বিশ্বকাপের তরুণ তারকা

পর্দা নেমে গেছে এক দিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপের, আবারও অপেক্ষা দীর্ঘ চার বছরের। কিন্তু এরই মধ্যে ক্রিকেট–ভক্তরা খোঁজ পেয়ে গেছেন আগামীর তারকাদের। শচীন-লারা-ম্যাকগ্রা থেকে শুরু করে হাল আমলের কোহলি-সাকিব-ওয়ার্নারদের বিপুল তারকাখ্যাতির শুরুটা এমন কোনো এক বিশ্বকাপের মঞ্চেই ছিল। এবারের বিশ্বকাপ অভিষেকের পর আগামীর ক্রিকেট-বিশ্বকে শাসন করতে চলা সেই সব ক্রিকেটারের কথাই থাকবে আজকের এই লেখায়।

রাচিন রবীন্দ্র (নিউজিল্যান্ড)

মাথায় কোঁকড়া চুল আর চোখে বুদ্ধির ঝিলিক—রাচিনের দিকে তাকালে বই থেকে উঠে আসা কোনো এক প্রধান চরিত্র বলে মনে হয়। আসলে তা না হলেও নিউজিল্যান্ডের এবারের বিশ্বকাপ সফরে রাচিনকে প্রধান চরিত্র বললে ভুল হবে না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর পদচারণ দুই বছর হলেও এক দিনের ক্রিকেটে প্রায় নতুনই বলা যায় বাঁহাতি এই অলরাউন্ডারকে। বিশ্বকাপের আগে খেলেছেন মাত্র ১২টি ওয়ানডে। কিন্তু বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে যেভাবে ইংল্যান্ডের বোলারদের শাসন করে সেঞ্চুরি তুলে নিলেন, তাতে বোঝার উপায় নেই যে বড় মঞ্চে এর আগে কখনোই খেলেননি তিনি। এর পেছনে অবশ্য ভাগ্যের বড় হাত ছিল। অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন পুরোপুরি ফিট থাকলে হয়তো টপ অর্ডারে খেলাই হতো না রাচিনের। ক্রিকেট-বিশ্বও চিনতে পারত না তাঁকে। ভাগ্যের ফেরে পাওয়া সুযোগকে পুরোপুরি উশুল করে নিয়েছেন কিউই ক্রিকেটার। বাঁহাতি স্পিন বোলিংয়ে টুর্নামেন্টে নিয়েছেন ৫টি উইকেট, নিয়েছেন ৩টি ক্যাচও।

আবার ওয়ানডাউনে ব্যাটিং করার পাশাপাশি ওপেনিংয়ে নেমে দুটি হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে করেছেন তিনটি সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরিগুলোও ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। ব্যাট হাতে পেস ও স্পিন—দুটোই অত্যন্ত সাবলীলভাবে খেলেছেন রাচিন। এসবের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রাইক রেটটাও ছিল বলের সঙ্গে মানানসই। ব্যাটিংটা তাঁর বড় শক্তি হলেও পার্টটাইম স্পিন এবং দারুণ ফিল্ডিংয়ের কারণে অলরাউন্ডার হিসেবে নিজের অবদান রাখতে পারেন সব ক্ষেত্রে। এবারের টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায়ও ৪ নম্বরে ছিল রাচিনের নাম। অবশ্য এই নামের পেছনে অদ্ভুত এক কারণ আছে। ভারতীয় মা-বাবার পছন্দের দুই ক্রিকেটার—রাহুল দ্রাবিড় ও শচীনের নাম থেকে অক্ষর ধার করে নাম দিয়েছিলেন রাচিন। রাহুল ও শচীনের মতো ডানহাতি না হলেও ব্যাটিংটা যে ভালোই পারেন, সেটা ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও মনেপ্রাণে নিজেকে কিউই ভাবেন ২৩ বছর বয়সী রাচিন রবীন্দ্র। অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকের মতে, অলরাউন্ডার রাচিনের হাতেই থাকবে কিউইদের ভবিষ্যৎ ক্রিকেটের চাবিকাঠি।

