গরমের ছুটিতে আম কুড়ানোর সুখ

গ্রীষ্ম মানেই সূর্যের বাহাদুরি। ধান কাটা সারা। খালি মাঠে খাঁ খাঁ রৌদ্রের দোর্দণ্ড প্রতাপ। কৃষকের ব্যস্ততা নেইকো আর। বাগানজুড়ে শুকনো পাতার আস্তর। তপ্ত মরুর নির্জনতা ভর করে মাঠজুড়ে। বাঁশঝাড়ের কঞ্চি আর পাতার জটলা থেকে নেমে আসা হাঁড়িচাঁচা পাখির সন্তর্পণ পদচারণ। প্রাণহীন দুপুরে খসখস মৃদু ভৌতিক আওয়াজ। নির্জনতার বুক চিরে হঠাৎ ছাতারে পাখির দলের তীক্ষ্ণ চিৎকার। শিমুলগাছের মগডালে বাজপাখির শ্যেন দৃষ্টি। হঠাৎ রকেটের গতি ভর করে তার ডানায়। ছাতারে দলের পাখায় পিস্টনের উল্লাস। ভীত পলায়ন। জেট বিমানের মতো ডাইভ দেয় বাজপাখি, ছোঁ মারে। বাজের নখরে আটকে থাকা ইঁদুর পূর্ণ আত্মসমর্পণে পৃথিবীকে বিদায় জানায় বৈশাখী হাওয়ায় ভেসে।

সেই তপ্ত দুপুরে, ছুটির দিনে ছেলেটা চলেছে ইছামতীর ঘাটে। গোসল করতে। দাদির হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলে। শুকনো খালের ভেতর দিয়ে পথ। পথের দুই ধারে খালের গায়ে মাথা উঁচু করে আছে রাজ্যের যত ঝোপঝাড়। দাদি ওকে হাত ধরে ধরে বুনো ফুল-ফল চেনান। ঝোপের ভেতর হাত দিয়ে কালো কালো ফল তুলে আনেন। ওর হাতে দিয়ে বলেন, ‘খাও!’

‘কী এটা?’ ওর উৎসুক মনের প্রশ্ন।

‘পাকা বুইচে, খেয়ে দেখো না আগে।’ বঁইচি ফলের সেদিনের সেই স্বাদ প্রথম নেয় বছর দশেকের ছেলেটা।

দুপুরের পর যেন ঝপ করে নিস্তব্ধ হয়ে যায় গ্রাম। কাজ না থাকলে ক্লান্তি আর অলসতার কাছে হেরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় বড়রা। কিন্তু বাড়ির ওই দুরন্ত ছেলেটা! তার কি ঘুমালে চলে! আশ্চর্য পৃথিবীর অবারিত সৌন্দর্য তাকে হাতছানি দেয়। শিয়ালকাঁটা আর ঝুনঝুনির হলুদ দ্যুতি, কমলা পাপড়িতে সেজে ওঠা কলকাসুন্দার পুষ্প-পত্র-মঞ্জরি। সব মিলিয়ে যে নৈসর্গিক প্রকৃতির অবতারণা, তা কেবল ওই দুরন্ত বালকের চিত্ত হরণের জন্য! বৈশাখের খাঁ খাঁ রোদ্দুর, কোকিলের কলতান, পাপিয়ার ‘পিউকাহা’ কিংবা বউ কথা কউ পাখির করুণ আকুতির মূল্য কেবল ওই বালকটিই দিতে জানে। রোদে পুড়ে সোনামুখ তামাটে হলে তার বয়েই গেল। বিকেলে আমতলায় বসবে দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুটের আসর। প্রকৃতিকে জানার, ফুলের সঙ্গে, পাখির সঙ্গে মিতালি করার এই তো সময়! অতএব রোদে পোড়ার ভয় তুচ্ছ করে, মায়ের বকুনির অবজ্ঞা করে সেই ডঙ্কা দুপুরে সে বেরিয়ে পড়ে বনবাদাড়ে, ঝোপে-ঝাড়ে।

