

  • জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে নড়াইল জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী।

  • গণিত উৎসবে আঞ্চলিক পর্যায়ে সেকেন্ড রানারআপ হয়ে জাতীয় উৎসবে অংশগ্রহণ।

এ ছাড়া বিতর্ক প্রতিযোগিতা, উপস্থিত বক্তৃতা, কুইজ প্রতিযোগিতায় আছে আরও অনেক পুরস্কার।