প্রাণীরা মায়ের কাছে কী শেখে
পরিবার হচ্ছে মানুষের প্রথম স্কুল। এখানে বাবা-মায়ের কাছে শিশু প্রথম শিক্ষা নেয়। মানুষের হোক আর অন্য কোনো বন্যপ্রাণীর হোক, সন্তান স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মায়েরাই তাদের দেখাশোনা করে। শিকার করে এনে সন্তানদের খাওয়ানো, শত্রু থেকে তাদের রক্ষা করে মায়েরা। আবার ছানাকে প্রতিকুল পরিবেশে টিকে থাকার শিক্ষাও দেয় এই মায়েরা।
রোজ রোজ স্কুলে যেতে যারা বিরক্ত হও, তাদের বলছি, বন্য প্রাণীরাও স্কুলে যায়। তবে মানুষের মতো তাদের স্কুলে বই-খাতা-কলম লাগে না। প্রকৃতির গাছপালা, ঘাস-মাঠ আর অন্য প্রাণীই তাদের শিক্ষা উপকরণ। আর এ স্কুলে ক্লাসটিচার হচ্ছে স্বয়ং তাদের মা। যেমন সাগরের সিল মাছের কথা দিয়ে শুরু করা যাক। মা সিল সাগরে সাঁতার কাটার সময় ছোট্ট সিলছানাকে পিঠে রাখে। এভাবেই ছানারা সাঁতার শেখে সিল মায়ের কাছে।
সিংহছানা শেখে কীভাবে শিকার ধরতে হয়। সেজন্য শিকার ধরার সময় নিজের ছানাদের সঙ্গে রাখে সিংহী। মায়ের শিকার ধরা দেখতে দেখতে ছানাগুলো ‘দেখক’ নয়, পাক্কা শিকারী হয়ে যায়। এদিকে বনের কোন ফলটা খাওয়া যাবে, আর কোনটা খাওয়া যাবে না, কিংবা স্রোতে দাঁড়িয়ে কীভাবে মাছ ধরতে হয়, সেটা মায়ের কাছেই শেখে ভালুকছানা।
ব্রিটেনর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ থ্রনটন এবং ম্যাক অলিফ গবেষণায় দেখেছেন, মিরাক্যাটরা কী খাবে এবং কীভাবে খাবে, সে আদবকেতা ছোট থাকতেই মায়ের কাছে শেখে। দেখতে হাবাগোবা মনে হলেও মিরাক্যাটরা কিন্তু ভয়ঙ্কর শিকারী। শিকার কাবু করতে এরা শিকারের মাথা বা পেটে এলোপাথারি কামড়ায়। মা যখন শিকার ধরছে, তখন ছানারা এ সময় মনযোগী ছাত্র হিসেবে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। এই তাত্ত্বিক ক্লাশের পর শুরু হয় ছানাদের ব্যবহারিক ক্লাশ। এ ক্লাশে মা মিরাক্যাট একটা শিকারকে কাবু করে ফেলে, যাতে সে কোনো ক্ষতি করতে না পারে। আমাদের স্কুলে ব্যবহারিক ক্লাসে কোনো প্রাণী ধরে শুরুতেই যেভাবে অজ্ঞান করে রাখা হয়, অনেকটা সেরকম। বিষাক্ত বিছাপোকা মিরাক্যাটদের প্রিয় খাবার। ব্যবহারিক ক্লাশে বিছাপোকা ধরে প্রথমেই এদের বিষাক্ত হুল ছিড়ে ফেলে ছানাদের সামনে রেখে দেয় মা মিরাক্যাট। আধমরা এই বিছাপোকার সঙ্গে খেলতে খেলতেই শিকার পদ্ধতিও শিখে নেয় ছানারা। এভাবেই হাত পাকায় ছানারা।
শিকার মেরে ছানার সামনে রেখে মাংসাশী প্রাণীরাও ছানাদের পরীক্ষা নেয়। এ ক্লাশে উতরে গেলে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বের শিক্ষা। নতুন পর্বে জ্যান্ত শিকার ছানার সামনে রাখা হয়, যাতে তারা শিকারটি মেরে হাত পাকাতে পারে। শিকারটি যাতে পালাতে কিংবা ছানাদের ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য মা সর্তকভাবে পাহারা দেয়।
ছানাদের শেখাতে আধমরা এন্টিলোপ ছানাদের সামনে রাখে চিতা। সাগরের শিল, সী লায়ন বা মেরুভালুক ছানাদের মাছ ধরা শেখাতে সাগর থেকে জ্যান্ত মাছ এনে রাখে ছানার সামনে। খেলতে খেলতেই ঝানু মাছশিকারি হয় ছানারা।
ভোঁদড় পানির নিচ থেকে ঝিনুক ধরে খায়। তবে ভেতরের মাংস খেতে গেলে ঝিনুকের বাইরের শক্ত খোলশ ভাঙতে হয়। ভোঁদড়রা তাই পেটের কাছে একটা পাথর নিয়ে পানির নিচে যায়। ঝিনুক ধরে পাথরে ভেঙে পানির ওপর সাঁতরাতে সাঁতরাতে পেটে চালান দেয় তারা। তবে মায়ের কাছে এ বিশেষ কৌশল না শিখলে ছানারা ঝিনুক শিকার করতে পারে না। বাচ্চা তিমিও গভীর সাগরের কোথায় সবচেয়ে ভালো খাবার পাওয়া যায়, তা মায়ের কাছে শেখে। সব তিমিরই সাগরের বিশেষ এক এলাকা দখলে থাকে। তবে ছানা বড় হলে ছানাদের সেই জায়গাটা উপহার দেয় মায়েরা।
বন্যপ্রাণীদের মধ্যে হাতিদের শৈশবকাল বেশ লম্বা। হাতি মায়েদের বলা হয় সেরা শিক্ষিকা। অনেক প্রাণী শিকার ধরে সহজাত গুণে। তবে মানুষের মতোই হাতিছানার সহজাত এ বৈশিষ্ট্য নেই। তারাও দেখে দেখে শেখে। জন্ম নেয়ার পর হাতিছানারা জানে না, তার মুখের সামনে ইয়া লম্বা শুড়টার কাজ কী। মানুষের বাচ্চা যেভাবে এলোমেলো হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে, সেভাবেই হাতিছানারা তাদের শুড় নিয়ে খেলা করে। তবে ৬ থেকে ৮ মাসের মধ্যে তারা শিখে নেয় শুড় দিয়ে কীভাবে খেতে বা পানি পান করতে হয়।
এদিকে পাখি মায়েরা তাদের ছানাদের গান গাইতে আর উড়তে শেখায়। আর ঘন ঘাসের ভেতর থেকে ছানাদের খাবার খোঁজার পদ্ধতি শেখায় মুরগি।
কেঁচো শেয়ালদের প্রিয় খাবার। মাটিতে কেঁচোর গর্ত খুঁজে পেলে সেখানে নাক ঢুকিয়ে দাঁত দিয়ে কেঁচো টেনে বের করে মা শেয়াল। শেয়ালছানা পদ্ধতিটি পাশে দাঁড়িয়ে খেয়াল করে। আরেকটি গর্ত পাওয়া গেলে আবারও দাঁত দিয়ে কামড়ে কেঁচোটা টেনে আনে শেয়াল মা। তবে এবার পুরোটা নয়, অর্ধেকটা কেঁচো বের করে ছানার হাতে দায়িত্ব তুলে দেয় মা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, শেয়ালছানা এতো জোরে টান দেয় যে কেঁচো অর্ধেক ছিড়ে গর্তে রয়ে যায়, বাকী অর্ধেক তার দাঁতে ধরা থাকে। তাতেই হাল ছাড়ে না মা শেয়াল। শেয়ালছানা সঠিকভাবে পুরো কেঁচো গর্ত থেকে বের করতে না শেখা পর্যন্ত এই শিক্ষা চলতেই থাকে।
এদিকে, শক্ত বাদাম পাথরে রেখে গাছের ভারী ডাল দিয়ে কীভাবে ভাঙতে হয়, তা ছানাদের শেখায় শিম্পাঞ্জি মা। ছানাদের দাঁত পরিষ্কারের পদ্ধতিও শেখায় থাইল্যান্ডের বানর। আর গন্ধ শুকে শত্রু চেনা শেখায় বনের হরিণ। এভাবে মায়ের ক্লাশে বন্যপ্রাণীরা শেখে অনেককিছু। মা শেখায় বলেই বুনো পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এসব জীবজন্তু।