জাপানের হাশিমা দ্বীপে কেন কেউ আর থাকে না
জাপানের নাগাসাকি উপকূল থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এক রহস্যময় জাহাজ যেন দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, বিশাল এক যুদ্ধজাহাজ নোঙর ফেলেছে জনমানবহীন সাগরে। যুদ্ধজাহাজের কাছে গেলে দেখা যাবে আস্ত একটা দ্বীপ শহর। বিশাল বিশাল বিল্ডিং, রাস্তা, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, পার্ক। তবে কোথাও নেই কোনো জনমানব। পরিত্যক্ত এক দ্বীপ। এমনকি সাগরের পাখি ছাড়াও তেমন কোনো পশু-প্রাণীদেরও দেখা পাওয়া যায় না সেখানে।
এতক্ষণ বলছিলাম জাপানের হাশিমা দ্বীপের কথা। জাপানিরা একে বলে গুনকানজিমা। তবে এর ব্যতিক্রমী আকৃতির জন্য এটি বিশ্বজুড়ে ব্যাটেলশিপ আইল্যান্ড (Battleship Island) নামেই পরিচিত। একসময় এটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ স্থান, যেখানে কয়লা খনির শ্রমিকদের কোলাহলে মুখরিত ছিল প্রতিটি অলিগলি। কিন্তু আজ সেই কোলাহল নেই, আছে কেবল ভাঙা কংক্রিটের কাঠামো আর সমুদ্রের বাতাসের ফিসফিসানি।
জাপানের মানুষের কাছে দ্বীপটি এখন ভুতুড়ে। দ্বীপটি একসময় ছিল জীবন ও জীবিকার কেন্দ্র, সেই দ্বীপটি আজ সম্পূর্ণ জনশূন্য। কী এমন ঘটেছিল এই দ্বীপের সঙ্গে যে রাতারাতি এক পরিত্যক্ত শহরে পরিণত করল? কেন এর আকাশচুম্বী দালানগুলো আজ ধ্বংসাবশেষে পরিণত।
জাপানের হাশিমা দ্বীপে ১৮১০ সালের দিকে প্রথম কয়লা পাওয়া যায়। এরপর ১৮৮৭ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এটি ছিল তখনকার ব্যস্ততম একটি কয়লা খনি। কয়লা খননকারীরা তখন থেকে সেখানে বসবাস করতে শুরু করে। ১৮৯০ সালে মিতসুবিশি কোম্পানি দ্বীপটি কিনে নেয়। তারা সমুদ্রের নিচে কয়লা তোলা শুরু করে। একই সঙ্গে তারা দ্বীপের চারপাশে দেয়াল তৈরি করে এবং মাটি ভরাট করে দ্বীপটিকে তিন গুণ বড় করে তোলে। এখানে প্রায় এক কিলোমিটার গভীর চারটি বড় গর্ত তৈরি করে। এর মধ্যে একটি গর্ত পাশের একটি দ্বীপের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৮৯১ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে, প্রায় দেড় কোটি টনের বেশি কয়লা এখান থেকে তোলা হয়েছিল। খনির ভেতরটা প্রায় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরম এবং ৯৫ শতাংশ আর্দ্র থাকত।
১৯১৬ সালে, মিৎসুবিশি তাঁদের অনেক কর্মীর থাকার জন্য জাপানের প্রথম বড় কংক্রিটের ভবন তৈরি করে সেখানে। এটি ছিল ৭ তলা খনি শ্রমিকদের অ্যাপার্টমেন্ট। শক্তিশালী ঝড়, টাইফুন থেকে বাঁচতে কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছিল তখন। পরের ৫৫ বছর ধরে সেখানে আরও অনেক বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ছিল স্কুল, কিন্ডারগার্টেন, হাসপাতাল, টাউন হল এবং কমিউনিটি সেন্টার। শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের বিনোদনের জন্য ক্লাব, সিনেমা, সুইমিং পুল, ছাদবাগান, খেলার মাঠ।
১৯৩০ সাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এই খনিতে কোরিয়ান বেসামরিক জনগণ এবং চীনা যুদ্ধবন্দিদের জোর করে কাজ করানো হতো। তাঁদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা হতো। এই সময়ে, মাটির নিচে দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত কাজ এবং খাবার কম পাওয়ায় অনেক শ্রমিক মারা যান। একটি হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন ছিল মারা গিয়েছিল সেখানে।
১৯৫৯ সালে, মাত্র ৬ দশমিক ৩ হেক্টরের এই ছোট দ্বীপটিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ ছিল। প্রায় ৫ হাজার ২৫৯ জন। জায়গার হিসাবে জনসংখ্যা ছিল অতিরিক্ত বেশি। ১৯৬০ সালে জাপানে কয়লার বদলে তেল ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। তাই জাপানের বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাঁদের বিভিন্ন কয়লা খনি বন্ধ করে দিতে থাকে। মিতসুবিশি কোম্পানিও একি কাজ করে। তাঁরা হাশিমা খনি বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে মিৎসুবিশি আনুষ্ঠানিকভাবে খনিটি বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০ এপ্রিল দ্বীপের সব বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়, আর দ্বীপটি ফাঁকা হয়ে যায়।
তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময় থেকে কেউ থাকে না সেখানে। হাশিমা দ্বীপের পাশ দিয়ে গেলে যে কারোরই তখনকার বানানো সেই কংক্রিটের অ্যাপার্টমেন্ট ভবন ও চারপাশের দেয়াল চোখে পড়বে। দূর সাগর থেকে যা দেখে মনে হবে বিধ্বস্ত যুদ্ধজাহাজ নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। জাপান সরকার ২০০৫ সাল থেকে এটিকে নাগাসাকি শহরের অংশ করে দিয়েছে। ৩৫ বছর বন্ধ থাকার পর, ২০০৯ সাল থেকে আবার পর্যটকরা হাশিমা দ্বীপে যেতে পারে। তবে খুবই সীমিত।
সাধারণত, হাশিমা দ্বীপে যেতে আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রায় ৪০ মিনিটের নৌকা ভ্রমণ লাগে। এরপর দ্বীপে এক ঘণ্টা কাটানোর সুযোগ থাকে। তবে অনেক সময় আবহাওয়া এত খারাপ থাকে, নৌকাগুলো দ্বীপে নামার চেষ্টাও করে না। ২০১৫ সালে এটিকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় যুক্ত করা হয়। ২০১২ সালের জেমস বন্ডের সিনেমা স্কাইফল এর শুটিং করা হয় এই দ্বীপে। ২০১৩ সালে জাপান টুডে একটি নিউজে লিখেছিল, গুগল এই ভুতুড়ে শহরের রাস্তার ছবি তুলতে একজন কর্মী পাঠিয়েছে। পুরাতন শহরের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে তাঁর এই শহরে ভেঙ্গে পড়ার আগে গিয়ে দেখে আসতে পারো।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, উইকিপিডিয়া