একজন স্বপ্নবাজ দার্শনিকের জন্মদিনে...

লিভারপুলে সে রাতে ব্ল্যাক আউট।

শহরজুড়ে টানটান টেনশন। এই ডামাডোলের ভেতরেই জুলিয়া স্ট্যানলির কোলজুড়ে জন্ম নিল ছোট্ট এক দেবশিশু। সময়কাল ১৯৪০ সালের ৮ অক্টোবর।

একটু বড় হয়ে খালা ম্যারি মিমি স্মিথের বাড়িতে শৈশব-কৈশোরের অপাপবিদ্ধ দিনগুলো কেটে গেল হেসেখেলে। গ্রামার স্কুল কোনোমতে পেরিয়ে লিভারপুল কলেজ অব আর্টে ভর্তি হলেও দলছুট মন নিয়ে চার দেয়ালে বন্দী হতে কী ভালো লাগে! না হওয়া যায়!

কলেজ ছেড়ে দিয়ে ছেলেটা তাই সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে ওঠে। কথা আর সুরের অদৃশ্য কথোপকথনে সমর্পিত হয়। এসব দেখেই বোধ করি ম্যারি একটা নতুন গিটার উপহার দেয় ছেলেটাকে। গিটার হাতে তুলে বলে ওঠে—

‘দেখো বাপু, গিটার শখে বাজাও ঠিক আছে, কিন্তু গান করে জীবন যাপন করার কথা চিন্তাও কোরো না।’

মায়ের সঙ্গে ছোট্ট জন লেনন

স্মিত হেসে ছেলেটা গিটারে মন দেয়। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তখন উইনস্টন চার্চিল। তাঁর নামে মিল রেখেই জন্মের সময় ছেলেটার নাম রাখা হয়েছিল জন উইনস্টন লেনন। হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় জন লেনন। দ্য বিটলসের জন লেনন।

১৯৫৭ সালের ৬ জুলাই। এই দিনটার কথা আলাদা করে হয়তো কোথাও লেখা হবে না; কিন্তু সংগীত ইতিহাসে অবশ্যই একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে এই দিনটা। এই দিনেই চার্চের এক অনুষ্ঠানে আরেক বন্ধুর সুবাদে পল ম্যাকার্টনির সঙ্গে পরিচয় হয় লেননের। তারপর শুরু হয় এক সফল পথপরিক্রমা।

স্কুলে থাকতে লেননের সঙ্গে বন্ধুতা ছিল জর্জ হ্যারিসনের। দুজনে মিলে বাড়ির গ্যারাজে দ্য কোয়ারি মেন নামে ব্যান্ড গঠন করেন। ম্যাকার্টনি আর রিঙ্গো স্টার এসে যোগ দেন তাঁদের সঙ্গে। সেই কোয়ারিমেন থেকেই জন্ম হয় বিটলসের। অবশ্য বিটলস নামটা চূড়ান্ত হওয়ার আগেও নাম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে অনেক। যেমন দ্য সিলভার বিটলস। কিন্তু শেষতক বিটলস নামটাই মনে ধরে সব সদস্যের। ব্যাস, সেই বিটলস নামটাই স্থায়ী হয়ে যায় সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে।

লিভারপুল শহরে অল্প অল্প পরিচিতি পেতে শুরু করে চার তরুণের ব্যান্ড দ্য বিটলস। বলাই বাহুল্য, শুরু থেকেই বিটলসের প্রাণপুরুষ জন লেনন। পল ম্যাকার্টনি অনেক পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ব্যান্ডের কোনো নতুন গানের শুরু থেকে যেকোনো সিদ্ধান্তে আমরা জনের দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। ও–ই ছিল আমাদের ভেতর বয়োজ্যেষ্ঠ আর সবচেয়ে মেধাবী।’

কালজয়ী বিটলস ব্যান্ডের সদস্যরা

জন লেনন। এক অসাধারণ গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী আর সর্বোপরি মানবতাবাদী একজন দার্শনিক। একজন স্বপ্নবাজ মানুষ।

জন লেনন আর বিটলস তত দিনে সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধীরে ধীরে ব্রিটেন ছাড়িয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা বিটলসের। আমেরিকায়ও তখন বিটলস ম্যানিয়া শুরু হয়ে গেছে পুরোদমে। ‘অল ইউ নিড ইজ লাভ’, ‘স্ট্রবেরি ফিল্ডস ফরেভার’ কিংবা ‘হেই জুড’ তখন সংগীতে নতুন এক মেরুকরণ এনে দিয়েছে। যেখানেই কনসার্ট করতে যান, ভক্তরা পাগলপারা হয়ে যান এই চার তরুণকে দেখলেই। সে এক উন্মাদনাই বটে!

ষাটের পুরো দশক বিটলসের জয়যাত্রা। ১৯৬৫–তে রিলিজ হওয়া ইয়েস্টারডে, ১৯৬৭–তে ম্যাজিক্যাল মিস্ট্রি টুর অ্যালবামের ‘অল ইউ নিড ইজ লাভ’সহ একের পর এক গান হিট হতে থাকে আর বিলবোর্ড চার্টের শীর্ষে পৌঁছে যায় তরতর করে।

১৯৬৪ সালের আমেরিকা সফরের কথা আলাদা করে বলতে হয়। বিপুল সংবর্ধনায় ভেসে গিয়ে বিটলস দুদিন টিভি শো করে সেখানে। প্রায় ৭৪ মিলিয়ন দর্শক উপভোগ করে সেই টিভি শো। ব্যান্ড ইতিহাসে অন্যতম সফল শো। জন লেনন তখন গান লেখা, সুর করা বা গিটারে ধুন তোলার মধ্যগগনে। তবু কোথায় যেন আবার সেই দলছুট হওয়ার টংকার বাজতে থাকে অন্তরে, অন্তর্গহিনে। ভাঙনের ঢেউ এসে লাগে উজানে।

স্ত্রী ইওকো ওনোর সঙ্গে জন লেনন। দুজন মিলে গঠন করেন প্লাস্টিক ওনো ব্যান্ড। যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন দুজনই। এই ব্যান্ডের ব্যানারেই রিলিজ হয় সাড়া জাগানো গান ইমাজিন

বিটলস বোধ করি সংগীত ইতিহাসে সবচেয়ে কম স্থায়িত্বের এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় আর ব্যবসাসফল ব্যান্ড। চার তরুণ তুর্কির সেই জনপ্রিয় বিটলস ভেঙে যায় ১৯৭০–এ এসে। তত দিনে জন লেননের সৃষ্টিশীল মন খুঁজে নিয়েছে কথা আর সুরের প্রান্ত থেকে প্রান্তর। যুদ্ধবিরোধী নানা সভা-সমিতিতে তখন জনের শান্ত কিন্তু দঢ়চেতা উপস্থিতি। সমমনা জাপানি নারী ইওকো ওনোর সঙ্গে এ পর্যায়ে নিবিড় বন্ধুত্ব হয় জনের। ইওকো ওনো ছিলেন জনের মতোই মেধাবী। ধীরে ধীরে দুজনের সেই বন্ধুত্ব একসময় গড়ায় পরিণয়ে। ১৯৬৯ সালের ২০ মার্চ বিয়ে করেন জন আর ওনো।

দুজন মিলে গঠন করেন প্লাস্টিক ওনো ব্যান্ড। তার কিছু আগ দিয়ে সিঙ্গেলস হিসেবে রিলিজ করেন আরেক কালজয়ী সৃষ্টি ‘গিভ পিস আ চান্স’। ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে তখন সারা বিশ্ব উত্তাল। ওনোকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন জন লেনন। গিভ পিস আ চান্স সেই সময়ে ‘Anti Vietnam war anthem song’ হিসেবে ঝড় তোলে সারা বিশ্বে। স্বভাবতই যুদ্ধবাজ আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্ষুশূল হন লেনন।

কিন্তু জন লেনন তো শিল্পী, দার্শনিক। আপন মনে সৃষ্টি করে যেতে থাকেন গান। সৃষ্টি হয় আরেক কালজয়ী গান ‘ইমাজিন’।

প্লাস্টিক ওনো ব্যান্ডের ব্যানারে ১৯৭১–এ আসে ইমাজিন অ্যালবাম। তত দিনে জন আর ওনো দুজনে মিলে বাসা বেঁধেছেন আমেরিকায়। আর শিল্পী–সত্তা ছাপিয়ে অ্যাকটিভিস্ট হয়েছেন। এমনই যে, নিক্সন সরকার জন লেননের অনমনীয় মনোভাব আর জনপ্রিয়তাকে রীতিমতো ভয় পেতে শুরু করে। বেশ কয়েকবার দেশ থেকে বিতাড়িত করার অপচেষ্টাও নেয়। কিন্তু সেসব ধূলিসাৎ হয়ে যায় জন লেননের স্মিত হাসিমুখের কাছে, আদর্শের কাছে। জন আর ওনো নানা উত্থান–পতনে কাজ করে যেতে থাকেন একসঙ্গে।

লিভারপুলে রয়েছে জন লেনন মিউজিয়াম

ইমাজিন রিলিজ হওয়ার পর এই গানটা এত জনপ্রিয়তা পায় যে এখনো যুদ্ধবিরোধী থিম সং হিসেবে জন লেননের কথা সুর আর কণ্ঠের এই গানটাকেই বেছে নেয় মানুষ। কী যে অদ্ভুত এক শান্ত বিষাদ ছড়িয়ে আছে এর পরতে পরতে। না শুনলে বা লিরিক না পড়লে কোনোভাবেই অনুধাবন করা যাবে না।

শান্তির বারতা পৃথিবীকে তবু আলিঙ্গন করে না। ঘটে যায় দুর্ঘটনা।

১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখ। রাত ১০টা। স্টুডিও থেকে ফিরে ওনো ততক্ষণে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে গেছেন। জন লেনন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছু কী ভাবছিলেন একা? নাকি অপেক্ষা করছিলেন আততায়ীর রূপে মৃত্যুকে স্বচক্ষে দেখবেন বলে!

খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আসে মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান নামের লোকটি। ঠান্ডা মাথায় চারবার গুলি করে জন লেননকে। খুব কাছ থেকে। জন লেননের মৃত্যু হয়।

কিন্তু জন লেনন আসলে বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকেন স্মিত হাসিমুখের সন্ন্যাসী, চশমা পরা এক ধীমান। বেঁচে থাকেন একহারা গড়নের এক অসম্ভব মেধাবী গীতিকার। বেঁচে থাকেন শান্ত কণ্ঠে এক গিটার নিয়ে গান করা একজন সুন্দরতম শিল্পী।

লিভারপুল শহরে জন লেননের ভাস্কর্য

সেই যে লিভারপুল শহরের সেই ব্ল্যাক আউটের রাত। এক দেবশিশু জন্ম নিল। আমরা তার কথাই সযতনে মনে রাখি। তার আদর্শ, তার দর্শন ধারণ করি। যুদ্ধবিগ্রহের বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে যাই।

আর জন লেনন আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান। আমরা তাঁকে দেখতে পাই না।

আমরা তাঁকে দেখতে পাই।