আবর্জনা কোথায় যায়

একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে শূন্য দশমিক ৭৪ কেজি আবর্জনা তৈরি করে। এগুলো রাস্তায় পড়ে থাকে, জমা হয় বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায়। এলাকাভেদে এই আবর্জনাগুলোর ব্যবস্থাপনা হয় ভিন্নভাবে। কোনো এলাকার রাস্তা একদম পরিষ্কার। কোনো এলাকায় আবার যেখানে-সেখানে ময়লা পড়ে থাকে। সাধারণত শহর অঞ্চলে সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে ময়লা নিয়ে যায়। প্রথমে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে ভ্যানে করে আবর্জনা জমা হয় সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে (এসটিএস)। গাড়ি এসে সেখান থেকে আবর্জনা ডাম্পিং গ্রাউন্ডে নিয়ে যায়। শহরে ময়লার গাড়ি এসে প্রতিদিন আবর্জনা নিয়ে গেলেও গ্রামে এই সুবিধা তেমন দেখা যায় না। বাড়ির ধারে কোনো গর্ত, রাস্তার ধারে কোনো জায়গা, এমনকি খালে-বিলে ময়লা জমা হতে থাকে।

শহর ও গ্রামে রাস্তাঘাটে খোলা জায়গায় প্রচুর ময়লা ফেলা হয়। এই ময়লাগুলো কোথায় যায়? বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে এগুলো ড্রেনে চলে যায়। ড্রেন থেকে নদীতে। নদী থেকে একসময় জমা হয় সমুদ্রে গিয়ে। শহরের রাস্তায় যে ময়লাগুলো ফেলা হয়, সাধারণত ঝাড়ুদার এসে রাতে সেগুলো ঝাড়ু দেন। এগুলো ট্রাকে চেপে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে চলে যায়।

অপচনশীল আবর্জনার এক বড় অংশ প্লাস্টিক। প্রচলিত ধারণা হলো, প্লাস্টিকের বোতলগুলো সংগ্রহ করে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে বোতলগুলো রিসাইকেল হয়। তবে গবেষকেরা বলছেন, প্লাস্টিক রিসাইকেল একধরনের মিথ। বিশ্বব্যাপী মাত্র ৯ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইকেল হয়। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক মাত্র একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়, যার পরিমাণ প্রতিবছরে ৩৮০ মিলিয়ন টন।

আবর্জনাকে পচনশীল ও অপচনশীল—এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। পচনশীল ময়লা ডাম্পিং গ্রাউন্ডে জমা হয়। মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে মিশে যায় মাটিতে। ডাম্পিং গ্রাউন্ডের বাইরে জমা হলে মাটিতে সার হিসেবে কাজ করে। অপচনশীল আবর্জনা কয়েক শ বছর মাটিতে মেশে না। এগুলো বায়ু-মাটি-পানিকে দূষিত করে। কখনো ময়লার ভাগাড়ে আগুন লাগিয়ে ময়লার কিছু অংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে কার্বন ডাই–অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়।

একটি প্লাস্টিকের পানির বোতল একবার ব্যবহার করে ফেলে দিলে এই বোতল কোথায় যায়? মূল প্রশ্ন হলো, কোনো আবর্জনার শেষ গন্তব্য কোথায়? একটি প্লাস্টিকের বোতল অনুসরণ করলে আবর্জনার গন্তব্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ধরা যাক, ঢাকার আদাবর এলাকায় কেউ একজন আধা লিটার পানি খেয়ে রাস্তায় বোতলটা ফেলে দিল। বাসায় নিয়ে গিয়ে ময়লার বিনে ফেলে দিলেও প্রায় একই ঘটনা ঘটবে। একজন ময়লা সংগ্রহকারী বোতলটি নিয়ে শ্যামলীর সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে নিয়ে গেল। এখানে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। এখান থেকে বেছে নিয়ে ভাঙারির দোকানে বোতলটি বিক্রি করা হতে পারে। এই বোতল রিসাইকেল হয়ে আবার তৈরি হতে পারে কোনো প্লাস্টিকের পণ্য। কিন্তু রিসাইকেল করার তুলনায় নতুন প্লাস্টিক তৈরির খরচ কম। তাই ধরা যাক, রিসাইকেল হলো না। বোতলটি আমিনবাজারের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে জমা হবে। ৪০০ বছর ধরে যদি বোতলটি এখানে জমা থাকে, তাহলে এখানেই মাটিতে মিশে যাবে।

যদি কখনো বন্যা হয় বা আমিনবাজারের ডাম্পিং গ্রাউন্ডের কাছের নদী কর্ণতলীর পানি ছাপিয়ে বোতলটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে বোতলটি জোয়ার–ভাটার চক্করে বুড়িগঙ্গা বেয়ে একসময় গিয়ে পড়বে মেঘনা নদীতে। সেখান থেকে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে বঙ্গোপসাগরে। আমিনবাজার ময়লার ভাগাড়ের কথা ভাবা যাক। ভাগাড়ের একদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। অপর দিকে কর্ণতলী নদী। এই নদী ধলেশ্বরী বা সাভারের বংশী নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে আমিনবাজার সেতুর নিচে তুরাগের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। সারা বছর এই নদীতে পানি ও স্রোত থাকে। আমিনবাজারের ময়লার ভাগাড়ের চারপাশে জলা জায়গা। চারপাশে বছরের অধিকাংশ সময় পানি থাকে। এই প্লাস্টিকের বোতলটি কর্ণতলী নদী থেকে বঙ্গোপসাগরে যাবে। সেখান থেকে ভারত মহাসাগর হয়ে আটলান্টিকে চলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এখান থেকে ভেসে মধ্য উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ স্রোতে এই বোতল আবিষ্কার করা অসম্ভব না। শেষ পর্যন্ত কোনো এক সমুদ্র স্রোতে ভাসতে থাকাই হবে এই বোতলের শেষ গন্তব্য। এ ছাড়া সমুদ্রসৈকতে ভেসে এসে জমা হতে পারে বোতলটি।

এই প্রক্রিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ১০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে যায়। এভাবে চলতে চলতে ২০৫০ সালে প্লাস্টিকের পরিমাণ হয়ে যাবে মাছের চেয়েও বেশি। সামুদ্রিক পাখি, মাছ এবং প্রাণীদের জন্য প্লাস্টিক ও অন্যান্য আবর্জনা মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মাছের দেহে প্রবেশ করে। সেখান থেকে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে চলে আসে মানুষের শরীরে। ফলে একজন মানুষ সারা জীবনে প্রায় ১৮ দশমিক ১৪ কেজি প্লাস্টিক খাবারের সঙ্গে গ্রহণ করে। কারণ, প্লাস্টিকের কণা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব জায়গায় রয়েছে। যত দুর্গম জায়গা কল্পনা করা সম্ভব, সবখানেই প্লাস্টিক ছড়িয়ে গেছে। তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।