মাইনক্র্যাফটের ভেতরে গোপন গ্রন্থাগার
তুমি কি কখনও ভেবেছো, যদি কোনো দেশে বই বা সংবাদ লেখা নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তখন সেই লেখা কোথায় থাকবে? আজ তোমাদের এমন এক রহস্যময় জগতের গল্প শোনাবো—যেখানে একটি খেলার ভেতরেই তৈরি হয়েছে এক গোপন গ্রন্থাগার, যে লড়াই করে সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে। এর নাম দ্য আনসেন্সর্ড লাইব্রেরী।
খেলাটির নাম মাইনক্রাফট। তোমরা হয়তো মাইনক্র্যাফ্ট গেমের নাম শুনেছো। অনেকেই হয়তো খেলেছোও। এটা এক আশ্চর্য খেলা, যেখানে তুমি ব্লক জোড়া দিয়ে নিজের মতো করে একেবারে নতুন জগত বানাতে পারো—বাড়ি, পাহাড়, দুর্গ, এমনকি পুরো শহরও! এই খেলায় কল্পনার কোনো শেষ নেই। কেউ শুধু খেলে আনন্দ পায়, কেউ আবার এর ভেতরে বানিয়ে ফেলে স্কুল, জাদুঘর কিংবা দারুণ দারুণ শিল্পকর্ম। তাই বলা হয়, মাইনক্র্যাফ্ট শুধু একটা খেলা নয়, এটা একেবারে একটা কল্পনার ক্যানভাস।
২০২০ সালের ১২ মার্চ, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস নামের একটি সংগঠন ব্লক ওয়ার্কস, ডিডিবি বার্লিন আর মিডিয়া মঙ্কস-এর সঙ্গে মিলে মাইনক্র্যাফ্টে তৈরি করে এই আশ্চর্য গ্রন্থাগার। এর ভেতরে রাখা আছে নানা দেশের এমন লেখা, যেগুলো সেখানে নিষিদ্ধ বা সেন্সর করা হয়েছে। মাইনক্র্যাফ্ট খেলতে গেলে তুমি এই লাইব্রেরিতে ঢুকে বইগুলো পড়তে পারবে, কিন্তু কেউ সেগুলো পরিবর্তন করতে পারবে না। অনেক দেশে ইন্টারনেট আর সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু মাইনক্র্যাফ্ট সহসা বন্ধ হয় না। সেই সুযোগটাই ব্যবহার করা হয়েছে সত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে।
তোমাদের অনেকেই হয়তো ভাবছো—একটা গেমে এসব রাখার দরকার কী? আসলে খেলা শুধু বিনোদনের জায়গা নয়, এখানে লুকিয়ে আছে বড় শক্তি। যেসব দেশে সত্য বলা কঠিন, সেসব দেশের তরুণরাও মাইনক্র্যাফ্ট খেলে। ফলে এই লাইব্রেরি তাদের হাতে তুলে দেয় এমন লেখা, যা তারা অন্যভাবে পেত না। খেলার ভেতর দিয়ে তারা জানতে পারে বাস্তব জগতের গল্প।
এই গ্রন্থাগার বানাতে লেগেছে প্রায় ১২.৫ মিলিয়ন ব্লক! এর নকশা করা হয়েছে পুরোনো যুগের বড় বড় লাইব্রেরির মতো চমৎকার স্থাপত্যে। প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা অংশ আছে, যেমন রাশিয়া, মেক্সিকো, মিশর, সৌদি আরব বা ভিয়েতনাম। সেখানে রাখা হয়েছে সেইসব লেখা, যেগুলো তাদের দেশে পড়া যেত না। ২০২৩ সালে এতে নতুন এক কক্ষ যুক্ত হয়েছে, যেখানে রাখা হয়েছে ইরান সম্পর্কিত লেখা।
লাইব্রেরিটি শুধু খেলোয়াড়দের জন্যই নয়, বিশ্বজুড়ে সাংবাদিক আর শিল্পীরাও এটিকে দেখছেন প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই গ্রন্থাগারটি নিয়ে হয়েছে অসংখ্য আলোচনা। অনেকেই এটিকে বলছেন—‘গেমের ভেতর স্বাধীনতার দুর্গ’। এই কারণে এটি কেবল ভার্চুয়াল জগতের প্রকল্প নয়, বাস্তব জগতেও এর প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বই এর পাশাপাশি এখানে তুমি পাবে আরও নানান তথ্য। আছে বিশ্বের ১৮০টি দেশের প্রেস স্বাধীনতার সূচি। কিছু অংশে রাখা হয়েছে সাংবাদিকদের স্মৃতিচিহ্নও—যাঁরা সত্য বলার জন্য জীবন দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত গ্রন্থাগারটি ডাউনলোড হয়েছে দুই লক্ষাধিক বার, আর নিয়মিত নতুন লেখা যুক্ত হচ্ছে।
ভাবো তো, একটি গেমের ভেতরে ঢুকেই তুমি পড়তে পারছো এমন বই, যা কোনো দেশে নিষিদ্ধ! বাস্তব জগতে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও ডিজিটাল জগতে কল্পনা আর প্রযুক্তি মিলে এমন এক শক্তি তৈরি করে, যা ভাঙতে পারে যেকোনো দেয়াল। এখানে বইগুলো নিরাপদ, কেউ জ্বালিয়ে ফেলতে পারবে না, কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।
দ্য আনসেন্সর্ড লাইব্রেরি আমাদের শেখায়—যেখানে যৌক্তিক সকল পথ বন্ধ, সেখানে কল্পনা আর প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারে স্বাধীনতার পথ। একটি বই হয়তো আগুনে পুড়ে যেতে পারে, কিন্তু গেমের এই গ্রন্থাগারে সত্যগুলো থেকে যাবে চিরকাল।
সূত্র: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, ব্লকওয়ার্কস,মাইনক্রাফট ডটনেট, ৯৯% ইনভিজিবল, আনসেনসরড লাইব্রেরি ডটকম