পরদিন মামা এলেন মাকে নিতে। মায়ের সঙ্গে দুরন্ত ছেলেটি তো যাবেই। শিক্ষকেরা বলে দিয়েছেন গরমের ছুটি, আম খাওয়ার ছুটি। ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে নাকি ভারি সুখ। বলেছেন জসীমউদ্দীন নামের বিখ্যাত কবি। গরুর গাড়ি সাজানো হলো। মামার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে ছেলেটা চলল মামার বাড়িতে। কিন্তু গ্রীষ্মের দুপুর যে ভীষণ গরম। গরুগুলো হাঁপিয়ে ওঠে। এক গাঁয়ের হাটে থামে গরুর গাড়ি। ময়রা-মুদি চক্ষু মুদে ঘুমে ঢুলছে না। রীতিমতো ডালপুরির পসার সাজিয়েছে। মামা দুটো ডালপুরি এনে দিলেন। তারিয়ে তারিয়ে শুধু ডালপুরি খেলেই তো চলবে না। হাটের ওমাথায় একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ। তার ডালে যেন আগুন লেগেছে, রক্তলাল ফুলের গায়ে যেন জ্বলছে বৈশাখের লেলিহান শিখা। হাটের গাছ, তার ওপর কোত্থেকে এসে জুটেছে একটা দলছুট হনুমান। হাটুরে লোকেরা নানা ফন্দিফিকির করে হনুমানের তামাশা দেখছে। কেউ হয়তো কলা ছুড়ে দিচ্ছে, হনুমান সেটা নিয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার মগডালে। গোছা গোছা ফুলের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে হনুমানের সেই ভোজনানন্দের দৃশ্য ছেলেটার মানসপটে গেঁথে রইবে সারাটি জীবন।

খানিক বাদে আবার চলে তাদের গরুর গাড়ি। কাঠের চাকায় ক্যাচক্যাচানি সুর। দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়িয়ে গাড়ি গড়িয়ে চলেছে দুই চাকায় ভর দিয়ে। কত গ্রাম, কত পথ পেছনে চলেছে মামার বাড়ির ডাকে। গাঁয়ের শেষে বটের তলে, উদোম দেহে একদল ছেলে খেলা করছে। গাড়িটা দেখেই ওরা সুর কাটেভাঙাগাড়ি ভেঙে যা/ বউটা মোদের দিয়ে যা। কেউ কেউ ছুটে আসে। গাড়ির পেছন ধরে ঝুলে পড়ে। বাড়তি ভারে গরুগুলোর কষ্ট আরও বেড়ে যায়। গাড়োয়ান জলিল চাচা তেড়ে মেরে ভাগিয়ে দেন দুষ্টু ছেলের দলটাকে।

মামার বাড়ি বন্ধুরা আছে। পাশের বাড়ির বন্ধু। ওরা সব জড়ো হয়ে আমতলায় মার্বেল খেলে। মনের আনন্দে। কিন্তু মাঠে মাঠে খরার প্রকোপ। বড়দের মন খারাপ। পাট বুনতে পানি লাগে। আউশ ধান বোনার আগে পানি চাই। মাঠের ফসল পুড়ে ছারখার। শুক্রবার মসজিদে পানি চেয়ে দোয়া চায় মুসল্লিরা। গাঁয়ের ছেলেরা, মেয়েরা কাদাখেড়ের আয়োজন করে। টিউবওয়েলের পানি উঠোনে ঢেলে ঢেলে প্যাক কাদা তৈরি করে। তারপর ছেলেরা, মেয়েরা কিশোরের দল সেই কাদা মেখে মাথা কোটে, গান গায়,

কালো মেঘে হুড়ুম-দুড়ুম
দুধে মেঘে পানি
মা মাটি মা জ্বলে মরল
ঢালো আল্লা পানি

পুরোনো একটা গান আছে, আব্বাসউদদীনের। সেটাও গায় ওরা। আল্লা মেঘ দে...পানি দে ছায়া দে রে তুই...। গান গাইতে গাইতে ছেলেমেয়েরা দশ বাড়ি ঘোরে। এক মুষ্টি করে চাল নেয়, কেউ দেয় ডাল-গুড়-লবণ, তাই দিয়ে জাউ-খিচুড়ি রান্না হয়। কাদাখেড় শেষ হলে সেই জাউ অমৃতের মতো করে গেলে ছেলেমেয়ের দল। তখনই হয়তো কাকতাল ঘটে। আকাশটা কালো করে মেঘেরা আসে। জড়ো হয় ঈশান কোণে। হঠাৎ প্রকৃতি নিশ্চুপ হয়। পাতাটি পর্যন্ত নড়ে না। পাখিরা সব পাতার আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে। ভর বিকেলেই যেন সন্ধ্যা নামে। ছেলের দল আশ্রয় নেয় বৈঠকখানায়। হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ করে আছড়ে পড়ে পাগলা হাওয়া। আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। আকাশ-পৃথিবী কাঁপিয়ে বাজ পড়ে। পাগলা হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামে বৃষ্টি। আম পড়ে। তার আগে প্রার্থনা ছেলের দলেরঝড়ে নড়ে...একটা আম পড়ে। প্রকৃতি ওদের কথা শোনে। বাতাসের তাণ্ডবে আমের বোঁটা ঢিলে হয়। আম পড়ে। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে ওরা বৈঠকখানা ছেড়ে নেমে আসে আমতলায়। টুপটাপ আম পড়ে। তখন শুরু হয় ওদের আম কুড়ানোর প্রতিযোগিতা। নাকি আম কুড়ানোর সুখ!

