বিষণ্নতা আর হতাশাকে পেছনে ফেলে যেভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন সিয়া

২০১০ সালের সেই রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, জীবনের ইতি টানবেন সিয়া। সিয়া কেট ইজোবেল ফারলার, বিশ্বসংগীতের আকাশে উজ্জ্বলতম আলো ছড়ানো নক্ষত্রগুলোর একটি। মাত্র ৯ বছর বয়সে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। সেই ট্রমা তাঁর কখনো কাটেনি। ১৯৯৭ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে ভালোবাসার টানে দেশ ছেড়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে চলে গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। প্রেমিক ড্যান পন্টিফেক্সের কাছে। সেখান থেকে কয়েক সপ্তাহ পর থাইল্যান্ডে গেলেন ছুটি কাটাতে। সেখান থেকেই শুনলেন মারাত্মক এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন প্রেমিক ড্যান।

আর পারলেন না। সব ছেড়েছুড়ে ফিরে এলেন নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ায়। এক দিন, দুই দিন করে ছয় বছর ধরে তিলে তিলে প্রেমিকের অকালমৃত্যুর শোক সয়েছেন। এর মধ্যেই ২০০১ সালে সেই কঠিন সময়কে শিল্পের পরশে বানিয়েছেন হিলিং ইজ ডিফিকাল্ট শিরোনামের এক অ্যালবাম। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েন এই গল্পের ‘মহানায়ক’ সিয়া। সেই সময়ের কথা জানিয়ে ২০০৭ সালে সানডে টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ড্যানের মৃত্যু আমাকে অনুভূতিহীন করে দিল। দুঃখ-ব্যথা, খিদে, ঘুম কিছুরই আর কোনো বোধ ছিল না।’

জীবনের সেই সময়টা সিয়া কাটিয়েছেন চরম বিষণ্নতায়, হতাশাকে সঙ্গী করে। তারপরই এক রাতে জন্ম নিল এই লেখার শুরুর বাক্যটি। জীবনের শেষে ‘দাঁড়ি’ বসানোর যাবতীয় ব্যবস্থা করলেন। ঠান্ডা মাথায় একটা চিরকুট লিখলেন। চিরকুটে লিখলেন, ‘জীবনটা বড্ড ভারী হয়ে পড়েছে। আর টেনে নিতে পারছি না।’ এমন সময় এল একটা ফোনকল। সিয়ার খুব কাছের ছোটবেলার এক বন্ধুর। বহু বছর পর সিয়ার একটা হিট গান শুনে তাঁর নম্বর জোগাড় করে তাঁকে ফোন করেছিলেন তিনি। সেই ফোনকলে বদলে গেল সবকিছু। যে রাতে তাঁর মরে যাওয়ার কথা ছিল, সেই রাতেই নতুন করে জন্ম নিলেন ১৯৭৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া সিয়া। বাকি গল্পটা হার মানায় রূপকথাকেও। অনেকে বলেন, সত্যিকারের জীবনমুখী সৎ শিল্পের জন্য নাকি ভীষণ দুঃখকে অনুভব করে জয়ী হয়ে আসতে হয়। সে কথাই যেন কড়ায়-গন্ডায় খাটে সিয়ার বেলায়। জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখকে আলিঙ্গন করে, সেই সময় পেরিয়ে ২০১৬ সালে জন্ম নেয় ‘চিপ থ্রিলস’। সর্বকালের সবচেয়ে বড় হিট পার্টি সংগুলোর একটি। এই গানের বৈশিষ্ট্য হলো, এটি আশপাশে কোথাও বাজতে শুরু করলে কেউ না নেচে থাকতে পারেন না, তা তখন তিনি যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন! জীবন আর শিল্পের কী ভীষণ বৈপরীত্য, এমনটি দেখা গিয়েছিল চার্লি চ্যাপলিনের বেলায়। জীবনের চরমতম দুঃখকে বুকে একটা রুমাল বানিয়ে শক্ত করে পেঁচিয়ে তিনি সারা বিশ্বকে হাসিয়েছিলেন।

২০১০ সালের সেই রাতে সিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, নতুন জীবনে এমনভাবে বাঁচবেন, যে বেঁচে থাকার একটা মানে আছে। শারীরিক, মানসিক, নানা ডাক্তার দেখানো শুরু করলেন। থাইরয়েড হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি নেওয়ার পর মনে হলো, সেরে উঠবেন। কিন্তু সিয়া যতই চেষ্টা করুক না কেন, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, কমপ্লেক্স পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার কিছুতেই ছেড়ে যাচ্ছিল না তাঁকে। তাই সেগুলোকে সঙ্গী করেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। নিজেকে পরিচিত করতে শুরু করলেন সংগীতশিল্পী, গীতিকার, ভয়েস অ্যাকট্রেস, অভিনয়শিল্পী আর পরিচালক হিসেবে।

সিয়া

সিয়ার প্রথম অ্যালবাম অনলি সি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সেটি বিশেষ সাড়া ফেলেনি। ২০০১ সালে হিলিং ইজ ডিফিকাল্ট মুক্তির পরও কেউ আলাদা করে নজর দেননি সিয়ার দিকে। ২০০৪ সালে কালার দ্য স্মল ওয়ান মুক্তির পরও কেবল সিয়া, তাঁর আশপাশের কিছু মানুষ আর গুটিকয় ভক্ত বিশ্বাস করতেন, সিয়া খুবই প্রতিভাবান, পরিশ্রমী আর উন্মত্ত শিল্পী। চতুর্থ অ্যালবাম সাম পিপল হ্যাভ রিয়েল প্রবলেমস আর পঞ্চম অ্যালবাম উই আর বর্ন মুক্তির পর সারা বিশ্ব একনামে চিনে গেল সিয়াকে। দুটি অ্যালবামই অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ডিং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন থেকে গোল্ড মেডেল সার্টিফিকেট পেল। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া ষষ্ঠ অ্যালবাম থাউজেন্ড ফর্মস অব ফিয়ার পুরোনো সব রেকর্ড ভেঙেচুরে যুক্তরাষ্ট্রের বিলবোর্ডের ১ নম্বরে চলে গেল। এই বছরই টুকরা টুকরা হওয়া হৃদয় জোড়া লাগিয়ে সারিয়ে তোলার পর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা এরিক অ্যান্ড্রেস ল্যাংকে বিয়ে করেন সিয়া। সেই সম্পর্ক টেনেটুনে চলেছে দুই বছর। তারপর আবার বিচ্ছেদ হলো, আবার একা হলেন সিয়া।

