দক্ষিণ মেরুতে কি মানুষ উল্টো হয়ে থাকে

গ্লোবের নিচের দিকে তাকালে দেখবে লেখা আছে দক্ষিণ মেরু। কল্পনা করো, তুমি এই দক্ষিণ মেরুর কোনো এক জায়গায় ঘুরতে গিয়েছ। সাদা বরফের চাদরে ঢাকা একদম নির্জন এলাকা। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। ওই এলাকা যেহেতু পৃথিবীর একদম নিচের দিকে, তাই সেখানে গেলে তুমি সোজা হয়ে থাকবে নাকি উল্টো? প্রশ্নটা অদ্ভুত মনে হলেও অনেকের মাথায় এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতেই পারে। উত্তরটা আরও বেশি মজার। যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীর মাথায়ও এসেছিল প্রশ্নটা। তিনি তখন সত্যি সত্যি ছিলেন দক্ষিণ মেরুতে। তিনি মূলত গ্রহ, নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জ বা কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে গবেষণা করেন। এ জন্য তাঁকে বলা হয় জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। এবার চলো, এই বিজ্ঞানীর ভাষায় দক্ষিণ মেরুর একটা গল্প শুনি।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর। শীতের কনকনে ঠান্ডায় যখন মানুষ গরম পোশাক পরে ঘরে বসে আছে, তখন আমাদের এই বিজ্ঞানী রওনা দিলেন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। গন্তব্য দক্ষিণ মেরু। সেখানে সাত সপ্তাহ (প্রায় দেড় মাস) কাটানোর পরিকল্পনা। ভাবছ, এই শীতের মধ্যে তাঁর কাজটা কী?

ব্যাপারটা আরও সহজে বুঝতে হলে একটি ছোট্ট পরীক্ষা করতে হবে। একটি ক্রিকেট বলকে দুই আঙুল দিয়ে ধরো। একটা আঙুল ওপরের দিকে, আরেকটা নিচের দিকে। এখন দুটি আঙুল দিয়ে তুমি বলের দুই পাশে স্পর্শ করেছ।

তিনি মহাকাশ থেকে আসা একধরনের কণা খুঁজছেন। এমন সব কণা, যেগুলো হয়তো লুকিয়ে রেখেছে মহাবিশ্বের রহস্য। এই কাজের জন্য দরকার ছিল বিশেষ যন্ত্র। আর যন্ত্রগুলো বসানো হয়েছিল দক্ষিণ মেরুতে। সেখানে পৌঁছেই তাঁর মাথায় সেই অদ্ভুত প্রশ্ন এল। কিন্তু তিনি দেখলেন, সোজাই তো মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে থাকতে তো অদ্ভুত লাগছে না। মাথার ওপর আকাশও রয়েছে দিব্যি। তবে ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ভিন্নতা খেয়াল করলেন। হঠাৎ বিজ্ঞানীর মনে হলো, চাঁদটা যেন উল্টো হয়ে আছে!

আরও পড়ুন

আসলে আমাদের এই বিজ্ঞানীর প্রতিদিন রাতে চাঁদ দেখার অভ্যাস। এসব নিয়েই তো তাঁর যত কাজ। তাই চাঁদের পরিবর্তনটা সহজেই ধরে ফেললেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে চাঁদের মুখে যেসব গর্ত দেখা যেত, সেগুলো দেখে মনে হতো যেন একটা হাসিমুখ। কিন্তু এখানে চাঁদের মুখ যেন একেবারে উল্টো। হাসিমুখটা যেন বিষাদে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাঁদের যেসব গর্ত ওপরের দিকে ছিল, সেগুলো এখন দেখা যাচ্ছে নিচের দিকে। এই পরিবর্তন বিজ্ঞানীকে অবাক করে দিল। তিনি ভাবলেন, কেন এমন হলো?

উত্তর খুঁজতে বিজ্ঞানীর মনে পড়ল নিউজিল্যান্ডের কথা। দক্ষিণ মেরুতে আসার সময় নিউজিল্যান্ড হয়েই আসতে হয়ে তাঁকে। সেখান থেকেই কিনেছিলেন কিছু শীতের পোশাক। নিউজিল্যান্ডে রাতের আকাশে তিনি আকাশের তারা বা নক্ষত্র দেখেছিলেন। উত্তর গোলার্ধে থাকতে নক্ষত্রগুলোকে মনে হয়েছিল এক যোদ্ধা ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এখনই তির ছুড়ে মারতে প্রস্তুত। তবে নিউজিল্যান্ডের আকাশে নক্ষত্রগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, সে উল্টো হয়ে হাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে তাঁর মনে হলো, আকাশের সবকিছুই যেন উল্টো হয়ে গেছে। উত্তর গোলার্ধে তিনি যা দেখে অভ্যস্ত ছিলেন, তার সবকিছুই এখানে বিপরীত।