পরদিন মামাবাড়ির গাঁয়ে উৎসব। আউশ ধান বপন হবে। বাড়িতে বাড়িতে পায়েস রাঁধার ধুম। কাঁচা আম মেশানো টকটক পায়েস। সেই পায়েস বিলি হবে সারা গাঁয়ে। খরা কাটিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। কৃষকের মনে রাজ্যের স্ফূর্তি। জোছনারাতে তারা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে পাড়ায়। বাড়িতে বাড়িতে বসে হইল্-বইলের আসর। একদল কৃষক সুর করে নিজেদের বাঁধা গান গায়। অনেকটা গীতিনাট্যের মতো। গাঁয়ের হোমরাচোমরা লোকেদের ব্যঙ্গ করে গান বাঁধে। যাঁকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে, তিনি রাগ করেন না। বরং হাসি-তামাশায় শামিল হয়ে তাদের হাতে দু-পাঁচ টাকা নজরানা গুঁজে দেন। গান গাইতেই হয়তো ফের বৃষ্টি নামে। গ্রামে ফিরে আসে শান্তির সুবাতাস। এরই মধ্যে আমাদের দুরন্ত বালকের ছুটি শেষ। গরুর গাড়িতে চড়ে আবার ফিরতে হবে বাড়িতে, আবার যেতে হবে স্কুলে।

বাঁ থেকে : শিয়ালকাঁটা, বঁইচি ফল, ঝুনঝুনি ও কৃষ্ণচূড়া
ছবি: লেখক

তোমাদের নিশ্চয়ই খটকা লাগছে। এ যুগে গরমের ছুটিতে আবার কে গরুর গাড়িতে মামাবাড়ি যায়? আসলে ওপরের গল্পটা দুই যুগ পুরোনো। তখনো এভাবেই গ্রীষ্ম আসত এমন হরেকরূপে। এখনো আসে। কিন্তু সেই দিন আর নেই। প্রযুক্তি আজ দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুটের সময়টা খেয়ে ফেলেছে। প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে গরুর গাড়ি। বদলে গেছে গরমের দিনের সব ছবি, সব উৎসব। এ যুগের গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের ছুটি কাটে এখন ড্রয়িংরুমের বোকা বাক্সটাতে কার্টুন দেখে, সিরিয়ালের কচকচানি শুনে। টিভি যদি না-ও দেখে, মোবাইল ফোনে ভিডিও গেমের নেশায় বুঁদ হয়ে আম কুড়ানোর সুখটুকু তারা ভুলতে বসেছে। কাদাখেড় কিংবা হইল্-বইলের আসর এখন পুরোনো দিনের গল্প। আমাদের সেই দুরন্ত ছেলেটি কিন্তু এখনো ভোলেনি সেই স্মৃতি। সে এখন বড় হয়েছে। এখন যখনই ডালপুরি খেতে বসে, সামনে থেকে প্লেট-গ্লাস কয়েক মুহূর্তের জন্য উবে যায়। একটা আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া, একটা ডালপুরি, একটা হনুমান, তামাশা দেখা হাটুরের দল মিলে একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি হয়ে ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। সেই হনুমানটা হয়তো আজ আর নেই। সেই ডালপুরি, থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সেই তামাশা দেখা হাটুরে দলের অনেকেই হয়তো চলে গেছে না-ফেরার দেশে। অনেকে হয়তো আজও আছে। কিন্তু তারা কি মনে রেখেছে সেদিনের কথা? তারা কি কেউ অবচেতনেও ভেবেছিল, এই যে দৃশ্যের অবতারণা তারা করছে, তা এক টুকরো ছবি হয়ে আজীবনের জন্য খোদিত হয়ে রবে এক শিশুর ছোট্ট বুকে? ভাবেনি, কারও হয়তো মনেই নেই সেদিনের কথা! হয়তো তারাও আজ ভুলে গেছে সেকালের আম কুড়ানোর সুখের কথা!