সপ্তম অ্যালবাম দিস ইজ অ্যাকটিংয়ের গান চিপ থ্রিলস। গানটি ইউটিউবে মুক্তির পর ঝড় উঠল ইন্টারনেটের দুনিয়ায়। এখন পর্যন্ত সেখানে গানটি দেখা হয়েছে ১৬০ কোটির বেশিবার। এরপরও ২০১৭ আর ২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছে সিয়ার অষ্টম আর নবম অ্যালবাম। এভাবেই সিয়া ঘরের শোকেসে সাজিয়ে রেখেছেন ডজনখানেক অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ডিং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস। এর পাশেই শোভা পাচ্ছে এমটিভি ভিডিও মিউজিক অ্যাওয়ার্ড। আর অদৃশ্যভাবে এগুলোর সঙ্গী হয়ে আছে ৯টি গ্র্যামি মনোনয়ন।

সিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে ‘চিপ থ্রিলস’-এর সঙ্গে ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’, ‘দ্য গার্ল ইউ লস্ট টু কোকেইন’, ‘ইলাস্টিক হার্ট’, ‘ইউ হ্যাভ চেইঞ্জড’, ‘টাইটানিয়াম’, ‘ওয়াইল্ড ওয়ানস’, ‘শ্যান্ডেলিয়া’, এই গানগুলোর নাম নিতে হবে। নাহলে গানগুলোর সঙ্গে ভারি অন্যায় হয়ে যাবে। এভাবেই সিয়া নিজে মানসিকভাবে মরে গিয়ে আত্মিকভাবে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন তাঁর শিল্পসত্তাকে। আর সেভাবেই একদিন তিনি হয়ে উঠলেন বিশ্বসংগীতের অন্যতম সেরা আইকনিক চরিত্র।

গুগলে যদি সিয়া লিখে খোঁজ করো, আরেকটি নামও চলে আসে প্রাসঙ্গিকভাবে। ম্যাডি জিগলার। সিয়ার ‘শ্যান্ডেলিয়া’ আর ‘ইলাস্টিক হার্ট’ গানে নেচে তিনি বিশ্বের মনোযোগ নিজের দিকে টেনে নেন। ২০১৫, ২০১৬ আর ২০১৭ সালের টাইম ম্যাগাজিন-এর জরিপে ‘থার্টি মোস্ট ইনফ্লুয়েন্সিয়াল টিনস’-এর তালিকায় স্থান পেয়েছে ম্যাডি। এখন প্রশ্ন হলো, সিয়া আর ম্যাডির সম্পর্ক কী? নিঃসন্তান সিয়ার কেছে ম্যাডি মেয়ের মতো। সে কথাই বারবার উঠে এসেছে সিয়ার বক্তব্যে, ‘একজন মা যেমন তাঁর সন্তানকে ভালোবাসেন, আমিও ম্যাডিকে তেমনটাই ভালোবাসি। আমি ওকে এমনভাবে ভালোবাসি, যেন ও আমার আত্মার সবচেয়ে সুন্দর টুকরা।’

সিয়া ব্যক্তিগত জীবনকে আড়ালে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মাথার উইগ মুখটাও ঢেকে রাখে তাঁর। ২০১১ সালে টাইটেনিয়াম গানটি জনপ্রিয় হওয়ার পর সিয়া ঠিক করেন, নতুন অ্যালবাম করবেন, কিন্তু মুখ দেখাবেন না। বড় এক উইগে ঢেকে রাখবেন মুখ। ততদিনে খ্যাতি, যশ পেয়ে সবই পেয়েছেন সিয়া। কিন্তু অনুভব করেছেন, এসবে অভ্যস্ত নন তিনি। চাইতেন না রাস্তায়, সুপারমাকের্টে দেখেই কেউ চিনে ফেলুক তাঁকে।

২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া ওয়ান থাউজেন্ড ফর্মস অব ফিয়ার অ্যালবামের কভারে ছিল শুধুই সেই উইগের ছবি, যা এখন পরিণত হয়েছে পপ আইকনে।

সিয়া

এভাবেই হোঁচট খেয়ে পড়ে উঠে দাঁড়ানো এক মৃতপ্রায় জীবনকে শিল্পের পরশে জাগিয়ে, বাঁচিয়ে, উদ্‌যাপন করে সিয়া এখন আনস্টপেবল। কিন্তু দিন শেষে সিয়া কেমন? তাঁর গানের কথার মতো, ‘অদ্ভুত অদ্ভুত সব জায়গায় গিয়ে আমার আহত হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে, মনে প্রবোধ মিলেছে। আমার জীবনটাকে যদি আমি কোনো মানুষের অবয়ব দিই, সে-ও দেখতে বড্ড অদ্ভুত, ঠিক আমার মতো। তাই আমাকে তুমি গুলি করো। আমি পড়ব না। আমাকে তুমি গুলি করে ঝাঁঝরা করে ফেলো। আমি মরব না।’