আমাদের ছোটবেলায় আমরা তেমন কাউকে চোখে চশমা পরতে দেখতাম না। এখন চারদিকে তাকালেই চোখে চোখে চশমা। আমি নিজেও চশমা পরি।
সাধারণ একটা ধারণা আছে, মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের পাওয়ার বা দেখার ক্ষমতা কমে যায়। এটা ভুল ধারণা। এলসিডি বা এলইডি স্ক্রিন থেকে যে আলো বেরিয়ে আসে, তা মূলত নীলাভ আলো। কেন, সেটা ভিন্ন আলোচনা। এককথায়, দিনের বেলায় দেখার জন্য এ আলো সুবিধাজনক। এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০-৪৫০ ন্যানোমিটার।
প্রশ্ন আসতে পারে, এই ভুল ধারণা তাহলে কোত্থেকে এল। উত্তর, প্রথমত, এই আলো কারও কারও (সবার না) ঘুমের সমস্যা করতে পারে। সার্কাডিয়ান চক্র মানুষের ঘুমের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। নীলাভ আলো এই চক্রে ব্যাঘাত ঘটায়। এ জন্য ঘুমের আগে আগে মোবাইল চালাতে চিকিৎসকেরা নিষেধ করেন। এ রকম সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আরেকটি বিষয় হলো, উজ্জ্বল যেকোনো আলোর দিকে দীর্ঘ সময় টানা তাকিয়ে থাকলে রেটিনা দুর্বল বা ক্লান্ত হয়ে যায়। সূর্যের আলো বা হঠাৎ ফ্ল্যাশলাইট চোখে পড়লে এটা তাৎক্ষণিক বোঝা যায়। যেকোনো যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসা আলোর দিকে দীর্ঘ সময় টানা তাকিয়ে থাকলেও এটা ঘটে। তাই যাঁরা দীর্ঘ সময় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন, চিকিৎসকেরা তাঁদের ২০-২০-২০ নামে একটা নিয়ম মানতে বলেন। এ নিয়ম বলে, প্রতি ২০ মিনিট পর একবার অন্তত ২০ সেকেন্ডের জন্য বিরতি নেওয়া উচিত এবং ২০ ফুট দূরের কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে থাকা উচিত। যাতে চোখ বিশ্রাম পায়।
যা–ই হোক, প্রসঙ্গে ফিরি। চোখে সমস্যা হলে আমরা যে চশমা পরি, কখনো ভেবেছ, এই চশমা কোত্থেকে কীভাবে এল? একটু থেমে চিন্তা করো তো! বাতির নিচে অন্ধকার কথাটির যথার্থ উদাহরণ এটি। যে চশমা আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর অন্যতম, তার গল্পটা আমরা বলতে গেলে জানিই না! তাহলে চলো, শুনে আসি চশমার গল্প।
২
দশম শতকে মঙ্করা প্রথম এ ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের ক্যালিগ্রাফি করতেন। এই ক্যালিগ্রাফির ডিটেলস ভালোভাবে বোঝার জন্য স্বচ্ছ কোয়ার্টজ পলিশ করে তাঁরা বানিয়েছিলেন ‘রিডিং স্টোন’।
এরপরের দুই শতকে এ নিয়ে তেমন নতুন কোনো কাজ হয়নি। ১৩ শতকের দিকে এসে কয়েকটি রিডিং স্টোনকে একসঙ্গে ফ্রেমের মধ্যে বসিয়ে, নাকে পরার ব্যবস্থা করা হয়। তৈরি হয় ‘রিডিং গ্লাস’। সহজ করে বললে, এটাকে বলা যায় আধুনিক চশমার পূর্বপুরুষ। কথিত আছে, ফ্লোরেন্সের সালভিনো ডি’আরমাতি নামের একজন এটি করেছিলেন। ইতিহাসবিদেরা এ নামে আদৌ কেউ ছিলেন কি না, সে ব্যাপারে সন্দিহান। তাই চশমার সত্যিকার আবিষ্কারক যে কে, তা আজও অজানা।