দিলশান মাদুশঙ্কা (শ্রীলঙ্কা)

দিলশান মাদুশঙ্কা

স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে নড়বড়ে দল নিয়ে এবারের বিশ্বকাপে এসেছিল শ্রীলঙ্কা। ব্যাটিংয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতার মিশেল থাকলেও বোলিংয়ে বেশির ভাগই ছিল নতুন মুখ। তাঁদের মধ্যে আইপিএল খেলার কারণে কেবল পাতিরানার দিকেই সবার আগ্রহ ছিল বিশ্বকাপের আগে। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর পরপর ইনজুরিতে পড়ায় পাতিরানাকে নিয়ে তেমন আলোচনা আর হয়নি। এই সুযোগে নিজেকে আস্তে আস্তে মেলে ধরতে শুরু করেন লঙ্কান পেস আক্রমণের নবীনতম সদস্য মাদুশঙ্কা। যাঁর পুরো নাম লোকুমারাক্কালাগে দিলশান মাদুশঙ্কা। বাঁহাতি এই পেসারের নৈপুণ্যে ম্যাচও জেতে শ্রীলঙ্কা। ভারতের কন্ডিশনে মাদুশঙ্কার নতুন বলের ইনসুইং-আউটসুইং ভয়ংকর হয়ে ওঠে ব্যাটসম্যানদের জন্য। প্রায় নিয়মিতই পাওয়ারপ্লেতে ব্রেকথ্রু এনে দিতেন তিনি, পাশাপাশি ডেথ ওভারেও করতেন কার্যকরী বোলিং। সব মিলিয়ে মাত্র ২৩ বছর বয়সী এই পেসার চলে আসেন সবার নজরে। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব শেষে ৯ ম্যাচে ২১ উইকেট নিয়ে মাদুশঙ্কা ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক। যদিও শেষ পর্যন্ত টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক হিসেবেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে খেলার আড্ডা—সব জায়গায় তাঁকে নিয়ে হয়েছে আলোচনা। আগামী দিনে মাদুশঙ্কা ক্রিকেট-বিশ্বের অন্যতম ভয়ানক পেসার হিসেবে জায়গা করে নেবেন, এমনটা মনে করছেন অনেকেই।

শুবমান গিল (ভারত)

শুবমান গিল

সুনীল গাভাস্কার থেকে শুরু করে শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড় হয়ে বর্তমান সময়ের রোহিত-কোহলি—প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারতীয় ক্রিকেট একের পর এক দুর্দান্ত ব্যাটসম্যান উপহার দিয়ে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামীর তারকা হিসেবে অন্যতম বড় নাম শুবমান গিল। ২০১৮-এর অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ থেকেই তাঁকে নজরে রেখেছেন সবাই। ধীরে ধীরে ঘরোয়া ক্রিকেটের গণ্ডি পেরিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ আইপিএলে পারফর্ম করে পা রেখেছেন ভারতের জাতীয় দলে। এবারের বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার সঙ্গী হিসেবে ওপেন করার কথা ছিল তাঁরই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় খেলতে পারেননি প্রথম দুই ম্যাচে। কিন্তু সুস্থ হয়ে দলে ফেরার পর থেকে দেখাতে শুরু করেন নিজের ব্যাটিং দক্ষতা। কোনো সেঞ্চুরি না পেলেও চারটি হাফ সেঞ্চুরি করে ভারতকে দুর্দান্ত শুরু এনে দিয়েছেন অধিকাংশ ম্যাচেই। ডানহাতি গিল খেলতে পারেন প্রায় সব ধরনের শট। দারুণ টাইমিংয়ে বল খেলার বড় গুণ আছে তাঁর। দ্রুততম দুই হাজার ওয়ানডে রান সংগ্রাহক হিসেবে সম্প্রতি হাশিম আমলাকে পেছনে ফেলেছেন গিল। এর জন্য তাঁর সময় লেগেছে মাত্র ৩৮ ইনিংস। যে গতিতে তিনি দৌড়াচ্ছেন, তাতে ফর্ম না হারালে আরও অনেক রেকর্ড যে তাঁর পায়ে লুটাবে, সেটা বলতে জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রয়োজন নেই।

