বয়স বাড়লে সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে বলে মনে হয় কেন

ছবি: লাইভসায়েন্স

জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এই অদ্ভুত প্রশ্নটি একবার হলেও সবার মনে আসে। সময় কি সত্যিই দ্রুত ছুটছে, নাকি আমাদের কাছেই তা দ্রুত মনে হচ্ছে? ছোটবেলায় মনে হতো গ্রীষ্মের ছুটি শেষই হতে চাইছে না। স্কুল খোলার জন্য দিনের পর দিন ধরে চলত লম্বা অপেক্ষা। আর এখন মাস শেষ হচ্ছে, চোখের পলকে যেন বছর চলে যাচ্ছে। কিন্তু কেন এমনটা মনে হয়? কেন মনে হয়, ২০ বছর বয়সে একটি বছর যতটা দীর্ঘ মনে হয়েছিল, ৫০ বছর বয়সে এসে সেই বছর যেন তার অর্ধেক হয়ে গেছে? এটা কি শুধুই আমাদের মনের ভুল, নাকি এর পেছনে আছে অন্য কোনো কারণ?

বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গবেষণা করেছেন। যুক্তরাজ্য কমিউনিকেশনস বায়োলজি জার্নালে গত ৩০ সেপ্টেম্বর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। এ গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা কেমব্রিজ সেন্টার ফর এজিং অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স (ক্যাম–ক্যান) থেকে তথ্য–উপাত্ত নিয়েছেন, যা মস্তিষ্কের বার্ধক্য নিয়ে চলা একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রকল্পের অংশ। এ গবেষণায় মোট ৫৭৭ জন অংশগ্রহণ করেছিলেন।

গবেষণায় অংশ নেওয়া সবাইকে জনপ্রিয় পুরোনো টেলিভিশন সিরিজ আলফ্রেড হিচকক পরিচালিত ‘ব্যাং! ইউ আর ডেড’ নামক একটি পর্বের আট মিনিটের একটি অংশ দেখানো হয়। অংশগ্রহণকারীরা যখন ক্লিপটি দেখছিলেন, তখন তাঁদের মস্তিষ্কের ফাংশনাল এমআরআই স্ক্যান রেকর্ড করা হয়। এই স্ক্যানগুলো দেখে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মানুষের মস্তিষ্কের কাজের ধরনে কেমন পরিবর্তন আসে।

আরও পড়ুন

গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা বিশেষভাবে এ ক্লিপটি বেছে নিয়েছিলেন। কারণ, আগের গবেষণাগুলো দেখিয়েছিল, অন্য যেকোনো ভিডিওর চেয়ে এটি দেখলে বিভিন্ন মানুষের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সবচেয়ে বেশি একই রকম হয়। ফলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক কীভাবে তথ্য গ্রহণ করে বা ঘটনাগুলো মনে রাখে, তা বোঝার জন্য এ ক্লিপটি ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত।

গবেষণার জন্য ১৮ থেকে ৮৮ বছর বয়সী অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের স্ক্যান করা তথ্য পরীক্ষা করা হয়। গবেষকেরা ‘গ্রিডি স্টেট বাউন্ডারি সার্চ’ নামের একটি বিশেষ কম্পিউটার প্রোগ্রাম ব্যবহার করেন গবেষকেরা। এ প্রোগ্রামটির কাজ মস্তিষ্ক যখন এক অবস্থা থেকে আরেক স্থিতিশীল অবস্থায় যায়, সেই পরিবর্তনের মুহূর্তগুলো বা ঘটনা দ্রুত চিহ্নিত করা। আট মিনিটের ক্লিপটি দেখার সময় দেখা গেল, কম বয়সী অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ দ্রুত নতুন অবস্থায় পরিবর্তিত হচ্ছিল। অর্থাৎ তাঁদের মস্তিষ্কে ঘটনা বেশি রেকর্ড হচ্ছিল। কিন্তু বয়স্কদের মস্তিষ্কের একটি অবস্থা কম বয়সীদের তুলনায় অনেক বেশি সময় ধরে টিকে ছিল। অর্থাৎ তাঁদের মস্তিষ্কে ঘটনা কম রেকর্ড হয়েছে।

আরও পড়ুন

গবেষকদের মতে, একই সময়ের মধ্যে মস্তিষ্কের একটি অবস্থা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে বয়স্কদের কাছে সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে বলে মনে হতে পারে। এ পর্যবেক্ষণটি প্রাচীন দার্শনিক অ্যারিস্টটলের সেই ধারণার সঙ্গে মেলে। যেখানে বলা হয়েছিল, একটি নির্দিষ্ট সময়ে জীবনে যত বেশি স্মরণীয় বা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সে সময়টি আমাদের কাছে তত দীর্ঘ মনে হয়। বয়স্কদের মস্তিষ্ক একটি নির্দিষ্ট সময়ে কম ঘটনা বা পরিবর্তন মনে রাখে। এ কারণেই হয়তো তাঁদের কাছে মনে হয়, সময় বা জীবন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

যদিও সময় দ্রুত চলে যাওয়ার এ বিষয়টি এখনো শুধু একটি প্রাথমিক অনুমান গবেষকদের। তবুও বিজ্ঞানীরা একে বেশ যৌক্তিক মনে করছেন। গবেষকেরা বলছেন, বয়স্কদের মস্তিষ্কে যে বয়স–সম্পর্কিত নিউরাল ডিফারেন্সিয়েশন নামে একটি ঘটনা ঘটে, সেটাই হয়তো এর মূল কারণ। সহজ কথায়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের কার্যকলাপ কম সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। যে নিউরনগুলো আগে শুধু মুখ চিনতে ব্যবহার হতো, সেগুলো এখন অন্যান্য বস্তুর প্রতিও সাড়া দিতে শুরু করে। গবেষকদের ধারণা, মস্তিষ্কের এই সাধারণীকরণের ফলে কোনো একটি ঘটনা কখন শেষ হচ্ছে এবং কখন আরেকটি শুরু হচ্ছে, তা মস্তিষ্ক স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে না। আর এ কারণেই হয়তো বয়স্কদের কাছে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। যদিও গবেষকেরা সতর্ক করে বলেছেন, শুধু এই একটি কারণ হয়তো পুরো রহস্যের ব্যাখ্যা দিতে পারবে না।

সূত্র: লাইভসায়েন্স

আরও পড়ুন