আর্থার কোনান ডয়েল: সৃষ্টির ছায়ায় ঢাকা পড়া ক্ষণজন্মা স্রষ্টা

উইলিয়াম শার্লক স্কট হোমস। ঠিকানা ২২১বি, বেকার স্ট্রিট, লন্ডন।

এই একটি নাম ও ঠিকানা রহস্য-রোমাঞ্চপ্রেমী পাঠকদের বুঁদ করে রেখেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। শার্লক হোমস ছয় ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা, চৌকো মুখ, সংগীতে আসক্ত। অবসরে ভায়োলিন বাজাতে পছন্দ করে। প্রখর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণশক্তির অধিকারী। ছদ্মবেশ নিতে জুড়ি নেই।

এই অমর চরিত্রের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল। তাঁর হাত ধরে ১৮৮৭ সালে ছাপার অক্ষরে শার্লক হোমসের প্রথম আবির্ভাব। এরপর কেটে গেছে প্রায় সোয়া ১০০ বছর, কিন্তু হোমসের আবেদন কমেনি একবিন্দু। সময় গড়িয়েছে, প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, বদলে গেছে অপরাধের ধরন, অপরাধী ধরার ধরন। তা সত্ত্বেও হোমস সমান প্রাসঙ্গিক।

ঘরে-বাইরে তুমুল জনপ্রিয় শার্লক হোমস, কিন্তু আবির্ভাবেই হইহই রইরই ফেলে দেয়নি; বরং একেবারেই সাদামাটা শুরু হয়েছিল তার। গল্পটা বরং গোড়া থেকেই শুরু করা যাক।

আর্থার ইগনেশাস কোনান ডয়েল। জন্ম ১৮৫৯ সালের ২২ মে, স্কটল্যান্ডের এডিনবরায়। তাঁর বাবা চার্লস আলটামন্ট ডয়েল ছিলেন আইরিশ সরকারি চাকরিজীবী, পাশাপাশি শখের বশে ছবিও আঁকতেন। মা মেরি ফলি ডয়েল ছিলেন গৃহিণী। আর্থার কোনান ডয়েল দারুণ ক্রিকেটার ছিলেন। ফুটবল আর গলফটাও দারুণ খেলতেন।

ডয়েলের জীবন বদলে যায় ১৮৭৬ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়তে যাওয়ার পর। কারণ, সেখানেই তিনি দেখা পান ‘আসল’ শার্লক হোমসের!

লোকটির নাম ডা. জোসেফ বেল। আর্থার কোনান ডয়েলের শিক্ষক। অনন্য এক গুণের অধিকারী ছিলেন মানুষটি। অসাধারণ পর্যবেক্ষণক্ষমতার সাহায্যে যেকোনো মানুষকে দেখে প্রায় নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারতেন তার স্বভাব-চরিত্র, পেশা ইত্যাদি। মাত্র ২১ বছর বয়সে ডাক্তারি পাস করেন জোসেফ বেল। ছোটখাটো চেহারার মানুষ। কৈশোরে শিকারে গিয়ে পায়ে আঘাত পাওয়ার ফলে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি।

দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ডাক্তারি পড়লেন আর্থার কোনান ডয়েল। কিন্তু পাস করার পর ডাক্তারিতে ঠিক পসার জমাতে পারলেন না। তখন কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় টুকটাক ছোটগল্প লিখে নানা পত্রিকায় পাঠাতে শুরু করেন। লেখালেখির অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। কিন্তু গল্প লিখে আয় তেমন হলো না। তখন ভাবলেন, উপন্যাস লিখবেন।

ফরাসি লেখক এমিল গ্যাবোরিয়ো আর আমেরিকান লেখক এডগার অ্যালান পোর রহস্যগল্প ডয়েলের ভালো লাগত। আর আদর্শ রহস্যভেদী চরিত্র হিসেবে ডা. জোসেফ বেল তো ছিলেনই। তাই ডা. বেলের আদলেই নিজের গোয়েন্দা চরিত্রকে গড়লেন ডয়েল।

