রহস্যে ঘেরা শব্দগুলো

শব্দের অর্থ বদলায়। হরহামেশা নয়। অনেক সময় নেয়। কখনো এক শ-দেড় শ বছর। কখনোবা চার-পাঁচ শ বছর কিংবা তারও বেশি। আর ব্যাপারটা শুধু বাংলা ভাষাতেই নয়, সব ভাষাতেই হয়। ভাষায় আসা অন্য ভাষার শব্দের অর্থেরও বদল হয়। মজার ব্যাপার, বদলটা শুধু অর্থের বেলাতেই নয়, শব্দের চেহারাতেও হয়। যেমন ইংরেজি জেনারেল বাংলায় হয়ে যায় জাঁদরেল। শব্দের এসব বদল বা পরিবর্তন নিয়েই অভিধানের গল্প। গল্প, তবে বানোয়াট নয়।

সরঞ্জাম

সরঞ্জাম বাংলায় অত্যন্ত দরকারি শব্দ। সরঞ্জামের জোগাড়যন্ত্র ঠিকমতো না হলে কোনো কাজ যথাসময়ে শুরু করা যায় না, শেষও করা যায় না। সরঞ্জাম শব্দের অর্থ উপকরণ, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ইত্যাদি। সরঞ্জাম শব্দের আগে সাজ বলে একটা শব্দ প্রায়ই বসে। তাতে অবশ্য অর্থের তেমন হেরফের হয় না। সরঞ্জাম ফারসি ভাষা থেকে আসা শব্দ। ফারসি সার আনজাম—বাংলায় হয়েছে সরঞ্জাম।

দেখা যাচ্ছে, ফারসি শব্দটার সঙ্গে বাংলা হয়ে যাওয়া সরঞ্জাম শব্দের উচ্চারণে তেমন অমিল নেই। কিন্তু অর্থের বেলায় ফারাকটা বিস্তর। ফারসি সার আনজাম শব্দের অর্থ শেষ, অন্তিম, পরিণতি, শেষ পর্যন্ত। অর্থের এতটা পার্থক্য নিয়ে ফারসি শব্দটা বাংলায় কীভাবে সরঞ্জাম হয়ে এল, তা রীতিমতো এক রহস্য। এ রহস্যের কূলকিনারা কোথাও পাইনি। তাই গল্পটা বলেই আমি খালাস।

জন্য

বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহূত একটা শব্দ হলো জন্য। নানা অবস্থায় আমরা জন্য বা জন্যে শব্দটা নিত্য ব্যবহার করি। শব্দটি ব্যবহূত হয় কারণ, নিমিত্ত, হেতু ইত্যাদি অর্থে।

জন্য তৎসম শব্দ। অর্থাৎ এর মূল ভাষা হলো সংস্কৃত। কিন্তু কী জন্য যে শব্দটা বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছিল কে জানে!

যে জন্য এই কথাটা বলা, সেটাই এবার বলি। শব্দের একাধিক অর্থ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সংস্কৃত ভাষার জন্য শব্দটির অর্থের ধরনটা বহু বিচিত্র। এমনকি বিপরীতমুখীও বটে।

সংস্কৃত জন্য শব্দটির মূল অর্থ জায়মান অর্থাৎ যা জন্ম নিচ্ছে, জাত, উত্পাদক, জনক, বধূ, বধূর নর্মসহচরী, বরের সহচর, মায়ের সখী, বরযাত্রী, হাট, যুদ্ধ, জনহিতকর—আর কত বলব?

শব্দের এ রকম বহু বিচিত্র চরিত্রের সঙ্গে সচরাচর দেখা মেলে না। বাংলা ভাষায় যাই-ই হোক, সংস্কৃত ভাষার জন্য শব্দের প্রতিটি অর্থই খুঁজে পাওয়া যায়।

কবজা

কবজা আরবি শব্দ। মূল অর্থ হাতের কবজি। প্রথমে ফারসি—তা থেকে উর্দুর মাধ্যমে বাংলায় প্রবেশ। ফারসি-উর্দুতে কবজা হলো যার দ্বারা দরজা-জানালার পাল্লা চৌকাঠের সঙ্গে আটকানো যায়, সেই জিনিসটা। দরজার হাতলও ফারসি-উর্দুতে কবজা। তবে বাংলায় নয়।

