চশমায় যায় চেনা

পরিচিত এক গলির অপরিচিত এক ফুচকা বিক্রেতা। বছরখানেক আগে হঠাৎ দোকানটায় চোখ আটকে গেল। সফেদ পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা এক পুরোদস্তুর ভদ্রলোক ফুচকা–চটপটি বানাচ্ছেন। চোখে ভারী কালো ফ্রেমের চশমা। চশমার ফোঁকর দিয়ে মাঝেমধ্যে ভ্রু কুঁচকে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুগম্ভীর প্রফেসর শখের বশে ফুচকা–চটপটি বানাচ্ছেন। ভাবলাম, নির্ঘাত পোশাকের কারণেই এমন প্রফেসরের মতো দেখাচ্ছে। পরদিন আবার তাঁর ছোট্ট ফুচকা–চটপটির দোকানটা চোখে পড়ল। সাদামাটা একটা ময়লা শার্ট আর লুঙ্গি পরনে তিনি। চোখে সেই ভারী কালো ফ্রেমের চশমা। এবার আর বুঝতে বাকি রইল না, সেই ভারী ফ্রেমের কালো চশমার জন্যই তাঁকে ‘প্রফেসর ফুচকাওয়ালা’ মনে হচ্ছিল।

চশমার তাৎপর্য সাহিত্যে কিন্তু কম নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার কথা মনে আছে? রাজার পায়ে ধুলা–ময়লা যেন না লাগে, তার জন্য রাজ্যের সব বিজ্ঞজন এক হয়ে বুদ্ধি বের করতে থাকেন। রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার জন্য সাড়ে সতেরো লাখ ঝাঁটা কেনা কিংবা পুরো পৃথিবী চামড়া বা মাদুর দিয়ে মুড়ে ফেলার বুদ্ধি দেওয়া সব জ্ঞানীজনের বর্ণনা ঠাকুর সাহেব দিয়েছেন এভাবে—

‘...যেখানে যত আছিল জ্ঞানী–গুণী,
দেশে–বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী।
বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি...’

বোঝাই যাচ্ছে, বিজ্ঞ মানুষ বোঝাতে সাহিত্যে অনেক লেখক বা কবিই চশমার বর্ণনা দিয়েছেন। অনেক গোয়েন্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল চশমা। এই যেমন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা হ্যারিসন রোডের ‘প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস’-এ থাকা সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী। তিনি পরতেন মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। তাঁর বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে চশমা পরাটাও কেমন মানিয়ে যায়। আবার রহস্যের জট খুলতে থাকা এক চরিত্রের কথাই ধরো। হুমায়ূন আহমেদের অনবদ্য সৃষ্টি মিসির আলি। আদতে চশমা পরা সাধারণ এক মধ্যবয়স্ক লোক। তবে তাঁর যুক্তির খেলায় মেলে প্রাজ্ঞের ছাপ। চশমা ছাড়া তাঁর গাম্ভীর্য বা রহস্যময়তা কতটা মানানসই হতো, সেটা চশমা ছাড়া মিসির আলির গল্প পড়লেই কেবল আন্দাজ করা যাবে।

তবে চশমা যে শুধু পাণ্ডিত্য বা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে জড়িত, এমন কিন্তু নয়। একটা সময় ছিল, চশমা পরলেই আঁতেল উপাধি মিলে যেত। বন্ধুরা নিছক কিংবা নিষ্ঠুর টিপ্পনী কাটত, ‘কী রে, সারা দিন বইয়ে মুখ গুঁজে আঁতেল হয়ে গেলি নাকি?’ বাবা–মায়েরা উঠেপড়ে লাগতেন মলা-ঢেলা মাছ খাওয়ানোর জন্য। যেভাবেই হোক চশমার হাত থেকে বাঁচাতে হবে সন্তানকে। হুমায়ূন আহমেদের আরেক চরিত্র শুভ্রর কথাই বলা যায়। চশমা ছাড়া এক হাত সামনের কিছুও সে দেখতে পারে না। বন্ধুরাও সেই সুযোগ নিয়ে মাঝেমধ্যে শুভ্রকে খ্যাপাত। চশমা হারিয়ে ফেলবে, সেই আশঙ্কায় তার মা অতিরিক্ত এক জোড়া চশমা শুভ্রর ব্যাগে দিয়ে দিতেন। কাজেই, শুভ্রকে চশমা ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। তবে চশমাপরুয়াদের সেসব কষ্টের দিনও একসময় ঘুচল। সেটা বদলে হয়ে দাঁড়াল ফ্যাশনের প্রতীক। নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েড চশমা’ পরা কিরীটী রায়ের কথাই ভেবে দেখো। তার চশমা পরার ব্যাপারটায় স্পষ্টতই ফ্যাশনের আভাস মেলে।

ইংরেজি সাহিত্যের দিকে তাকালেও চশমাপরা বিখ্যাত সব চরিত্রের খোঁজ পাওয়া যায়। গোল রিমের চশমা পরা শুকনোমতন সেই ছেলের কথা মনে আছে? হুট করে হগওয়ার্টস থেকে পাওয়া একটি চিঠি পেয়ে যার জীবন বদলে যায় আকাশ–পাতাল! ঠিক ধরেছ, চশমা দিয়েই সবচেয়ে ভালো চেনা যায় যাকে, সেই হ্যারি পটারের কথাই বলছি। হ্যারি পটারের ভক্তদের কাছে সেই গোল ফ্রেমের চশমা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। যদিও হ্যারি কেন চশমা পরে, তা নিয়ে ভক্তকুলের নানা তত্ত্ব রয়েছে। কেউ কেউ মনে করে, শক্তিশালী ‘অ্যাভাডে কেড্যাভরা’ কার্সটির প্রভাবেই হ্যারির দৃষ্টিশক্তিতে কমতি তৈরি হয়। আবার অনেক ভক্তই মনে করে, হ্যারি পটারের বাবা জেমস পটারের সঙ্গে মিল দিয়ে হ্যারির চশমা পরা।

হ্যারি পটার চরিত্রে অভিনয় করা ড্যানিয়েল রেডক্লিফ অবশ্য মনে করেন, হ্যারির চশমা শুধুই ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। অন্যদিকে লেখিকা জে কে রাউলিং বলেন, প্রতীকী দিক চিন্তা করলে হ্যারি পটার বইগুলোয় হ্যারির ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ থেকেই গল্প এগিয়ে যায়। কাজেই, হ্যারি যেন গল্পগুলোয় চোখের ভূমিকা পালন করছে, তাই তার চোখে চশমা। আর অন্য হিসাবে গেলে, রাউলিং নিজেই ছোটবেলা থেকে চশমা পরতে পরতে বিরক্ত ছিলেন। তাই তাঁর চরিত্রকে তিনি চশমা পরিয়েছেন। হ্যারি পটার চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে ড্যানিয়েল রেডক্লিফ যেসব চশমা ব্যবহার করেছেন, সেগুলোর একেকটির মূল্যই নিলামে উঠেছিল লাখ লাখ টাকা। ভাবা যায়!

চশমা কিন্তু আত্মরক্ষার কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। গালিভারকে যখন ব্ল্যাফাস্কোতে অগণিত তির ছুড়ে মারা হচ্ছিল, তার চশমা সেসব ক্ষুদ্র তির থেকে তার চোখকে আগলে রেখেছিল। আবার চশমা পরে বিপদে পড়েছে, এমন চরিত্রের কথা বলি। আর্থার মিলারের লেখা ফোকাস বইয়ের মূল চরিত্র নিউম্যান। তার আগাগোড়া জীবনটাই বদলে যায় এক জোড়া চশমার জন্য। চশমা পরার পর থেকেই সবাই তাকে ইহুদি বলে ভাবতে শুরু করে। তার আশপাশে তখন অনেকেই ‘অ্যান্টিসেমিটিজম’ বা ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ মনোভাবে বিশ্বাসী ছিল। আর তাই নিউম্যান আর তার পরিবারে দেখতে পায় রেসিজমের ভয়াবহ এক চিত্র। বইটি সে সময় অনেক আলোচনার সৃষ্টি করেছিল।

বিখ্যাত এসব চরিত্র থেকেই বোঝা যায়, চশমা কোনো চরিত্রকে তুলে ধরেছে জ্ঞানী বা রহস্যময় হিসেবে, কাউকে আবার আঁতেল কিংবা ফ্যাশনসচেতন হিসেবে। চশমার কারণেই আবার পূর্ণতা পেয়েছে কিছু চরিত্র। মোটা দাগে, সুকুমার রায়ের কবিতাটিই একটু ঘুরিয়ে বললে, চশমার আমি, চশমার তুমি, তা–ই দিয়ে যায় চেনা।