যদি একদিনের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ থাকে তাহলে কী হবে

প্রতিদিনের কাজ, পড়াশোনা, বিনোদন এমনকি বন্ধুত্বও অনেকাংশে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলফাইল ছবি: রয়টার্স

সকালে ঘুম থেকে উঠে মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখা গেল কোনো নোটিফিকেশন নেই। ইউটিউব খোলা যাচ্ছে না। বন্ধুদের মেসেজে সরব থাকা মেসেঞ্জার হঠাৎ চুপচাপ। ওয়াই–ফাই কাজ করছে না, ইন্টারনেট নেই। প্রথমে মনে হতে পারে—হয়তো লাইন চলে গেছে, একটু পর ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা এমনকি পুরো দিন চলে গেল, তবু নেট আসার কোনো খবর নেই। এমন হলে পৃথিবীটা কেমন হয়ে যাবে? মনে হতে পারে ইন্টারনেটবিহীন দুনিয়াটাই যেন ধীরগতির কোনো সিনেমায় আটকে আছে। আর কী?

ক্লাসে ‘বিদ্রোহ’

যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফ হ্যানকক একসময় তাঁর ছাত্রদের ৪৮ ঘণ্টা ইন্টারনেট ছাড়া থাকতে বলতেন। সে সময় অসুবিধা হলেও কেউ কেউ তা করতেন। তবে ২০০৯ সালে ছুটি শেষে ফিরে তিনি একই কথা বললে ক্লাসের সবাই প্রতিবাদ করেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘এটা অসম্ভব! ইন্টারনেট ছাড়া আমরা পড়াশোনা, যোগাযোগ কিছুই করতে পারব না।’ হ্যানকক অবশেষে হাল ছেড়ে দেন।
আজকের দিনে তাঁদের কথা আরও সত্যি। এখন প্রায় পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই ইন্টারনেটে যুক্ত। প্রতি সেকেন্ডে নতুন করে প্রায় ১০ জন মানুষ অনলাইনে আসছে। আমাদের প্রতিদিনের কাজ, পড়াশোনা, বিনোদন এমনকি বন্ধুত্বও অনেকাংশে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল।

ইন্টারনেট সত্যিই বন্ধ হয়ে গেলে

ইন্টারনেট বন্ধ মানে শুধু ফেসবুক বা ইউটিউব বন্ধ নয়। ব্যাংকের সার্ভার বন্ধ হয়ে যাবে, হাসপাতালের ডেটা দেখা যাবে না, অনলাইন ক্লাস থেমে যাবে। অনেক এলাকায় ফোনকল বা টেক্সট মেসেজও পাঠানো যাবে না, কারণ, অনেক মোবাইল সেবা ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল।

ফাইল যদি ক্লাউডে রাখা থাকে, তা হারিয়ে যাবে। অনলাইন ডেটাবেজগুলো অচল হয়ে পড়বে। সরকারি অফিস বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে যাবে। কারখানার পণ্য কোথায় যাচ্ছে, তা আর ট্র্যাক করা যাবে না। এতে পুরো অর্থনীতি থমকে দাঁড়াবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার কনসিকোয়েন্স ইউনিট ২০০৮ সালে করা এক গবেষণায় দেখেছে, ইন্টারনেট কয়েক দিনের জন্য বন্ধ হলেও বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয় না। তবে সবাই নিজেদের কাজ কিছুটা দেরিতে শেষ করে। আর ইন্টারনেট দীর্ঘস্থায়ী বন্ধ হলে ব্যবসা, ব্যাংকিং ও পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।

যেভাবে বন্ধ হতে পারে

ইন্টারনেট আসলে কোনো এক জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রিত হয় না। এটি হাজার হাজার কম্পিউটার নেটওয়ার্কের বিশাল সংযোগ। তাই পুরো পৃথিবীর ইন্টারনেট একসঙ্গে বন্ধ করা খুব কঠিন। তবু কিছু উপায়ে আংশিক বা সাময়িক বিপর্যয় ঘটতে পারে। সেগুলো হলো—

বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ সাধারণত দুইভাবে হয়, পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক
ফাইল ছবি: রয়টার্স

