শৈশবের কোন লক্ষণ দেখে বুঝবেন আপনার সন্তান গণিতে ভালো করবে
অনেক শিশু কলম ধরার আগেই গণিত নিয়ে ভাবতে শেখে। শুনতে অবাক লাগলেও, এটা কিন্তু মোটেও বিরল নয়। সে হয়তো আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না, কিন্তু নিজের মতো করে ঠিকই বোঝে। যেমন, কম বল আর বেশি বল দেওয়া হলে অনেক ছোট্ট শিশুই বুঝে ফেলে, কোনটায় বেশি আছে। এরকম সহজাত প্রবৃত্তি অনেক শিশুর মধ্যেই দেখা যায়। মেঘের ভেতর নকশা খুঁজে বের করা, পাজল দ্রুত মেলানো কিংবা জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা—এসবই কিন্তু গণিতে পারদর্শী হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। আর এসব কিন্তু মনগড়া কথা নয়, এর পেছনে বিভিন্ন গবেষকদের গবেষণা।
আপনার সন্তানের মধ্যে যদি এমন কিছু লক্ষণ দেখতে পান, তাহলে ধরে নিতে পারেন সে শুধু সংখ্যাই ভালোবাসে না, তার ভেতর লুকিয়ে থাকতে পারে আরও বড় সম্ভাবনা। চলুন দেখে নেওয়া যাক, কোন কোন স্বভাবের দিকে খেয়াল রাখলে বোঝা যাবে, শিশুটি গণিতে স্বাভাবিকভাবে দক্ষ হয়ে উঠছে।
১. সংখ্যার হিসাব সহজেই বোঝে
অনেক শিশু আঙুল ব্যবহার না করেই হিসেব করে ফেলতে পারে। যেমন, পাঁচটা বিস্কুট তিনটার চেয়ে বেশি, এটা ওরা সহজেই ধরে ফেলতে পারে। এই সক্ষমতাকে গবেষকেরা বলেন ‘অ্যাপ্রক্সিমেট নাম্বার সেন্স’। যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুর ছয় মাস বয়সেই এই সংবেদনশীলতা থাকে, তারা তিন বছর পরে গণিতে অনেক ভালো করে। আপনার সন্তান যদি জিনিস ভাগ করে নিতে পারে বা তুলনা করতে পারে, তাহলে বুঝে নেবেন তার গণিতে পারদর্শী হওয়ার ভিত্তি তৈরি হচ্ছে।
২. প্যাটার্ন বা পাজলের প্রতি আগ্রহ
আপনার সন্তান কি খেলনা সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করে? ব্যাপারটা খেলাচ্ছলে হলেও এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে গণিতের প্রাথমিক পাঠ। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রি-স্কুলেই নকশা বা প্যাটার্ন বুঝতে পারে, পরে তারা বীজগণিতের মতো জটিল বিষয়েও বেশ ভালো করে। শিশুরা খেলতে খেলতেই এসব গুণ আয়ত্ত করে ফেলে।
৩. প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী
আপনার সন্তান যদি একাধিক নির্দেশনা মনে রাখতে পারে, যেমন খেলায় কোনটা আগে, কোনটা পরে করতে হবে, তাহলে বুঝবেন তার ওয়ার্কিং মেমোরি বা কার্যকর স্মৃতি ভালো। এই স্মৃতি মানসিক গণিতের জন্য খুব জরুরি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পাঁচ বছর বয়সে যাদের ওয়ার্কিং মেমোরি ভালো, তারা ১১ বছর বয়সে গণিতে তুলনামূলকভাবে ভালো করে। যদি দেখেন আপনার সন্তান খেলায় পয়েন্ট হিসেব করছে বা মনে মনে কোনো হিসাব মিলিয়ে নিচ্ছে, তাহলে সে তার মস্তিষ্কের শক্তি ব্যবহার করতে শিখছে।
৪. হাল না ছাড়ার মানসিকতা
গণিতে ভালো করার একটি বড় গুণ হলো সহজে হাল না ছেড়ে দেওয়া। যে শিশুরা কোনো কাজ নিয়ে লেগে থাকতে পারে, বারবার চেষ্টার পরেও হাল না ছেড়ে দেয়, তারা সাধারণত গণিত ও বিজ্ঞানে অন্যদের চেয়ে ভালো করে। ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গিয়ে বা কিছু বানানোর সময় যদি আপনার সন্তান একাগ্রতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে বুঝবেন তার মধ্যে জেদ আর চেষ্টা করে যাওয়ার মনোভাব গড়ে উঠছে। আর সেটা মেধার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।
৫. ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চায়
আপনার সন্তান কি প্রায়ই জানতে চায়, এটা কেন হয় বা ওটা ওভাবে কেন ঘটে? যেমন, ঘড়ির কাঁটা কেন ঘোরে, পাখি কেন উড়ে—এই রকম প্রশ্ন মানে সে কোনো কিছুর পেছনের যুক্তি ও কারণ বুঝতে চাইছে। গণিত মানে শুধু সংখ্যা নয়, মূলত যুক্তির মাধ্যমে সমাধান খোঁজা। যদি আপনার সন্তানের মধ্যে গোয়েন্দার মতো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ঝোঁক থাকে, তাহলে সেটা তার চিন্তার গভীরতা নির্দেশ করে।
৬. সবকিছু গুছিয়ে রাখতে ভালোবাসে
আপনার সন্তান কি খেলনা সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখে, কিংবা জামার বোতামের রং অনুযায়ী আলাদা করে রাখে? এসব কিন্তু নিছক সাজগোজ নয়, তথ্য বিশ্লেষণের প্রথম ধাপ। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে শিশুরা তুলনা করতে শেখে, বিশ্লেষণ করতে শেখে, এমনকি অজান্তেই পরিসংখ্যান বা সম্ভাবনার মতো গণিতের বড় বড় ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়ে যায়।
৭. জায়গা ও আকৃতি বোঝার দক্ষতা
ব্লক দিয়ে নতুন কিছু বানানো, গোলকধাঁধা থেকে সঠিক পথ খুঁজে বের করা, কিংবা পাজলের টুকরো ঘুরিয়ে সঠিকভাবে বসাতে পারাও একধরনের দক্ষতা। এই দক্ষতা ভবিষ্যতে জ্যামিতি বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ছোটবেলায় স্থান ও আকার বোঝা সংক্রান্ত খেলায় ভালো করে, তারা বড় হয়ে গণিতে অন্যদের চেয়ে ভালো করে। তাহলে কি এসব লক্ষণ থাকলেই আপনার সন্তান গণিতবিদ হয়ে উঠবে? না, এমন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু এসব লক্ষণ ভবিষ্যতে গণিতে ভালো করার শক্ত ভিত্তি তৈরি করে। তবে সন্তানের মধ্যে এসব গুণ আলাদাভাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। বরং ওদের কৌতূহলকে উৎসাহ দিন। ওদের এমন প্রশ্ন করতে দিন, যার উত্তর সহজ নয়। কারণ, বড় অঙ্ক কষার শুরুটা হতে পারে একদম সাধারণ কোনো খেলা দিয়ে। সূত্র: উইয়ার্ড ডটকম, টুডে ডট ডিউক ডট এডু, নিউজ ডট শিকাগো ডট এডু ও ইন্ডিয়া টুডে