জেরাল্ড কোয়েৎজি (দক্ষিণ আফ্রিকা)

জেরাল্ড কোয়েৎজি

বিশ্বকাপের আগে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ধরা হচ্ছিল মাঝারি মানের দল হিসেবে। কিন্তু গ্রুপ পর্বে পয়েন্ট টেবিলে দাপটের সঙ্গে প্রোটিয়াদের ২ নম্বরে রাখার অবদান যে ক্রিকেটারদের, তাঁদের মধ্যে অন্যতম জেরাল্ড কোয়েৎজি। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমফন্টেইনে জন্ম নেওয়া কোয়েৎজি আগুনের গোলার মতো বল ছোড়েন ব্যাটসম্যানদের দিকে। নিয়মিতই ১৪০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে বল করেন তিনি। এ জন্য অনেকেই তাঁর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন সাবেক তারকা ফাস্ট বোলার ডেল স্টেইনের ছায়া। বোলিং অ্যাকশন এবং উদ্‌যাপনেও রয়েছে স্টেইনের ছায়া। নতুন কিংবা পুরোনো, যেকোনো বলেই স্বাচ্ছন্দ্যে বল করতে পারেন কোয়েৎজি। বোলিং করার ক্ষেত্রে তার মূল অস্ত্র গুড লেংথ এবং শর্ট লেংথের বল। এবারের বিশ্বকাপে মাত্র ৮ ম্যাচে ২০ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সেমিফাইনালে নিতে সাহায্য করেছেন ২৩ বছর বয়সী এই তরুণ। ইনিংসের মাঝের ওভারগুলোয় প্রায় নিয়মিতই ব্রেকথ্রু এনে দিয়েছেন তিনি। তাই টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকের তালিকায় ৫ নম্বরে ছিল তাঁর নাম।

মার্কো ইয়ানসেন (দক্ষিণ আফ্রিকা)

মার্কো ইয়ানসেন

কোয়েৎজি যদি হন ইনিংসের মাঝে আক্রমণ করার অন্যতম বড় অস্ত্র, মার্কো ইয়ানসেন প্রোটিয়াদের জন্য হবেন নতুন বলের মোক্ষম অস্ত্র। ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা ইয়ানসেন নিজের উচ্চতার জন্য বাড়তি বাউন্স আদায় করে নিতে জানেন। একই সঙ্গে জানেন নতুন বলকে দুই দিকে সুইং করানোর উপায়ও। সেই সুইংয়ের পেছনে যদি থাকে ১৪০ কিলোমিটারের বেশি গতি, তাহলে সেটা ব্যাটসম্যানদের জন্য হয় মারণাস্ত্র। শুধু যে দ্রুতগতিতেই বল করেন এমন নয়, মাঝে মাঝে স্লোয়ার দিয়েও পরাস্ত করেন প্রতিপক্ষকে। এবারের বিশ্বকাপে তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছে ১৭ উইকেট। পাশাপাশি ব্যাট হাতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছেন ৪২ বলে ৭৫ রানের ঝোড়ো ইনিংস। বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে ইয়ানসেনকে আগামীর ক্রিকেটে বড় তারকা ধরা হচ্ছে এখনই।

বাস ডি লিডি (নেদারল্যান্ডস)

বাস ডি লিডি

নেদারল্যান্ডসের কিংবদন্তি ক্রিকেটার টিম ডি লিডির ছেলে বাস ডি লিডির বিশ্বকাপ-অভিষেক নজর কেড়েছে অনেক ক্রিকেট–ভক্তের। ডাচরা আইসিসির সহযোগী সদস্য হলেও এবারের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশকে হারিয়ে শিরোনাম হয়েছে খবরের। এই দুই ম্যাচসহ বিশ্বকাপের প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই বল হাতে উইকেট নিয়েছেন বাস ডি লিডি। পুরোনো বলে সাধারণত মিডিয়াম পেসে ডেথ ওভারের বোলিং করেন তিনি। ৯ ম্যাচ খেলে ১৬ উইকেট নিয়ে তিনিই নেদারল্যান্ডসের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক। পাশাপাশি ব্যাট হাতেও খেলেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। অলরাউন্ডার হিসেবে তাই কমলা শিবিরের অন্যতম প্রধান ভরসা ডি লিডি।

ইব্রাহিম জাদরান (আফগানিস্তান)

ইব্রাহিম জাদরান
এএফপি

আইসিসির টেস্ট পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য আফগানিস্তানকে এবারের বিশ্বকাপে জায়ান্ট কিলার বললে ভুল হয় না। ৯ ম্যাচে ৪টিতে জিতে পয়েন্ট টেবিলের ৬ নম্বরে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করেছে তাঁরা। জাদুমন্ত্রে বদলে যাওয়া আফগানদের ব্যাটিংয়ে অন্যতম বড় স্তম্ভ ছিল ২১ বছর বয়সী ইব্রাহিম জাদরান। প্রায় সব ম্যাচেই ব্যাট হাতে ভালো সূচনা এনে দিয়েছেন দলকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৭ রানের দারুণ ইনিংস খেলে দলকে একটি জয়ও উপহার দেন তিনি। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে প্রথম আফগান হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন ইব্রাহিম। কিন্তু ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংসের কাছে ম্লান হয়ে যায় তাঁর ১২৯ রানের ইনিংসটি। সেই ম্যাচে পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে ছিলেন অপরাজিত। তাই এবারের বিশ্বকাপে দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ইব্রাহিম জাদরানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন আফগান ক্রিকেট–ভক্তরা।

আজমতউল্লাহ ওমরজাই (আফগানিস্তান)

আজমতউল্লাহ ওমরজাই

আফগানদের তারুণ্যনির্ভর দলে এবারের বিশ্বকাপের নতুন আবিষ্কার অলরাউন্ডার ওমরজাই। মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করার পাশাপাশি ডানহাতি মিডিয়াম পেসে দারুণ কার্যকর ওমরজাই। বিশ্বকাপের আগে মাত্র ১৩টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। কিন্তু বিশ্বকাপে এসে নবী, রশিদ, মুজিবকে ছাপিয়ে অলরাউন্ডার হিসেবে নজর কেড়েছেন সবার। ব্যাট হাতে তিনটি অর্ধশতকে করেছেন ৩৫৩ রান, যেখানে তাঁর গড় ৭০.৬০। বল হাতে নিয়েছে ৭ উইকেটও। ম্যাচের মধ্যে যখনই আফগানিস্তান উইকেটের খোঁজ করেছে, বোলিংয়ে এসে এনে দিয়েছেন কাঙ্ক্ষিত ব্রেকথ্রু। মাত্র ২৩ বছর বয়সী ওমরজাইয়ের ওপর আফগান ক্রিকেট তাকিয়ে থাকবে বড় অর্জনের জন্য।

এ ছাড়া এবারের বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে এসে যে তরুণেরা সম্ভাবনার আলো ছড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন আরিয়ান দত্ত (নেদারল্যান্ডস), নুর আহমাদ (আফগানিস্তান), রহমানউল্লাহ গুরবাজ (আফগানিস্তান), শরীফুল ইসলাম (বাংলাদেশ), মোহাম্মাদ ওয়াসিম জুনিয়র (পাকিস্তান), আবদুল্লাহ শফিক (পাকিস্তান)।