তবে নায়কের নাম কিন্তু প্রথমে শার্লক হোমস ছিল না। ডয়েল প্রথমে তার নাম দিয়েছিলেন শেরিনফোর্ড হোপ কিংবা শেরিংটন হোপ। তবে কিছুদিন পর হোপ ফেলে দিয়ে প্রিয় লেখক অলিভার ওয়েন্ডেল হোমসের নামের শেষাংশ ধার নিলেন তিনি। ব্যস, নায়কের নাম হয়ে গেল শেরিনফোর্ড বা শেরিংটন হোমস। তবে আরও কদিন পর শেরিনফোর্ড আর শেরিংটনও ফেলে দিলেন ডয়েল। তার বদলে আনলেন শার্লক। এবার নায়কের নাম হয়ে গেল শার্লক হোমস।

যাহোক, বই তো লেখা হলো। কিন্তু তারপর শুরু হলো আরেক লড়াই। বহু ঘোরাঘুরি করেও বইটি বের করার জন্য কোনো প্রকাশক পাচ্ছিলেন না ডয়েল। একের পর এক প্রত্যাখ্যানের শিকার হয়ে শেষতক উপন্যাসটি ১৮৮৭ সালে বিটনস ক্রিসমাস অ্যানুয়াল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। আ স্টাডি ইন স্কারলেট নামের সেই উপন্যাস থেকে ডয়েল পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন মোটে ২৫ পাউন্ড।

প্রথম উপন্যাস সাড়া ফেলতে না পারায় ডয়েল ঠিক করেছিলেন, হোমসকে নিয়ে আর কিছু লিখবেন না। তাই তিনি মন দিলেন ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখায়। তাতে তিনি সাফল্যও পান। তবে তিন বছর পর আমেরিকার লিপিনকট ম্যাগাজিন ডয়েলের কাছে মাঝারি আকারের একটি উপন্যাস চায়। এ উপন্যাসের জন্য ১০০ পাউন্ড পারিশ্রমিক দেবে তারা। বেশ মোটা অঙ্কের সম্মানী।

তাই আর্থার কোনান ডয়েল ঠিক করলেন, শেষবারের মতো ফিরিয়ে আনবেন এই তুখোড় গোয়েন্দাকে। ১৮৯০ সালে লিপিনকটে প্রকাশিত হলো দ্য সাইন অব ফোর উপন্যাসটি। এরপরই ঘুরে গেল ভাগ্যের মোড়। অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পেল দ্য সাইন অব ফোর। হটকেকের মতো বিক্রি হতে লাগল বইটি।

এদিকে ইংল্যান্ডে ১৮৯০ সালে বেরোল এক নতুন সাময়িকী দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন। আবির্ভাবেই এ পত্রিকা পেয়ে গেল তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। প্রথম সংখ্যাই বিক্রি হলো দুই লাখ কপির বেশি! দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন তখন লেখকদের সম্মানীও দিচ্ছিল বেশ মোটা অঙ্কের—প্রতি শব্দের বিনিময়ে ৪ পাউন্ড।

দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের খ্যাতি, উপযুক্ত সম্মানী আর নিজের এজেন্টের চাপাচাপিতে অবশেষে ডয়েল আবার কয়েকটি গল্প লিখলেন শার্লক হোমসকে নিয়ে। তাঁর গল্প পেয়ে তো রীতিমতো চাঁদ হাতে পেল ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ। ব্যস, সেই শুরু হলো শার্লক হোমসের জয়রথ। এরপর ডাক্তারি বাদ দিয়ে লেখালেখিতেই মন দিলেন ডয়েল।

শার্লক হোমসের জনপ্রিয়তা যেন ছাড়িয়ে গেল আর্থার কোনান ডয়েলকেও। সৃষ্টির নিচে স্রষ্টার চাপা পড়ার দশা। হোমসকে নিয়ে পাঠক, প্রকাশক, অনুরাগীদের বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাসে তিতিবিরক্ত ডয়েল। তাই ১৮৯৩ সালে ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে জলপ্রপাত থেকে ফেলে মেরে ফেললেন শার্লক হোমসকে।

কিন্তু চারদিক থেকে ঘূর্ণিঝড়ের মতো আসতে লাগল প্রতিবাদ। হোমসকে মেরে ফেলার পরপরই ২০ হাজার পাঠক কমে গিয়েছিল দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের।

অবশেষে পাঠকদের চাপাচাপি আর অর্থের প্রয়োজনে ১৯০১ সালে শার্লক হোমসকে ফিরিয়ে আনলেন ডয়েল দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস উপন্যাসে। যথারীতি এ উপন্যাসও তুমুল জনপ্রিয়তা পেল। এরপর আর বন্ধ করেননি, ১৯২৬ সাল পর্যন্ত শার্লক হোমসকে নিয়ে লিখে গেছেন আর্থার কোনান ডয়েল। এ দুঁদে গোয়েন্দাকে নিয়ে তিনি মোট ৫৬টি গল্প ও ৪টি উপন্যাস লিখেছেন।

শার্লক হোমস বাস্তবের মানুষ ডা. জোসেফ বেলের আদলে গড়া কল্পনার চরিত্র। তবে কাল্পনিক চরিত্র হলেও হোমসের বাস্তব অবদান কম নয়। অপরাধজগতে এই কাল্পনিক চরিত্রের কল্যাণে বহু উন্নতি এসেছে।

এই যেমন অনুমানবিজ্ঞান, অর্থাৎ সায়েন্স অব ডিডাকশনের যথার্থ জন্ম কিন্তু শার্লক হোমসই দিয়েছে। অপরাধের তদন্তে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ছোঁয়া লাগে হোমসেরই কল্যাণে।

হাত-পায়ের ছাপ নিতে প্লাস্টার অব প্যারিসের ব্যবহার, জমাট রক্তের পরীক্ষা, টাইপরাইটিংয়ের বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা, অপরাধীকে অনুসরণে কুকুর ব্যবহার—এসবই প্রথম দেখা যায় শার্লক হোমসের গল্পে। পরে একসময় বিভিন্ন দেশের পুলিশ বিভাগ এসব পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।

অপরাধী শনাক্তকরণে হোমসের অবদান মাথায় রেখে ২০০২ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি শুধু হোমসের ফরেনসিক বিদ্যার ওপর গবেষণা করে ফেলোশিপ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পৃথিবীতে কোনো কল্পিত চরিত্রের ওপর এমন বৈজ্ঞানিক গবেষণার সুযোগ এই প্রথম।

আর্থার কোনান ডয়েলের সৃষ্ট আরেক চরিত্র প্রফেসর চ্যালেঞ্জারও দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই খ্যাপাটে প্রফেসরকে নিয়ে তিনি দুটি সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস ও চারটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড বইটি পড়েনি বা নাম শোনেনি এমন পাঠক পাওয়া দুষ্কর।

গোয়েন্দা গল্পের বাইরেও বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন ডয়েল। তার মধ্যে দ্য হোয়াইট কোম্পানি বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। ১৯০২ সালে ডয়েল সম্মানসূচক নাইট খেতাব পান। ও হ্যাঁ, আর্থার কোনান ডয়েল কিন্তু রাজনীতিতেও নাম লিখিয়েছিলেন। দু-দুবার সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তবে ভাগ্য এখানে সাহিত্যক্ষেত্রের মতো সুপ্রসন্ন হয়নি। দুবারই নির্বাচনে হেরে যান তিনি।

ডয়েলের প্রথম জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। তাঁর বাবাকে শেষ জীবন পাগলাগারদে কাটাতে হয়েছে। মায়ের সঙ্গে ডয়েলের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ডয়েলের মা তাঁদের নিয়মিত গল্প পড়ে শোনাতেন।