অনলাইনে নীরবে স্ক্রল করেন যাঁরা, তাঁদের ৫ বৈশিষ্ট্য
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন বন্ধু নিশ্চয়ই আছে—ঘাপটি মেরে থাকে; কিন্তু স্টোরি আপলোড দিলে সঙ্গে সঙ্গে তার ভিউ আসে; গ্রুপের সব আপডেট সে-ই প্রথম দেখে; কিন্তু তার নিজের কোনো পোস্ট অথবা কারও পোস্টে মন্তব্য বা রিঅ্যাকশন নেই। সে শুধু নীরবে স্ক্রল করে যায়।
এমন নীরব স্ক্রলারদের অনেকে বিচ্ছিন্ন বা অমনোযোগী বলে মনে করতে পারে; কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁরা বলছেন, এই স্ক্রলাররা যে শুধু চুপচাপ থাকে, তা নয়; বরং তাঁদের আছে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা খুব কম পোস্ট করে, তারা আলাদা কিছু অভ্যাস নিয়ে চলে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে মঞ্চের চেয়ে জানালা ভাবতে পছন্দ করে। দেখবে, শিখবে; কিন্তু আলোয় দাঁড়াতে চায় না। তারা অনুপস্থিত নয়; তারা শুধু নীরব। আর এই নীরবতার ভেতরেও আছে নিজের মতো করে যুক্ত থাকার একটা ধরন।
যারা সব দেখে, সব জানে; কিন্তু কিছু বলে না—এমন মানুষদের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য থাকে। চলো দেখে নেওয়া যাক তারা আসলে কেমন হয়!
১. পোস্ট দেওয়ার আগে অনেক ভাবা
কেউ কেউ আছে কয়েক সেকেন্ডেই কোনো কিছু পোস্ট করে ফেলে। কিন্তু নীরব স্ক্রলার কখনোই হুট করে পোস্ট দেয় না। এক লাইন লেখার আগে অনেক কিছু তারা ভাবে।
তারা ভাবে, এই পোস্ট দেখে কে কী ভাববে? কেউ ভুল বুঝবে নাকি? পাঁচ বছর পর এই পোস্ট সামনে এলে কী হবে? কোনো বাক্য ভুলভাবে উদ্ধৃত হলে কী বোঝাবে?
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের এই ভাবনা নিজের আচরণকে নিরীক্ষণ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী সংশোধন করা। মানে নিজেই নিজেকে মনিটর করা। তাই তারা ভাবে, পোস্ট ‘ডিলিট করা’ যথেষ্ট নিরাপদ নয়। ভুল কিছু পোস্ট করে ঝামেলায় পড়ার সুযোগ নেই—তারা এই ফর্মুলা মেনে চলে। তাদের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ পোস্ট হলো যেটি কখনো ‘লেখা’ হয়নি।
তাই অনেক কিছুই তারা লেখে না। এতে ঝামেলা কম হয়। ভুল–বোঝাবুঝিও কমে। আর তারা নিজের অনলাইন পরিচয়টাকে লম্বা সময়ের জন্যই ভেবে দেখে। কারণ, একটি পুরোনো পোস্টও চাকরি বা সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।
২. মঞ্চে নয়, দর্শক সারিতে বসে দেখতে পছন্দ করে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসলে একটা মঞ্চ। সেখানে অনেকেই অনেক কিছু করে; আর নীরব স্ক্রলার শুধু দর্শকসারিতে বসে সব দেখে।
মনোবিজ্ঞানীরা এই প্রবণতাকে অন্তর্মুখী বলেন। অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারীরা মানুষকে অপছন্দ করে না; তারা কেবল চিন্তা, পর্যবেক্ষণ এবং বাছাই করে যোগাযোগ করতে স্বস্তি পায়। তারা পর্যবেক্ষণ করতে পছন্দ করে। এটা আসলে একধরনের সামাজিক কৌশল।
তাদের জন্য সেলফি বা মতামত পোস্ট করা মানে যেন অজানা দর্শকের সামনে মঞ্চে উঠে দাঁড়ানো। এরা ভেবেচিন্তে কথা বলা স্বভাবের। তবে মজার ব্যাপার হলো, এরা অনলাইনে সবচেয়ে বেশি খেয়াল করে—কার পোস্টে কে লাইক, লাভ দিচ্ছে; কার মুড বদল হচ্ছে; কোন বন্ধু গোপনে চিন্তায় আছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কিছুই তাদের চোখ এড়ায় না। চুপচাপ থেকেও তারা মানুষের সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝে ফেলে।