১. অবকাঠামো নষ্ট হলে

মহাদেশ থেকে মহাদেশে ইন্টারনেট বহন করা সমুদ্রের তলদেশের তার কেটে গেলে ইন্টারনেট বন্ধ হতে পারে। ২০০৮ সালে এমন দুর্ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ বড় আকারের নেট বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। বড় ভূমিকম্প, সাইবার হামলা বা স্যাটেলাইট ধ্বংসের মতো ঘটনাও ইন্টারনেটকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

২. সফটওয়্যার বা ভাইরাস হামলা

কোনো বিপজ্জনক ভাইরাস বা বাগ ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেট প্রটোকলগুলো অচল করে দিতে পারে। ১৯৮৮ সালে ‘মরিস ওয়ার্ম’ নামে একটি প্রোগ্রাম ভুলবশত এমনই বিপর্যয় ঘটিয়েছিল।

৩. সরকার কর্তৃক বন্ধ করা

রাজনৈতিক অস্থিরতা বা আন্দোলনের সময় কোনো কোনো দেশের সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ২০১১ সালে মিসরে আরব বসন্তের সময় সরকার পুরো দেশেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। তুরস্ক, ইরান, মিয়ানমার ও ভারতের কিছু এলাকাতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। কখনো পুরোপুরি বন্ধ করা হয়, কখনো শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমের সাইটগুলো বন্ধ করা হয়।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সরকার ইন্টারনেট শাটডাউন করেছিল। ২০২৫ সালে নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করতে গিয়ে সরকারের পতন ঘটেছে।

সম্পূর্ণ ও আংশিক শাটডাউন

বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ সাধারণত দুইভাবে হয়—পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক।

পূর্ণাঙ্গ শাটডাউনে কোনো নেটওয়ার্ক কাজ করে না। মোবাইল ডেটা, ওয়াই–ফাই—সব বন্ধ। এটা সাধারণত একটি দেশ বা অঞ্চলে ঘটে।

আংশিক শাটডাউনে কিছু সাইট বা অ্যাপ ব্লক করা হয়, যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা বার্তাপ্রেরণ অ্যাপ। এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণত জনগণের সংগঠিত হওয়া বা তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ করতে নেওয়া হয়।

সামাজিক প্রভাব

২০০৯ সালে হ্যানককের ছাত্ররা বলেছিলেন, ইন্টারনেট ছাড়া থাকা এখন ‘অসহনীয়’ মনে হয়। গবেষক উইলিয়াম ডাটন বলেন, ‘মানুষ আসলে বুঝতেই পারে না ইন্টারনেট আমাদের জীবনের কতটা অংশ হয়ে গেছে।’

ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে শুধু কাজ বা অর্থনীতি নয়, মানসিক অস্থিরতাও বাড়ে। মুঠোফোনে ইন্টারনেট না থাকলে কোথাও গেলে মানচিত্র দেখা যায় না, সাহায্য চাওয়ার উপায়ও সীমিত হয়ে যায়।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন ও একা মনে করে। ১৯৭৫ সালে নিউইয়র্কে একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় টেলিফোন পরিষেবা ২৩ দিন বন্ধ ছিল। তখন অধিকাংশ মানুষ জানিয়েছিল, তারা সবচেয়ে বেশি মিস করেছে মুঠোফোন, কারণ, এটি তাদের বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে যুক্ত রাখত।

চিরদিনের জন্য বন্ধ হলে কী হবে
যদি ইন্টারনেট একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী কয়েক দিনের মধ্যেই বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে। ব্যাংক ও ব্যবসা বন্ধ, স্কুল-কলেজের অনলাইন কার্যক্রম অচল, হাসপাতালে রেকর্ড দেখা যাবে না, বিমান চলাচল ব্যাহত হবে।

তবু মানুষ একসময় আবার নতুন করে সংযোগ তৈরি করবে। নতুন তার বসানো, নতুন সার্ভার তৈরি, নতুন সফটওয়্যার বানানো শুরু হবে। কারণ, মানবসমাজ একবার প্রযুক্তির স্বাদ পেলে সেটি ছাড়া থাকতে পারে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো ইন্টারনেট একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বড়জোর কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিনের আঞ্চলিক শাটডাউন ঘটতে পারে। তবে এমন একটি বিপর্যয় যদি ঘটে, তখনই আমরা বুঝব—এই অদৃশ্য নেটওয়ার্ক আসলে আমাদের পৃথিবীটাকেই জোড়া দিয়ে রেখেছে।

সূত্র: বিবিসি ফিউচার