প্রথম দিকে চশমা বানানো হতো বেশ দামি পদার্থ দিয়ে। যেমন, ক্রিস্টাল। সে জন্য সাধারণ মানুষ এগুলো ব্যবহার করতে পারত না। ১৪৪০ সালের দিকে যখন প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবহার শুরু হয়, তখন শিক্ষার হার বেড়ে যায় অনেক। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে রিডিং গ্লাসের চাহিদা। ফলে অনেকে ক্রিস্টালের বদলে সাধারণ কাচ দিয়ে চশমা বানাতে শুরু করেন।
তখনো চশমা আধুনিক রূপ পায়নি। নাকের ওপর বসানোর ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু হাত দিয়ে ধরে রাখতে হতো। তা ছাড়া পাওয়ারের ভিন্নতার ওপর নির্ভর করে কাচের পুরুত্ব কমানো-বাড়ানোর কাজ খুব বেশি মানুষ জানত না।
১৭০০ সালের দিকে এসে প্রথম কানে পরার মতো চশমার উদ্ভাবন হয়। তারপর বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বাইফোকাল লেন্স উদ্ভাবন করেন। বাইফোকাল কাচে দুই ধরনের পাওয়ারযুক্ত কাচ ব্যবহার করা হয়। ওপরের অংশ দিয়ে দূরে দেখা যায়, আর নিচের অংশ দিয়ে কাছে দেখা যায়। এই নিচের অংশটি পড়া বা সেলাইয়ের মতো কাজে লাগে। সাধারণত বয়স্করা এ ধরনের চশমা বেশি পরেন। এর কিছুদিন পরে আবিষ্কৃত হয় কবজা। দরজার কিনারায় বা যেকোনো কিছু যেখানে বাঁকানো হয়, সেখানে কবজা লাগানো থাকে। চশমা যেখানে ভাঁজ করা হয়, সেখানে থাকে কবজা। এই কবজাযুক্ত চশমা আসার পর মানুষ চশমা ভাঁজ করে পকেটে রাখা শুরু করে।
১৮০০ সালের দিকে আবিষ্কৃত হয় সিলিন্ড্রিক্যাল লেন্স। বিষয়টি ছোট্ট এ লেখায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা কঠিন। সহজ করে বললে, তোমরা যারা চোখের চিকিৎসক দেখিয়েছ, নিশ্চয়ই দেখেছ, চিকিৎসক একটা স্ফেরিক্যাল পাওয়ার লিখে দেন, আরেকটা সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার লিখে দেন। চোখের মোট পাওয়ার ধরা হয় ৬.০০ (কীভাবে, তা আরেকটা ভিন্ন আলোচনা)। স্ফেরিক্যাল পাওয়ার মানে, চোখের মোট পাওয়ার থেকে তোমার পাওয়ার কতটা কম আছে। -৩.০০ স্ফেরিক্যাল পাওয়ার মানে, ৬–এর মধ্যে তোমার পাওয়ার ৩ কম আছে। লেন্সের পাওয়ার যত বেশি হয়, কাচ তত মোটা হয়। আর পাওয়ার প্লাস (+) মানে তুমি ঠিকভাবে কাছে দেখতে পাও না, মাইনাস (-) মানে তুমি ঠিকভাবে দূরের জিনিস দেখতে পাও না। সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার মানে, তোমার চোখের কর্নিয়ার আকৃতিতে সামান্য সমস্যা আছে। সে জন্য আলো সোজাসুজি তোমার চোখের রেটিনায় গিয়ে পড়তে পারছে না। সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ারের পাশেই একটা অ্যাক্সিস বলা থাকে। ১৮০ ডিগ্রির মধ্যে কত ডিগ্রি কোণে লেন্সটা ঘুরিয়ে দিলে তোমার কর্নিয়া হয়ে আলোটা সঠিকভাবে রেটিনায় গিয়ে পড়তে পারবে, এটাই সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ারের কাজ। অবশ্যই এখানে পুরো বিষয়টা অতিসরলীকরণ করে বলা হয়েছে। চোখের চিকিৎসকেরা এত সহজ ব্যাখ্যা দেখে রাগ করতে পারেন। কারণ, বিষয়টি আসলে একটু জটিল।
