ভারতের সবচেয়ে উত্তপ্ত শহর শ্রী গঙ্গানগর, এই এলাকায় মানুষ বাঁচে কীভাবে
ভারতের কিছু অঞ্চলে চলছে হিটওয়েভ। দিনের তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যাচ্ছে। মানুষ প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের সঙ্গে লড়াই করছে। ১৪০ কোটি মানুষের এই দেশে তিন-চতুর্থাংশ মানুষ চরম তাপঝুঁকিতে রয়েছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কী করছে তারা, জানা যাবে এই লেখায়।
শ্রী গঙ্গানগর ভারতের রাজস্থান রাজ্যের একটি শহর। বিশ্বে শহরের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। এর মধ্যে রাজস্থানের এই শহর বিচিত্র কারণে বিখ্যাত। সেটা হলো, এই এলাকায় প্রচণ্ড গরম। জুন মাসে এখানকার তাপমাত্রা মাঝেমধ্যেই ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। ঢাকায় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পেরোলেই আমাদের হাঁসফাঁস লাগে। শ্রী গঙ্গানগরে এত গরম, এর মধ্যেও সেখানে মানুষ বসবাস করে। এমনকি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যায়। সারা দিন প্রচণ্ড গরমে শ্রী গঙ্গানগরের মানুষ কী করে?
সকাল ৬টা: ৩০° সেলসিয়াস
দিনের তীব্র গরম শুরু হওয়ার আগেই কৃষক আর নির্মাণশ্রমিকেরা নিজেদের কাজ শুরু করে দেন। এই যেমন শ্রী গঙ্গানগরের কৃষক কুলবিন্দর সিং ও তাঁর ছেলে গুরবীর। ভোরবেলায় তাঁরা জমিতে আগাছা পরিষ্কারের কাজ করেন। পরিবারটি খুব ভোরে ওঠে। রাতে তাঁরা ঘরে না ঘুমিয়ে বাড়ির উঠানে মাদুর বিছিয়ে ঘুমান। খোলা বাতাসে একটু স্বস্তি পাওয়া যায়। এই এলাকার অনেক পরিবার রাতে এভাবে ঘুমায়।
সকাল ৯টা: ৩৬° সেলসিয়াস
সূর্য উঠে গেছে। তাপমাত্রা বাড়ছে। শহরের পানির এক প্রধান উৎস খাল। সকাল ৯টায় খালে শরীর জুড়িয়ে নিতে বাসিন্দাদের ভিড় বাড়তে থাকে। ১৬ বছর বয়সী আনমল বর্মা একটি গাড়ির যন্ত্রপাতির দোকানে কাজ করে। সে গরমে ঠান্ডা হওয়ার জন্য দিনে বেশ কয়েকবার খালে ডুব দিয়ে যায়।
সকাল ১০টা: ৪০° সেলসিয়াস
সকাল ১০টা বাজতে না বাজতেই নির্মাণশ্রমিকদের কাজ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তাঁরা দুপুরের সবচেয়ে গরম সময়টাতে কাজ বন্ধ রাখেন। বেশি করে পানি পান করেন তাঁরা। প্রচণ্ড গরমে গাছের নিচে একটু বিশ্রাম নেন। যদিও গাছের ছায়াতেও খুব একটা একটা আরাম পাওয়া যায় না।
বেলা ১১টা: ৪২° সেলসিয়াস
তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর ভিড় বাড়তে থাকে। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করেন ডাক্তার পূর্ণিমা বিষ্ণু। তিনি বলেন, ‘এখানকার মানুষ গরমের প্রভাব কীভাবে কমাতে হয়, জানে। তারা দিনের সবচেয়ে গরম সময়ে বাইরে যাওয়া এড়িয়ে চলে। শরীরে পানিশূন্যতা রোধের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য সবার কাছেই আছে।’ ৭৫ বছর বয়সী বালজিন্দর কৌর এমন একজন, যিনি হাঁপানির রোগী। পেটের ব্যথা ও ডায়রিয়া নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসেছিলেন। তিনি ওষুধ ও নেবুলাইজার নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।
দুপুর ১২টা: ৪৩° সেলসিয়াস
দুপুরের মধ্যে নির্মাণশ্রমিকেরা তাঁদের কাজ থামিয়ে দেন। তবে তপ্ত রোদে ঘেমে তাঁদের দুপুরের খাবার রান্না করতে হয়। শ্রী গঙ্গানগরের চারপাশের এলাকাগুলো দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রায় জনশূন্য থাকে। কারণ, সবাই ঘরের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে শহরের মূল অংশে দোকানপাট খোলা থাকে। নির্মাণকাজও চলে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা রাস্তায় পানি ছিটিয়ে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা বিনা মূল্যে পানি বিতরণ করেন। শহরের প্রধান হাসপাতালের ডাক্তার দীপক মোঙ্গা বলেন, ‘মূলত যাঁরা বাইরে কাজ করেন, সেই শ্রমিকেরা কাজ চালিয়ে যান। কারণ, কাজ না করলে তাঁরা না খেয়ে মারা যাবেন।’
বেলা ৩টা: ৪৭° সেলসিয়াস
তাপমাত্রা বেলা ৩টার দিকে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। প্রায় দুই ঘণ্টা একই রকম তাপমাত্রা থাকে। চাক মহারাজ কা গ্রামের দিকে যাওয়া হাইওয়েতে কিছু পরিবার পথচারীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করে। তারা বালতি ও গ্লাসে পানি ভরে মোটরসাইকেল আরোহী, ট্রাকচালক এবং পথচারীদের কাছে ছুটে যায়। পরিবারগুলো প্রতিদিন বিকেলে গরমের সময় এ কাজ করে। এটিকে তারা একধরনের দান বা ‘চ্যারিটি’ হিসেবে দেখে।
সন্ধ্যা ৬টা: ৪২° সেলসিয়াস
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কিছুটা কমতে শুরু করে। মানুষ আবার বাইরে বের হওয়া শুরু করে। এলাকার বাজারগুলোতে দোকানপাট আবার খোলে। বয়স্ক ব্যক্তিরা চেয়ার টেনে নিয়ে গল্প করতে বসেন। কৃষিজমিতে আবার কাজ শুরু হয়।
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট: ৩৭° সেলসিয়াস
সূর্য ডোবার পর (৭টা ৩৫ মিনিটে) তাপমাত্রা আরও কমতে থাকে। শিশুরা তখনো খালে সাঁতার কাটছে। গুরুমাইল সিং ও তাঁর পরিবার, নাতি-নাতনিদের নিয়ে উঠানে খাটিয়া বিছিয়ে সময় কাটান। তিনি আফসোস করে বলেন, ‘রাতেও বেশ গরম থাকে। এই গরমে কে ঘুমাতে পারে?’
মানুষের সহ্যক্ষমতা আমাদের কল্পনার চেয়েও বেশি। এই যেমন শ্রী গঙ্গানগরের মানুষ। প্রচণ্ড গরমে টিকে থাকার জন্য তাঁরা নিজেদের প্রতিদিনের রুটিনে পরিবর্তন এনেছেন। দিনের সবচেয়ে গরম সময়ে কাজ বন্ধ রাখেন, পর্যাপ্ত পানি পান করেন, খাল বা পুকুরে নেমে শরীর ঠান্ডা করেন। প্রয়োজনে সাহায্য নেন চিকিৎসকের।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস