আইনস্টাইন মোটেই ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলেন না!

আইনস্টাইন ভালোবাসতেন সাইকেল চালাতে। ছবিটি যুক্তরাস্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারায় তোলা

ছোটবেলায় যখনই কেউ অঙ্কে ভালো করে বা বিজ্ঞানে তার প্রতিভা দেখায়, তখনই বেশির ভাগ লোক তাকে ‘ছোট্ট আইনস্টাইন’ বলে ডাকে। আর একটু বড় হলে, বিশেষ করে হাইস্কুলে বা কলেজে অনুরূপ ক্ষেত্রে সেটি হয় ‘তরুণ আইনস্টাইন’। কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের বেশির ভাগ বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের আইনস্টাইন বানাতে চান! কেন?

জবাবটা সোজা। জার্মান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন দুনিয়া (Universe), সময় (Time) ও স্থান (Space) সম্পর্কে আমাদের হাজার বছরের ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন। এই সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মনে করেন, কোনো একদিন আসবে, যখন সময়ের কিংবা দুনিয়ার সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখে ফেলা যাবে চার পৃষ্ঠায় এবং তার তিন পৃষ্ঠা জুড়ে থাকবে কেবল আইনস্টাইনের নাম!

কাজেই সব বাবা-মা যদি তাঁদের সন্তানকে এমন একজন ব্যক্তির মতো বানাতে চান, তাহলে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না।

একমাত্র ছোট বোন মারিয়ার সঙ্গে ছোট্ট আইনস্টাইন। ১৮৮৫ সালে তোলা ছবি

আইনস্টাইনের সাদা চুলের যে ছবিটা আমরা দেখি, সেখানে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত চোখের উপস্থিতি সহজে টের পাওয়া যায় এবং সেখান থেকে সহজে বিশ্বাস করা যায় যে, ছোট বয়সে আইনস্টাইন আসলেই ‘আইনস্টাইন’ ছিলেন। মানে, ক্লাসের তুখোড় ছেলে, বিজ্ঞান আর গণিতে ফাটাফাটি অবস্থা, ক্লাসে সবার আগে যেকোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, স্কুলে না গেলে চিন্তিত স্যাররা তার খোঁজ নেওয়ার জন্য বাড়িতে চলে আসছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ঘটনা কি আসলেই তা ছিল?

গণিতের রাজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা হলো পাই (৩.১৪...)। মার্কিন রীতিতে মার্চের ১৪ তারিখকে লিখলে সেটি পাই এর মান প্রকাশ করে বলে ১৪ মার্চকে আমরা এখন পাই দিবস বলি। সেই ১৪ মার্চ ১৮৭৯ সালে জার্মানির উলম শহরে হারম্যান আর পাউলিনের ঘরে অ্যালবার্টের জন্ম। সে সময় অ্যালবার্টের বাবা হারম্যান একটা চাকরি করতেন, কিন্তু অচিরেই চাকরি খুইয়ে তাঁদের চলে যেতে হয় মিউনিখ শহরে, যেখানে আইনস্টাইনের একমাত্র ছোট বোন মারিয়ার জন্ম। মিউনিখেই কেটেছে আমাদের আইনস্টাইনের ছোটবেলা।

জন্মের সময়ই আইনস্টাইন বেশ নাদুসনুদুস। পাউলিন এ কারণে তাঁকে নিয়ে একটু সংশয়ে ছিলেন। দেখা গেল, আইনস্টাইন কথা বলতে পারেন না সহজে। শব্দের পর শব্দ সাজানোতে তাঁর প্রাণান্তকর অবস্থা হয়। এর মূল কারণ ছিল, বলার জন্য শব্দ খুব সহজে খুঁজে পেতেন না আলবার্ট। তবে তিনি মোটেই তোতলা ছিলেন না!

E=mc2 আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্রগুলোর একটি

স্কুল শুরু করার আগে, চার বা পাঁচ বছর বয়সে আলবার্টের বাবা তাঁকে একটি কম্পাস উপহার দেন। এটি ছিল আইনস্টাইনের জন্য খুবই কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার। কারণ, যেখানে, যেভাবে রাখা হোক না কেন, কম্পাসের কাঁটা সব সময় উত্তর দিকে মুখ করে থাকে!!!

ছয় বছর বয়সে মিউনিখে একটি স্কুলে যেতে শুরু করেন আলবার্ট এবং তাঁর মায়ের ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে ক্লাসে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকেন। একে ঠিকমতো কথা বলতে না পারা, দ্বিতীয়ত কোনো বিষয়েই ঠিকমতো তৈরি হতে না পারা—দুটোই স্কুলে ট্রেডমার্ক হয়ে যায়। স্কুলের শিক্ষকেরা আলবার্টকে মোটেই পছন্দ করতেন না। এমনকি কোনো কোনো স্যার তাঁকে ক্লাস থেকে বের করে দিতেন। কারণ, বলার মতো কোনো সাফল্য তাঁর ছিল না। আইনস্টাইন খালি ভাবতেন, স্কুল না থাকলে কী হয়! ঠিকমতো কথা বলতে পারতেন না বলে চুপচাপ আলবার্টের স্কুলে কোনো বন্ধু ছিল না। বাসায় ফিরে তাসের ঘর সাজানো আর মারিয়ার সঙ্গে খেলে আর গল্প করে আইনস্টাইন বড় হতে থাকেন।

নয় বছর বয়সে মূল স্কুলে আসার পরও স্কুলের পড়ালেখায় তাঁর তেমন উন্নতি হয়নি। বরং স্কুলের লেফট-রাইট আর মিলিটারি ট্রেনিং তাঁকে আরও সন্ত্রস্ত করে তোলে। তবে এর ফাঁকে তাঁর বিজ্ঞান ও বিশেষ করে, গণিতে আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। এর কারণ ছিল দুটি। আলবার্টের কাকা দেখা হলেই আলবার্টকে একটি গাণিতিক ধাঁধা জিজ্ঞেস করতেন, আর তার উত্তর খুঁজতে আলবার্ট যথেষ্ট আনন্দ পেতেন। সমাধান ঠিক হলে আলবার্ট পেতেন কাকার কাছ থেকে গণিত আর বিজ্ঞানের বই উপহার। আর দ্বিতীয় কারণ হলো, তাঁদের পারিবারিক বন্ধু, মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ম্যাক্স তামুদ। ম্যাক্স প্রতি বৃহস্পতিবার তাঁদের সঙ্গে ডিনার করতেন। ম্যাক্স আলবার্টের জন্য জনপ্রিয় বিজ্ঞান আর দর্শনের বই নিয়ে আসতেন। এগুলো পড়ে  ব্যাপক আনন্দ পেতেন আলবার্ট। ম্যাক্সই তাঁকে একটি জ্যামিতির বই দেন, যা আলবার্টকে অনেক কিছু নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। ম্যাক্সের দেওয়া বিজ্ঞানের একটি বইতে একটি এক্সপেরিমেন্ট ছিল এ রকম: লেখক টেলিগ্রাফ তারের ভেতর দিয়ে যে বিদ্যুৎ যাচ্ছে, সেটার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করছে! ১৪ বছরের আইনস্টাইন ভাবতে শুরু করলেন, আচ্ছা যদি আলোর রথে চড়ে বেড়ানো যায়, তাহলে আলোর রথটা কি থেমে থাকবে? নাকি চলতে থাকবে?

জার্মানির বার্লিনে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E=mc2 এর ভাস্কর্য। চার মিটার উঁচু এ ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়েছিল ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে ‘ওয়াক অব আইডিয়া’ সিরিজের আওতায়

ম্যাক্সই আলবার্টকে উচ্চতর গণিতের বিভিন্ন বইপত্র পড়তে দেন। এর মধ্যে ক্যালকুলাসের প্রতি আলবার্টের আকর্ষণ তৈরি হয় এবং ১২ বছর বয়স থেকে ক্যালকুলাস শেখার চেষ্টা করেন। বলা বাহুল্য, এসবের সঙ্গে স্কুলের পড়ালেখার কোনো মিলই ছিল না।

এর মধ্যে কাকা আর বাবা মিলে কোম্পানি লাটে তুলে ১৮৯৪ সালে আলবার্টদের ফ্যামিলি ইতালির মিলানে চলে যায়। পড়ালেখা শেষ করার জন্য আলবার্টকে রেখে যাওয়া হয় মিউনিখে। কিন্তু একে স্কুলের পড়ালেখায় অনীহা, তার ওপর সামরিক কায়দাকানুন—এসবের কারণে আলবার্ট স্কুল ছাড়ার চেষ্টা করতে থাকেন এবং ছয় মাসের মাথায় একজন ডাক্তারকে  রাজি করিয়ে ‘অসুস্থতার’ সার্টিফিকেট জোগাড় করেন। আর তা দিয়ে মেলে স্কুল থেকে ছুটি। স্কুলের পড়া শেষ না করেই বাবা-মায়ের কাছে আলবার্টের চলে যাওয়া।

মজা করতে ভালোবাসতেন আইনস্টাইন

স্কুল ছাঁটাই হওয়া আলবার্টকে নিয়ে তাঁর বাবা-মায়ের উদ্বিগ্নতা বিশেষ মাত্রা পায়। কারণ, তখন হাইস্কুল পাস না হলে কোথাও ভর্তি হওয়া যেত না। পরে তাঁর বাবা-মা খুঁজে বের করেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের ফেডারেল পলিটেকনিক স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করলে ভর্তি হওয়া যায়। কাজেই আইনস্টাইন সেখানে ভর্তি পরীক্ষা দেন এবং সাফল্যের সঙ্গে প্রায় সব বিষয়ে ফেল করেন। কিন্তু ম্যাক্সের বিজ্ঞান আর গণিতের বই এবং মেন্টরশিপের কারণে গণিত আর পদার্থবিজ্ঞানে যথেষ্ট ভালো নম্বর পান। পলিটেকনিকের নিয়ম ভঙ্গ করে কর্তৃপক্ষ তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে সুযোগ দিতে রাজি হয়। শর্ত হলো, আলবার্টকে প্রথমে হাইস্কুল শেষ করতে হবে। পাশের আরাউ শহরে জস্ট উইনটেলারের বিশেষ স্কুল থেকে আইনস্টাইন ১৭ বছর বয়সে গ্র্যাজুয়েট হয়ে জুরিখ পলিটেকনিকে ফেরত আসেন।

সেখানকার বন্ধুবান্ধব কিংবা প্রফেসরদের সঙ্গে আলবার্ট আইনস্টাইনের সখ্য, বিরোধের গল্পও বেশ চিত্তাকর্ষক। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।

আপাতত কোনো বন্ধুকে ইয়াং আইনস্টাইন ডাকার আগে মনে রেখো, আইনস্টাইন মোটেই ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলেন না!