৩. আবেগ নিয়ন্ত্রণ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো পোস্ট মানেই ছোট একটা ঝুঁকি থাকে। যেমন—লাইক না–ও আসতে পারে, কমেন্ট খারাপ হতে পারে বা কেউ ভুল বুঝতে পারে। নীরব স্ক্রলাররা এসব ঝুঁকিতে যেতে চায় না।
যদি দরকার হয় তাহলে তারা বন্ধু দুঃখে থাকলে সরাসরি ইনবক্স করে, মজার কিছু পেলে খুব ঘনিষ্ঠ কোনো গ্রুপে শেয়ার করে। তাদের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি দেখার প্ল্যাটফর্ম, ডায়েরি নয়।
৪. ধীরে ভাবা, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া
ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে সবারই যেন তাড়াহুড়া। সবাই দ্রুত প্রতিক্রিয়া চায়; কিন্তু নীরব স্ক্রলাররা নিজের মতো সময় নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে।
তারা পোস্ট সেভ করে পরে পড়ে; ভাইরাল কোনো দাবি শুনলে আগে নিজে খোঁজ নেয়; যে বিষয়ে নিজে নিশ্চিত নয়, সেখানে কোনো মন্তব্য করে না। এ কারণে তারা অহেতুক ভুল তথ্য দেওয়া, উত্তেজিত কমেন্ট বা ভুল–বোঝাবুঝি ও ঝগড়াঝাঁটি থেকে বেঁচে যায়।
৫. লাইকের ওপর কম নির্ভরতা
সবাই যে লাইক বা রিঅ্যাক্ট দেখে খুব খুশি হয়, তা নয়। অনেক নীরব ব্যবহারকারী লাইককে তেমন গুরুত্বই দেয় না। এটি একধরনের আত্মবিশ্বাস। এ কারণে কোনো পোস্ট না দিয়েও তারা শান্তিতে থাকে।
তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তথ্যের জন্য, হাসির জন্য, বন্ধুর খোঁজ রাখার জন্য—নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করার জন্য নয়।
নীরব স্ক্রলাররা কেন গুরুত্বপূর্ণ
অনলাইনে যারা নীরব থাকে, তাদের সংখ্যাই বেশি। গবেষণা বলছে, পোস্ট করার চেয়ে তারা অনেক বেশি পড়ে। তারা অদৃশ্য দর্শক, যারা কখনো কথা না বলেও অ্যালগরিদমকে প্রভাবিত করে। তাদের স্ক্রলিং, থেমে যাওয়া, জুম করা, পড়া—সবই অ্যালগরিদমকে প্রভাবিত করে।
তাদের উপেক্ষা করলে অনলাইন মতামত বোঝা বিভ্রান্তিকর হয়। অনেক সময় জোরে কথা বলা পাঁচ থেকে ১০ জনের মতামত মনে হয় ‘সবার মতামত’। আসলে নীরব স্ক্রলারদের মনে ভাবনা থাকে, কিন্তু তারা প্রকাশ করে না।
নীরব স্ক্রলারদের কাছে শেখার যা আছে
নীরব স্ক্রলারদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো আসলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঝুঁকি কিছুটা কমাতে সাহায্য করে। তাদের কিছু অভ্যাস আমাদেরও কাজে লাগতে পারে, যেমন—
তাড়াহুড়া করে কিছু পোস্ট না করা;
আগে দেখা, পরে বলা;
আবেগ সামলে কথা বলা;
তথ্য যাচাই করা
লাইক-কমেন্ট দিয়ে নিজেকে বিচার না করা।
এই অভ্যাসগুলো অনলাইনে আমাদের আরও শান্ত, সচেতন আর নিরাপদ রাখে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানেই যে সব সময় পোস্ট, পোস্ট, পোস্ট—তা নয়। কখনো কখনো নীরব থাকাও একটা স্টাইল। তবে নীরব ব্যবহারকারীরা যদি বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে, তাহলে তারা কম ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে, যেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্টোরিতে ইমোজি রিঅ্যাক্ট করা, ছোট ছোট গ্রুপে মন্তব্য করা বা কোনো পোস্ট করা। এতে যোগাযোগ ঠিক থাকে।
সূত্র: হেয়ারড্রেসারসব্রাউনসবে