মোটকথা, কবজার কাজ কোনো কিছুকে ধরে রাখা, আটকে রাখা। বাংলায় তা থেকে হলো কবজা করা অর্থাৎ কারও সম্পত্তি কবজা করা অথবা কাউকে কবজার মধ্যে নিয়ে আসা। এগুলো সবই নেতিবাচক অর্থ। কাজগুলো সব ধূর্ত লোকের।

ভাষার রসায়ন খুব রহস্যময়। কিসের সঙ্গে কী মিলে কী যে তৈরি হবে, তার কূলকিনারা পাওয়া ভার।

ওই যে ধরে রাখা, আটকে রাখা—কবজার যে কাজ, ধূর্ত লোকেরা ওটাকে নিজেদের মুখের ভাষায় কবজা করে ফেলল। বাংলা ভাষায় শুরু হলো কবজা শব্দের ভিন্ন ধরনের ব্যবহার। ভূমিকাতেই বলেছি শব্দের অর্থের এ রকম পরিবর্তন অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।

সচরাচর

সচরাচর তৎসম অর্থাৎ মূলত সংস্কৃত শব্দ। বাংলা ভাষায় শব্দটি আসার পর তার অর্থের যে দুর্গতি ঘটেছে—এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। সচরাচর ঘটেও না। বাংলায় সচরাচর শব্দের অর্থ সাধারণত, সাধারণভাবে, প্রায়ই ইত্যাদি।

সংস্কৃত ভাষায় সচরাচর শব্দের যে অর্থ—তা বলার আগে খানিকটা ভূমিকা করতে হচ্ছে। তারপর দেখা যাবে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

সচরাচর শব্দের প্রধান অংশ হলো চরাচর। চর ও অচর মিলে দ্বন্দ্ব্ব সমাসে চরাচর। চর শব্দের অর্থ জঙ্গম অর্থাৎ যা চলনশীল। আর অচর হলো স্থাবর অর্থাৎ যার নড়াচড়া নেই। সংস্কৃতে চরাচর শব্দের অর্থ সমগ্র জগৎ। বাংলায় চরাচরের আগে কখনো কখনো বিশ্ব শব্দটা বসে হয় বিশ্বচরাচর।

সচরাচর বহুব্রীহি সমাসবদ্ধ বিশেষণ পদ। অর্থ হলো বিদ্যমান চরাচর, জঙ্গম ও স্থাবরের সঙ্গে অর্থাৎ স্থাবর জঙ্গমাত্মক অথবা ব্যক্ত-অব্যক্তক।

অলংকরণ

সমস্যা

সমস্যা বাংলা ভাষায় জটিল একটি তৎসম শব্দ। সমস্যা যে কত রকমের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। জীবন সংসারের প্রতি পদে পদে সমস্যা তৈরি হতে পারে। সমস্যা অন্য লোকেরাও তৈরি করতে পারে—সমস্যার কবল থেকে মানবদেহেরও রক্ষা নেই। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বত্র সমস্যার অবাধ বিচরণ।

সমস্যা মানে কী? তা কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। তবু অভিধানের গল্প যখন তখন অভিধান থেকে সমস্যা শব্দের অর্থের কথা বলতেই হয়। অভিধানে সমস্যা শব্দের মোটামুটি যে অর্থ দেওয়া হয়েছে তা হলো জটিল পরিস্থিতি বা ব্যাপার, যার মীমাংসা প্রয়োজন অথচ মীমাংসা করা কঠিন।

ওপরে সমস্যা সম্পর্কে যা বলা হলো তা সবই বাংলা ভাষার। যে ভাষা থেকে শব্দটি বাংলায় এসেছে সেই সংস্কৃত ভাষায় সমস্যা শব্দ নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। যেকোনো শ্লোক পূরণের জন্য প্রশ্নোত্তর অথবা অন্য রূপ সংক্ষিপ্ত বাক্য, সংক্ষেপ সাধন, প্রয়োজনীয় বিভিন্ন শব্দের একত্র সহাবস্থান ইত্যাদি বিষয় হলো সংস্কৃতে সমস্যা, যা মানুষের বিষয় নয়, কাব্য, মহাকাব্য, ধর্মগ্রন্থ ইত্যাদির বিষয়।