গোয়েন্দারা কে কেমন

গোয়েন্দাকাহিনি পড়তে যে মানুষ এত ভালোবাসে, গোয়েন্দাদের এত যে বিপুল জনপ্রিয়তা, তার শুরুটা কিন্তু খুব বেশি দিন আগের নয়। গ্রিস, ভারত, চীন, আরব, ইউরোপের প্রাচীন সাহিত্যে অল্প কিছু গল্পের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বটে, কিন্তু আধুনিক গোয়েন্দা সাহিত্যের সূচনাটা মার্কিন সাহিত্যিক এডগার অ্যালান পোর হাত ধরে। পোর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র অগাস্ত দুপাঁই প্রথম আধুনিক গোয়েন্দা।

মজার কথা হলো বিখ্যাত গোয়েন্দা সাহিত্যিকদের অনেকেই এমন গল্প বেশি দিন লিখতে চাননি। পোর কথাই ধরা যাক। দুপাঁর এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও চার বছরে মাত্র তিনটি গল্প লিখেছিলেন পো। শার্লক হোমসের রচয়িতা আর্থার কোনান ডয়েলও একটা সময় পর আর গোয়েন্দাকাহিনি লিখতে চাননি। ডয়েল ঐতিহাসিক কাহিনি লেখার দিকে মন দিতে চেয়েছিলেন, তাই একটা সময় পর মেরে ফেলেছিলেন শার্লক হোমসকে। পাঠকদের প্রচণ্ড চাপে মৃত হোমসকে জীবিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

অ্যালান পোর সময়ে ‘ডিটেকটিভ’ শব্দটা অভিধানে ছিল না। মাত্র তিনটি গল্প লিখলেও তাঁর এই গল্পগুলোর মধ্যেই গোয়েন্দাকাহিনির কাঠামোটা তৈরি হয়ে যায়। গোয়েন্দার কাছে রহস্যটা আসবে। তারপর সেটা আরও একটু ঘনীভূত হবে, গোয়েন্দা সবার প্রতি কড়া সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে। এর মধ্যে খুন হয়েও যেতে পারে দু-একজন। তারপর একসময় রহস্য উন্মোচনে মরিয়া গোয়েন্দা তার অসম্ভব বুদ্ধি খাটিয়ে জেনে ফেলবে নাটের গুরুটি কে। সবাইকে এক জায়গায় ডেকে এনে ধরিয়ে দেবে অপরাধীকে।

পুরো গল্পটা বলে যাবে গোয়েন্দারই কোনো এক স্বল্পবুদ্ধির সহকারী বা বন্ধু। অ্যালান পোর এই ফর্মুলা পরে অনুসরণ করেছেন কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি থেকে শুরু করে বাংলার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায় সবাই। কখনো হয়তো একটু এদিক-সেদিক করে। আর এভাবেই জনপ্রিয় কিছু গোয়েন্দা জুটির দেখা মিলেছে পাঠকদের—শার্লক হোমস-ওয়াটসন (ডয়েল), মার্টিন হিউইট-ব্রেট (আর্থার মরিসন), এরকুল পয়রো-ক্যাপ্টেন হেস্টিংস (ক্রিস্টি), ব্যোমকেশ বক্সী-অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় (শরদিন্দু), ফেলুদা-তোপসে (সত্যজিৎ)।

সে তুলনায় বাঙালি গোয়েন্দারা বেশ সাধারণ। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ শিক্ষিত, মেধাবী ও সহৃদয়। সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের মতোই। বাংলা সাহিত্যবিশারদ। কথা কম বলে। ধারালো নাকের সঙ্গে তার আছে ধারালো বুদ্ধিও। গোয়েন্দা পরিচয় দিতে তার ভারি আপত্তি। সত্যান্বেষণই তার ব্রত। বাংলাদেশ ছিল আদি নিবাস, পরে ভারতের কলকাতায় থিতু হয়েছে।

সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সবচেয়ে জনপ্রিয় বাঙালি গোয়েন্দা। ব্যোমকেশের মতোই সেও সাধারণ বাঙালি। পছন্দ করে খেতে। সিনেমা দেখা, গান শোনা—এগুলোতে তার আগ্রহ আছে। বেশ ভোরে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম করে। কথা বলে অপরাধীকে বশীভূত করার ক্ষমতা আছে তার, অপরাধী নিজেই নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।

গোয়েন্দা চরিত্রের জনপ্রিয় যে ফর্মুলার কথা এর আগে বলেছি, তা সত্যজিতের তেমন পছন্দ ছিল না। তাই ফেলুদার কাহিনি তিনি ফেঁদেছেন একটু অন্যভাবে। এখানে পাঠক আগে থেকেই বুঝতে পারেন অপরাধী কে। ফেলুদা ও অপরাধী একই সঙ্গে একে অন্যের পথে আসতে থাকে। ফেলুদা তাকে কীভাবে হাতেনাতে ধরবে, সেটা জানার জন্যই আগ্রহভরে পাঠক গল্পগুলো পড়তে থাকেন।

বাংলাদেশি গোয়েন্দাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে তিন গোয়েন্দা—কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড ও মুসা আমান। রবার্ট আর্থারের ‘থ্রি ইনভেস্টিগেটরস’ সিরিজ এবং এনিড ব্লাইটনের ‘ফেমাস ফাইভ’ সিরিজসহ নানা বিদেশি বইয়ের ছায়া নিয়ে রচিত হয়েছে ‘তিন গোয়েন্দা’র গল্পগুলো। এক গোয়েন্দার বৈশিষ্ট্যগুলোই ভাগ হয়ে আছে তিন গোয়েন্দার মধ্যে। বাঙালি কিশোর বুদ্ধিমান, আমেরিকান রবিনের প্রচুর পড়াশোনা আর আমেরিকান-আফ্রিকান মুসা শক্তিশালী। সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের বেশির ভাগ গল্প লিখেছেন রকিব হাসান, কিছু গল্প ছাপা হয়েছে শামসুদ্দিন নওয়াবের নামে।

এতক্ষণ যেসব গোয়েন্দা চরিত্র নিয়ে কথা হলো, তারা মূলত প্রাইভেট গোয়েন্দা। ব্যক্তিগতভাবে রহস্যের সমাধান করে। আরেক ধরনের গোয়েন্দাদের গল্প আছে, যারা সরকারি বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করে। এই ধারায় বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় গোয়েন্দা জেমস বন্ড।

বাংলাদেশের জেমস বন্ড হচ্ছে কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা। বন্ডের মতো মাসুদ রানাও গুপ্তচর। তাকে দেখা যায় বিভিন্ন মিশনে। বিভিন্ন বন্ধুর সাহায্য নিয়ে প্রতিপক্ষের চক্রান্ত নস্যাৎ করে মাসুদ রানা। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও জনপ্রিয় সুপারহিরো চরিত্র, যে কখনো পরাজিত হয় না। অসম্ভব বলে কোনো শব্দ যার অভিধানে নেই।

অনেকে গোয়েন্দাকাহিনিকে সাহিত্যের স্বীকৃতি দিতে নারাজ। কিন্তু তাতে পাঠকদের বয়েই গেল। ১৮ শতকের মাঝামাঝি থেকে গোয়েন্দা গল্পের যে জনপ্রিয়তা, আজ পর্যন্ত তা এতটুকু কমেনি। ডরোথি এল সেয়ার্সই একবার আশঙ্কা করেছিলেন, আর কত দিন মানুষ এই এক ধরনের গল্প লিখবে বা পড়বে। তাঁর আশঙ্কা যে অমূলক ছিল, সে তো আর কারোরই জানতে বাকি নেই। গোয়েন্দা চলচ্চিত্রগুলোর কল্যাণে এই জনপ্রিয়তা আরও বাড়ছে।