রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে যে ক্ষতি হয়
‘এখন ঘুমিয়ে পড়, এত রাতে মোবাইল দেখিস কেন?’ কথাগুলো নিশ্চয়ই বড়দের থেকে তোমরা প্রায়ই শোনো। এমন কথা যদি না শুনে থাকো, তাহলে বলতে হবে তুমি খুব নিয়ম মেনে চলো।
আসলে ঘুমানোর সময় মুঠোফোন চালানো উচিত নয়। সাধারণত রাত জেগে আমরা ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করি, রিলস দেখি, গেমস খেলি…। এত দিন বিজ্ঞানীরা ভেবেছেন, রাতের ঘুম নষ্ট করে মুঠোফোন ব্যবহার করলে মুঠোফোনের স্ক্রিনের কারণে আমাদের সমস্যা হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সমস্যা এখানেই শেষ নয়। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার তুলনায় তুমি যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করো, সেটা বেশি ক্ষতিকর! তাই বলে ভেবো না, রাতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে ক্ষতি হয় না।
ঘুম আমাদের শরীরের জন্য খুবই দরকারি। বিশেষ করে তোমাদের যাদের বয়স কম, তাদের আরও বেশি ঘুমানো দরকার। কিশোরদের ৮-১০ ঘণ্টা আর বড়দের ৭-৯ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। কিন্তু আজকাল বেশির ভাগ কিশোরই এই নিয়ম মানে না। ফলে ওদের ক্লান্ত লাগে, মন খারাপ থাকে, অল্পতে রেগে যায়। এমনকি পড়া মনে রাখতেও অসুবিধা হয়। এই সবকিছু মিলিয়ে পড়াশোনায় আর মন বসে না। আবার শরীরও খারাপ হতে পারে!
অনেক সময় কাজ না থাকলে এমনিই আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ক্রল করতে থাকি। মাঝেমধ্যে একটু থেমে নিজেকে জিজ্ঞেস করো, সত্যিই কি এখন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউব দেখাটা জরুরি?
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের শতকরা ৮৪ ভাগ তরুণ প্রতিদিন অন্তত একটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। ফলে নোটিফিকেশন বা মেসেজ এলেই তরুণেরা মুঠোফোনে একবার ঢুঁ মারে। একই অবস্থা দেখা যায় রাতেও। হয়তো মুঠোফোনটা মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়েছ, তখন টং করে ফেসবুকের একটা নোটিফিকেশন এল। অমনি তুমি ঘুম বাদ দিয়ে তা দেখতে গেলে। আর তাতেই গেল ঘুমের বারোটা বেজে!
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি মনোযোগ দিলে কী হয়
গবেষকেরা বলছেন, কতক্ষণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকছি শুধু তা দেখলেই হবে না, বরং ওগুলোতে কতটা মনোযোগ দিচ্ছি, তা–ও খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, এ বিষয়টাও ঘুমের জন্য খুব জরুরি।
২০২৪ সালে ৮৩০ জন তরুণের ওপর একটা গবেষণা চালানো হয়। এই তরুণদের বেশির ভাগই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি মনোযোগী ছিল। মানে কোনো নোটিফিকেশন এলে সঙ্গে সঙ্গে তা দেখত। তাকে কে লাইক বা কমেন্ট করল বা কে মেসেজ দিল, এটা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখত। গবেষণায় দেখা গেছে, এমন তরুণদের রাতে ঘুমে বেশি সমস্যা হয়। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তারা অনেক কিছু ভাবতে থাকে। অন্যদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে মন খারাপ করে। ফলে রাতে সহজে ঘুম আসে না। অর্থাৎ এই ফলাফল থেকে স্পষ্ট, শুধু স্ক্রিনটাইম কমালেই হবে না, সঙ্গে তুমি কতটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় এবং তা তোমার ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, তা–ও বিবেচনা করতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কীভাবে আমাদের ঘুমের ক্ষতি করে
রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের পর ঘুম আসতে দেরি হলে সে জন্য শুধু স্ক্রিনের আলো দায়ী নয়। এর পেছনে আরও জটিল কারণ আছে।
ঘুমের আগে উত্তেজনা: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন উত্তেজনাপূর্ণ বা আবেগময় কনটেন্ট আমাদের মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে। ঝগড়া বা মারামারির মতো কিছু দেখলে মন অস্থির হয়ে থাকে। মজার কিছু দেখলেও মন উত্তেজিত থাকে। ফলে সহজে ঘুম আসতে চায় না।
অন্যদের সঙ্গে তুলনা: ঘুমাতে যাওয়ার আগে অন্যদের সুন্দর ছবি, ফিটনেস বা সাফল্যের খবর শুনলে নিজেকে অন্যের তুলনায় ছোট মনে হয়। এতে মন খারাপ আর দুশ্চিন্তা হয়। মনে হয় আমি কিছু করতে পারলাম না! ফলে মন খারাপ আর দুশ্চিন্তা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।
অভ্যাসে পরিণত হওয়া: রাতে লাইট বন্ধ করার পরও যদি আমরা মুঠোফোনের নোটিফিকেশন চেক করি বা স্ক্রল করতে থাকি, তাহলে তা একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়। এতে একেক রাতে একেক সময় ঘুম আসে। ফলে ঘুমের চক্র নষ্ট হয়ে যায়। এতেও ঘুমের সমস্যা হয়।
কিছু হারানোর ভয়: ইংরেজি ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ বলে একটা কথা আছে। এর মানে হলো, নিজের কাছে মনে হয়, যদি এখন ফেসবুকে না ঢুকি তাহলে বন্ধুদের নতুন কিছু পোস্ট বা মেসেজ মিস করে যাবে। এই ভয়ে অনেকেই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। আর এমনটা করলে তো ঘুমের বারোটা বাজবেই!
তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু আমাদের সময় নষ্ট করে না, এটা আমাদের ঘুমেরও শত্রু। তবে তাই বলে আবার সবকিছু বন্ধ করে দিতে বলছি না। এসব রাতে ঘুম নষ্ট করে ব্যবহার না করে দিনে ব্যবহার করতে পারো। রাতে যা কিছু মিস করবে, তা পরদিন সকালে দেখে নেবে। ছোট কিছু অভ্যাস বদলালেই ঘুমের অনেক উন্নতি হতে পারে। এখানে কিছু সহজ বলে দিচ্ছি।
ঘুমের আগে মনকে শান্ত করা: ঘুমাতে যাওয়ার ৩০ থেকে ৬০ মিনিট আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেখা বন্ধ করো। এতে মন খারাপ করা বা আনন্দের কিছু দেখতে হবে না। তাহলে মন থাকবে শান্ত। ঘুমাতে পারবে আরামসে!
ঘুমানোর সময় মুঠোফোন দূরে রাখা: এখনই ঘুমিয়ে পড়ব, মুঠোফোন দেখব না—এই ভেবে মুঠোফোনটা মাথার পাশে রাখলে হবে না। অবশ্য ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ মোডে রেখে মাথার পাশে রাখতে পারো। সবচেয়ে ভালো হয়, হাতের নাগালে মুঠোফোন না রাখা।
অকারণে স্ক্রল করা কমানো: অনেক সময় কাজ না থাকলে এমনিই আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ক্রল করতে থাকি। মাঝেমধ্যে একটু থেমে নিজেকে জিজ্ঞেস করো, সত্যিই কি এখন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা ইউটিউব দেখাটা জরুরি? যদি দেখতে ইচ্ছা না করে, তাহলে শুধু শুধু একের পর এক স্ক্রল না করে এসব ব্যবহার বন্ধ রাখো।
ঘুমানোর আগে পড়তে পারো বই: বই পড়তে আমাদের অনেকেরই ভালো লাগে। ভৌতিক গল্প বা গোয়েন্দা গল্প পড়তে তো অনেকেই পছন্দ করে। চাইলে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ১০-২০ মিনিটে একটা গল্প পড়তে পারো। এতে পড়ার পাশাপাশি দেখবে চোখ ঘুমে ঢলে পড়ছে। অবশ্য রাতে মুঠোফোনে বই পড়তে যেয়ো না যেন।
সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান