অন্য রকম গোয়েন্দা

শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো, মিস মার্পলদের কীর্তিকাণ্ড নিশ্চয়ই কিছু কিছু পড়া আছে তোমাদের। এ রকম আরও কয়েকজন নতুন গোয়েন্দার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন জামিল বিন সিদ্দিক

এ জে রেফলস

অপরাধীকে কোনো অবস্থাতেই নায়ক বানানো যাবে না, বিশ্বাস করতেন আর্থার কোনান ডয়েল। ঠিক সেই কাজটাই করেছিলেন ই ডব্লিউ হরনং, ব্যক্তিগত জীবনে যিনি ছিলেন আবার ডয়েলেরই বোনজামাই। একটা চোরকে গোয়েন্দা করে তুলেছিলেন তিনি। তবে চোর হলেও কিছু নীতি মেনে চলে রেফলস। কখনো আশ্রয়দাতার কাছ থেকে চুরি করে না। বন্ধুর বিপদে জীবন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর সম্পদের সুষম বণ্টনে সে বিশ্বাসী। শার্লক হোমসের সচেতন বিপরীত চরিত্র হিসেবে তাকে তৈরি করা হয়েছিল। লন্ডনের অভিজাত পাড়ায় শান শওকত নিয়ে সে থাকে। অকল্পনীয় সব উপায়ে চুরি করে। এই ধারায় চোরকে নায়ক করে পরে অনেক সিরিজই লেখা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ফরাসি লেখক মরিস ল ব্লার আরসেন লুপাঁ।

দ্য ওল্ডম্যান ইন দ্য কর্নার

ব্যারনেস অর্কজি তাঁর এই গোয়েন্দাটির নাম কোথাও উল্লেখ করেননি, শুধু কোনার ধারের বুড়োটি বলেই কাজ সেরেছেন। তিনি পুলিশও না, পেশাদার গোয়েন্দাও না। সত্যি বলতে কী অপরাধ সমাধানের জন্য কেউ তাঁর কাছে আসেই না। তারপরও যেখানেই অসাধারণ কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, হাজির হন এই বুড়ো। এ বিষয়ে পত্রিকায় যা কিছু লেখা হয়, সব তার মুখস্থ, সব সময় তার পকেটেই থাকে সেসব খবরের কাটিং। তথ্য সংগ্রহ করতে কখনো কখনো আদালত পর্যন্ত ছোটেন। তারপর এবিসি চা-খানার এক কোনায় বসে এক নারী সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ করতে করতে রহস্যগুলোর গিঁট ছাড়ান। কাজটা করার সময় বাস্তবেও হাতে এক টুকরো দড়ি নিয়ে বুড়ো জটিল সব গিঁট তৈরি করেন আর খোলেন। বুড়োর আরেকটা বৈশিষ্ট্য অপরাধী শনাক্ত করলেও পুলিশকে তিনি কিছুই জানান না, পুলিশের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা আছে। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায় অপরাধী। তাদের কোনো শাস্তিই হয় না।

ড. জন থর্নডাইক

থর্নডাইককে বলা হয় প্রথম ফরেনসিক গোয়েন্দা। আলামতই তার কাছে প্রধান বিবেচ্য। সঙ্গে সব সময় একটা অ্যাটাচি কেস নিয়ে ঘোরেন, তাতে থাকে প্রয়োজনীয় সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা থেকে পুকুরের আগাছা—কোনো কিছুই তার বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের আওতার বাইরে থাকে না। এই দিক থেকে তিনি শার্লক হোমসের চেয়েও এক কাঠি সরেস। হোমসের সঙ্গে আর একটা দিক থেকেও তার পার্থক্য আছে, হোমস তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল ওয়াটসন তথা পাঠকের সঙ্গে পুরোপুরি খোলাসা করে না। কিন্তু থর্নডাইক তার বিশ্লেষণের ফলাফল পুরোটাই পাঠককে অবহিত করে। পুরো আলামতের চুলচেরা বিশ্লেষণের পরই কেবল সে মানব চরিত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে। আর বলা হয়ে থাকে বইয়ে বর্ণিত সব পরীক্ষাই বাস্তবে আগে নিজে করে দেখেন অস্টিন ফ্রিম্যান পরে বইতে দেন। উল্লেখ্য, ফ্রিম্যান নিজেই একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক। পূর্বসূরিদের সঙ্গে আরেকটা ব্যাপারেও তার যথেষ্ট পার্থক্য আছে, তাদের মতো পুলিশকে অবজ্ঞার চোথে দেখেন না থর্নডাইক, বরং তাদের সঙ্গে মিলেমিশেই কাজ করেন তিনি। ফ্রিম্যান এই সিরিজে পরের দিকে আরেকটা কাজ করেছেন—চীনাদের মতো আগেই অপরাধ ও অপরাধীর পরিচয় ফাঁস করে দিয়েছেন। তারপর দেখিয়েছেন থর্নডাইক কী করে তাকে পাকড়াও করে।

ফাদার ব্রাউন

কোনো একজন ধর্মযাজক একটা সফল গোয়েন্দা সিরিজের নায়ক, ভাবতে পারো! আমরা ভাবতে পারি না, গিলবার্ট কিথ চেস্টারটন কিন্তু ঠিকই পেরেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা ফাদার ব্রাউন একটা গির্জার পাদরি। বগলে বিশাল ছাতা, মাথায় টুপি আর সাদামাটা পোশাকের এই অতিসাধারণ লোকটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, মানবমনের অশুভ প্রবণতা সম্পর্কে তাঁর রয়েছে আসাধারণ প্রজ্ঞা। শার্লক হোমসের মতো ধাপে ধাপে আরোহী পদ্ধতিতে নয়, প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে রহস্যের সমাধান করেন তিনি। কিন্তু পাদরি হয়ে মানুষের অশুভ দিক সম্পর্কে এত কিছু কোত্থেকে জানলেন তিনি? ফাদার ব্রাউনের দাবি, বিশেষভাবে পাদরি হওয়ার কারণেই আরও জানা সম্ভব হয়েছে, কারণ ভালো-মন্দ সব ধরনের মানুষই তাদের কাছে নিজের পাপের স্বীকারোক্তি করতে আসে। আর এসব শুনে শুনেই মানব চরিত্রের এই দিকটি সম্পর্কে তিনি কাবিল হয়ে উঠেছেন। ফলে কোনো অপরাধের মুখোমুখি হলে তিনি সহজেই নিজেকে অপরাধীর জায়গায় বসিয়ে পুরো ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেন।

ইন্সপেক্টর মেগ্রে

গোয়েন্দা সাহিত্যের সূচনাযুগে পুলিশের মোটা বুদ্ধি, আত্মম্ভরিতা আর সবজান্তাভাব নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করাটা ছিল একটা সাধারণ বিষয়। শুরু করেছিলেন দুপাঁ, পরিণতি দেন হোমস। স্বর্ণযুগের প্রায় সবাই রীতিটাকে কমবেশি জারি রেখেছিলেন। কিন্তু ৫০ দশকে এসে এই হাসির পাত্রই আস্তে আস্তে গোয়েন্দা গল্পের নায়ক হয়ে উঠতে লাগল। আর এখন তো আধুনিক গোয়েন্দা সাহিত্য বলতে গেলে একচেটিয়া নায়কই পুলিশ। এই পুলিশ গোয়েন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ইন্সপেক্টর মেগ্রে। সমকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ফরাসি গোয়েন্দা চিফ ইন্সপেক্টর মার্সেল গিয়মের আদলে এই চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন জর্জ সিমেনো। এই কাহিনিগুলোতেও আর সব গোয়েন্দা কাহিনির মতো অসাধারণ বুদ্ধির খেলা আছে, তার বাইরে যেটা আছে সেটা হলো পুলিশ বাহিনীর দলবদ্ধ ক্রিয়াকর্ম। পুলিশের এই কায়িক শ্রমের সাহায্য ছাড়া মেগ্রের পক্ষে হয়তো রহস্য ্ল্ল্লসমাধানের মানসিক পর্যায়ে পৌঁছা সম্ভব হতো না। এই সব কাজে মেগ্রেকে সাহায্য করার জন্য আছে চারজন সহকর্মী। এই ধারাটাই পরে আরও পরিণতি লাভ করে পুলিশ প্রসিডরাল নামে আলাদা একটা উপশাখার জন্ম হয়েছে, যেখানে রহস্য সমাধানে একক কোনো নায়ক নেই, হয়তো পুরো একটা দলই নায়ক।

আঙ্কল আবনার

সারা জীবন ছয়টার মতো গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন মেলভিন ডেভিসন পোস্ট। তার মধ্যে অধিকাংশের বিচারেই শ্রেষ্ঠ আবনার। অনেকের বিচারে অ্যালান পোর দুঁপার পর গোয়েন্দা সাহিত্যে মার্কিনদের শ্রেষ্ঠ দান। সত্যিকার অর্থেই অতি সাধারণ একজন মানুষ এই আবনার। গ্রামের সবার তিনি আঙ্কেল। ধর্মভীরু এই বৃদ্ধের বিশেষ কোনো ক্ষমতাও নেই। বদলে তার আছে, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণশক্তি, সরল যুক্তিবোধ আর গভীর বাইবেল-প্রেম জ্ঞান। এগুলো সম্বল করেই গোয়েন্দা সাহিত্যের অসাধারণ কিছু রহস্যের সমাধান করেছেন এই বুড়ো। ঘটনাগুলো বর্ণনা করেছেন তাঁর ভেক সম্পর্কীয় নাতি।

ম্যাক্স কারাডোস

ম্যাক্স কারাডোস শার্লক হোমসের সমসাময়িক। একই সঙ্গে স্ট্রান্ড ম্যাগাজিনে পাশাপাশি ছাপা হতো তাদের কীর্তিকলাপ। সূচিপত্রে প্রায়ই হোমস ও ডয়েলের ওপর থাকত ম্যাক্স কারাডোস ও আর্নেস্ট ব্রামার নাম। শোনা যায় সমকালে হোমসের চেয়ে নাকি বেশি বিক্রি হতো কারাডোস। কারাডোস অন্ধ গোয়েন্দা। তার গল্পগুলো আমাদের শুনিয়েছেন আরেক প্রাইভেট গোয়েন্দা কার্লাইল। একটা মুদ্রার ব্যাপারে আলাপ করতে গিয়ে কারাডোসের সঙ্গে তার পরিচয়। এই পরিচয়েরও ১২ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় অন্ধ হয়ে যায় কারাডোস। এক ধনী জ্ঞাতির কল্যাণে অর্থচিন্তা তার নেই। কারাডোস পরিশীলিত নাগরিক মানুষ। বাকি চারটা ইন্দ্রিয় সে এমন দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে যে প্রথম পরিচয়ে তার অন্ধত্বটা অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। চক্ষুষ্মান হলে হয়তো আর দশটা মানুষেরই মতোই সাধারণ হতো তার পারসেপসন। কিন্তু দৃষ্টিহীনতা তার অন্য ইন্দ্রিয়গুলোর ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে পারসেপশনের বোধ। এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়েই সে রহস্য সমাধান করে। জর্জ অরওয়েলের মতে, ডিটেকটিভ গল্পে পোর পর ডয়েল আর ফ্রিম্যান বাদে ম্যাক্স কারাডোসের গল্পগুলোই শুধু পুনঃপাঠযোগ্য।

জাজ ডি

চীনাদের রহস্য সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। এসব রচনায় অনন্য সব প্লট আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই কাহিনিগুলো ঠিক আধুনিক গোয়েন্দাকাহিনির কেতায় বলা হয়নি। কখনো শুরুতেই অপরাধীর পরিচয় ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে, কখনো বলা নেই কওয়া নেই কাহিনিতে ঢুকে পড়েছে ভূতপ্রেত, আবার কখনো কাহিনি মূল প্লট থেকে সরে গিয়ে শুরু করেছে দার্শনিক আলোচনা। ওলন্দাজ চীনা সাহিত্যবিশারদ রবার্ট ভ্যান গুলিক ঠিক করলেন, চীনা গোয়েন্দা গল্পের রীতি আর আবহটা বজায় রেখে আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের কলকবজা ব্যবহার করে একটা গোয়েন্দা তৈরি করবেন। সৃষ্টি হলো জাজ ডি। ডি বলে সত্যি সত্যি কিন্তু একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিল। গুলিকের লেখায় ডি টাং যুগের একজন আঞ্চলিক ম্যাজিস্ট্রেট। বদলি হয়ে হয়ে নানা জায়গায় যায় আর নতুন নতুন রহস্যের মুখোমুখি হয়। ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের পটভূমিতে লেখা এই গল্পগুলোর আরেকটা অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি বইয়ে একসঙ্গে তিনটি কেস নিয়ে কাজ করে ডি। উপন্যাসগুলো থেকে ঐতিহাসিক উপন্যাস পাঠের আনন্দও পাওয়া যায়।

নেরো উলফ

ম্যাক্স কারাডোসের মতো নেরো উলফকেও বলা যেতে পারে প্রতিবন্ধী গোয়েন্দা। কারাডোস দৃষ্টিশক্তিরহিত আর উলফ চলনশক্তিহীন স্থবির। তবে তার এই অক্ষমতার কারণ কিন্তু কারাডোসের মতো স্থায়ী কোনো শারীরিক পঙ্গুতা নয়, অতিরিক্ত স্থূলতা। তিনি এতই মোটা যে রেডিমেড চেয়ারে তার শরীর কুলায় না, রীতিমতো অর্ডার দিয়ে চেয়ার বানাতে হয়। তিনি মূলত আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ। বাড়িতে বসেই রহস্যের সমাধান করেন। নড়াচড়া করাটা তাঁর দুচোখের বিষ। তাঁর দীর্ঘ গোয়েন্দাজীবনে নেরো কতবার বাড়ি থেকে বের হয়েছেন, আঙুলে গুনেই বলে দেওয়া যাবে। তারপরও বাইরে কোনো কাজ করাতে হলে তার জন্য সহকারী আর্চিবল্ড গুডউইন আছে। নেরোর তিন প্রেম হচ্ছে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা আর অর্কিড। রেক্স স্টাউটের এই সিরিজ গোয়েন্দা লেখকদের বিচারে শতাব্দীর সেরা গোয়েন্দা সিরিজ নির্বাচিত হয়েছে।

রবার্ট ভ্যান গুলিক

১৯২০-এর দশকে সংঘবদ্ধ অপরাধের আমলে মার্কিন সাহিত্যে নতুন এক ধরনের গোয়েন্দার আবির্ভাব হলো। ধরনটার নাম হার্ড বয়েলড। এই গোয়েন্দাদের যেমন সংঘবদ্ধ অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, তেমনি আবার তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দেখা দেয় দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ। আগের আমলের গোয়েন্দাদের শেষোক্ত এই শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়নি কখনো। পুলিশ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করলেও এই শক্তিটা বরাবর তাদের সহায়কই ছিল এত দিন। স্বর্ণযুগের গোয়েন্দাদের তুলনায় এদের নীতিনৈতিকতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন তোলা যায়। রেফলস চোর হলেও তারও আছে কিছু নীতি। কিন্তু হার্ড বয়েলড গোয়েন্দাদের ওসবের বালাই কমই আছে। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বাঁকা পথে যেতেও এরা পিছপা হয় না। পয়সায় বিনিময়ে ক্লায়েন্টের অসাধু উদ্দেশ্য পূরণেও এরা এক পায়ে খাড়া। এই ঘরানারই প্রথম সার্থক গোয়েন্দা স্যাম স্পেড। লেখক ড্যাশিল হ্যামেট নিজেও প্রথম জীবনে পিঙ্কারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সিতে কাজ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা এই কাহিনিগুলো রচনায় সহায়ক হয়েছিল।