এই ছোট্ট পরীক্ষা থেকে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। আমরা যত দূরেই তাকাই না কেন, শুধু সমতল ভূমিই দেখতে পাবো। মানে বলতে চাইছি, পৃথিবীতে থেকে তুমি বুঝতেই পারবে না যে পৃথিবী গোলাকার।

এই রহস্যের সমাধান খুঁজতে হলে আমাদের একটু দূরে যেতে হবে। আসলে যেতে হবে পৃথিবীর বাইরে। সেখান থেকে দেখতে হবে পৃথিবীকে। তাহলে পৃথিবীকে একটি গোলাকার বলের মতো দেখাবে। আর সে যদি কোনো সুপারহিরো হয়, মানে পৃথিবীর বাইরে থেকে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মানুষ দেখতে পায়, তাহলে সে দেখবে দক্ষিণ মেরুর মানুষ আর উত্তর মেরুর মানুষ একে অপরের তুলনায় উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিরক্ষরেখার মানুষদের মনে হবে যেন তারা পৃথিবীর পাশ থেকে সোজা বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছে। এমনকি একই নিরক্ষরেখায় থাকা কলম্বিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার মানুষদেরও পরস্পরের তুলনায় উল্টো দেখাবে। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে থেকে যাদের দেখা হচ্ছে, তারা কিন্তু কেউ উল্টো হয়ে নেই। সবার পা মাটিতে এবং ওপরে আকাশ।

আরও পড়ুন

এর পেছনে কারণ কী? আসলে পৃথিবী একটি বিশাল বল। এই বলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রতিটি মানুষকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টেনে রাখে। সে জন্যই আমরা লাফ দিলে আবার মাটিতে নেমে আসি। আর পৃথিবী যেদিকে আমাদের টানে, সেই দিকটাই আমাদের কাছে ‘নিচ’।

পৃথিবী
রয়টার্স

ব্যাপারটা আরও সহজে বুঝতে হলে একটি ছোট্ট পরীক্ষা করতে হবে। একটি ক্রিকেট বলকে দুই আঙুল দিয়ে ধরো। একটা আঙুল ওপরের দিকে, আরেকটা নিচের দিকে। এখন দুটি আঙুল দিয়ে তুমি বলের দুই পাশে স্পর্শ করেছ। কিন্তু আঙুলের দৃষ্টিতে, ওপরের আঙুলের নিচে আছে বল। আবার নিচের আঙুলের কাছেও মনে, ওই আঙুলের নিচে আছে বল। কিন্তু তুমি কিন্তু ঠিকই দেখতে পাচ্ছ, বলের ওপর একটা আঙুল নিচে, আরেকটা ওপরে। পৃথিবীর ক্ষেত্রেও ঠিক এমনই হয়। আমরা সবাই আছি পৃথিবী নামে বিশাল গোলকের পৃষ্ঠে। মাধ্যাকর্ষণ আমাদের টেনে রাখে কেন্দ্রের দিকে। এই টানই হলো ‘নিচ’। আমরা এখানে হাতের আঙুলের মতো। যেদিক থেকেই দেখি না কেন, পৃথিবীকে আমাদের নিচে মনে হয়। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে গেলে বোঝা যাবে, একটা নিচে, আরেকটা ওপরে। বলের ক্ষেত্রে যেমন তুমি দেখতে পাচ্ছ, দুটি আঙুল পরস্পরের বিপরীত দিকে আছে।

পৃথিবীকে একটি গোলাকার বলের মতো দেখাবে। আর সে যদি কোনো সুপারহিরো হয়, মানে পৃথিবীর বাইরে থেকে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর মানুষ দেখতে পায়, তাহলে সে দেখবে দক্ষিণ মেরুর মানুষ আর উত্তর মেরুর মানুষ একে অপরের তুলনায় উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এই ছোট্ট পরীক্ষা থেকে আরও একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। আমরা যত দূরেই তাকাই না কেন, শুধু সমতল ভূমিই দেখতে পাবো। মানে বলতে চাইছি, পৃথিবীতে থেকে তুমি বুঝতেই পারবে না যে পৃথিবী গোলাকার। তা বুঝতে হলে যেতে হবে পৃথিবীর বাইরে। এই বৈচিত্র্যই হয়তো পৃথিবীর সৌন্দর্য। একই আকাশের নিচে আমরা প্রত্যেকে বাস করলেও ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য দেখি।

আর দক্ষিণ মেরুর মানুষেরা উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কি না, তা নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। মহাকাশ থেকে দেখলে ‘হ্যাঁ’, কিন্তু পৃথিবীতে থেকে দেখলে ‘না’।

সূত্র: কিউরিয়াস কিডস

আরও পড়ুন