১৮৬২ সালে চোখের চিকিৎসা এবং চশমার পাওয়ার নির্ধারণে চমৎকার এক উদ্ভাবন হয়। হারমান স্নেলেন তৈরি করেন ‘বিগ ই’ চার্ট। চিকিৎসক তোমাকে রুমের উল্টো দিকে বসিয়ে যে চার্টটা দেখিয়ে বিভিন্ন অক্ষর পড়তে বলেন, সেটাই বিগ ই চার্ট। সাধারণত এই চার্টের ওপরের বড় অক্ষরটি হয় বড় হাতের ই, তাই এমন নামকরণ। একে স্নেলেন চার্টও বলা হয়। আজকাল চার্টে অন্যান্য অক্ষর বা সংকেতও ব্যবহৃত হয়।
সংক্ষেপে এই হলো চশমার ইতিহাস। স্বাভাবিকভাবেই ছোট্ট এ লেখায় চশমার ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ও ঘটনা বাদ পড়েছে। তবে সংক্ষেপে বললে, এভাবেই প্রায় দুই হাজার বছর ধরে অনেক মানুষের পরিশ্রমে উন্নত হতে হতে এসেছে আজকের চশমা।
৩
বর্তমানে চশমার আরও উন্নতি হচ্ছে। চশমার উন্নতি হয়েই এসেছে আধুনিক কন্টাক্ট লেন্স। যেখানে আলাদা করে চশমা পরতে হয় না। চোখের মণির ওপর ছোট্ট লেন্স পরে নিলেই হয়।
এ ছাড়া আছে ‘স্মার্ট গ্লাস’। চোখের পাওয়ার ঠিক করে কাছে বা দূরে দেখা যার কাজ নয়। বরং এটি দিয়ে চশমার মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকা যায়। বিভিন্ন ছবি বা ভিডিও দেখা যায় চশমাতেই। এগুলো একসময় বিজ্ঞান কল্পকাহিনির অংশ ছিল। এখন এগুলো বাস্তব। অনেকে এগুলোকে ‘পরিধানযোগ্য কম্পিউটার গ্লাস’ও বলেন।
স্মার্ট গ্লাসের অংশ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলো ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি বা অগমেন্টেড রিয়েলিটি। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি মানে সিমুলেশন করে বিভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করা। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি গ্লাস বা চশমার মাধ্যমে গেমস খেলা যায়, বিমান চালানোর জন্য বৈমানিকদের বা চিকিৎসকদের অপারেশনের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। পাশাপাশি অগমেন্টেড রিয়েলিটির মাধ্যমে বাস্তবতা ও সিমুলেশনের মিশেল ঘটানো যায়। ব্যবহারকারী চাইলে সরাসরি তাতে প্রভাব রাখতে পারেন, পরিবর্তন করতে পারেন ঘটনাপ্রবাহে।
যুগে যুগে চশমা অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। একসময় হয়তো চশমার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যাবে আমাদের চিন্তাপ্রবাহ। স্মৃতি থেকে সবকিছু ভিডিওর মতো দেখা যাবে চশমায়! এটি এখনো বিজ্ঞান কল্পকাহিনির অংশ। তবে যেভাবে প্রযুক্তি এগোচ্ছে, কখনো যে এটি বাস্তব হয়ে উঠবে না, তা বলার উপায় নেই। উপায় নেই এই সম্ভাবনাকে শুধুই কল্পগল্প বলে উড়িয়ে দেওয়ার।
৪
শেষের আগে একটা বিষয় বলি। তোমরা যারা চশমা পরো এবং দূরে দেখতে পাও না, অর্থাৎ মাইনাস পাওয়ার, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অবশ্যই নিয়মিত চশমা পরবে। আর যারা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকো, অবশ্যই ২০ মিনিট পরপর একটু বিশ্রাম দেবে চোখকে।
চোখ এক অমূল্য সম্পদ। চশমা পরো বা না পরো, নিয়মিত এর পরিচর্যা করা উচিত।