সাইকেল থেমে থাকলে পড়ে যাই, কিন্তু চালানোর সময় পড়ে যাই না কেন

যে সাইকেল চালাতে পারে, তার কাছে অতি সহজ। এর পেছনের বিজ্ঞান না জেনেও আমরা দিব্যি চালাতে পারি। তবে চালানোর চেয়ে এর বিজ্ঞান বেশি জটিল। পৃথিবীতে যত অমীমাংসিত বিজ্ঞান রয়েছে, তার মধ্যে সাইকেলের বিজ্ঞান অন্যতম। সাইকেল কেন চলার সময় পড়ে যায় না, তার সঠিক ব্যাখ্যা আজও বিজ্ঞানীরা জানেন না। তবে কিছু ধারণা আছে। সেগুলোই সহজভাবে জানা যাক।

সাইকেলমডেল: এলভিন, ছবি: সৈকত ভদ্র

সাইকেল চালিয়ে দিব্যি এগিয়ে যাচ্ছ, পড়ছ না। পড়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা আছে, তা-ই বা ভাবার সময় কই। আসলে সাইকেল চালানোর সময় তা পড়ে না গিয়ে সোজাভাবে চলে কেন, এ প্রশ্নই তো আমাদের মাথায় আসে না। অবশ্য না আসাই স্বাভাবিক। কারণ, যারা সাইকেল চালায়, তাদের কাছে এটা অতি সহজ কাজ। অনেকটা আমাদের হাঁটার সঙ্গে তুলনা করা যায়। হাঁটার মধ্যেও যে বিজ্ঞান আছে, তা কি জানো?

এখন যদি আমরা প্রশ্ন করি, আমরা কীভাবে হাঁটি, নিশ্চয়ই অবাক হবে। ভাববে, এটা কোনো প্রশ্ন হলো? পা দিয়ে হাঁটি। কিন্তু আসলে এই হাঁটার পেছনে লুকিয়ে আছে জটিল বিজ্ঞান। সংক্ষেপে বলি। আমরা এক পা সামনে ফেলে এবং এক পা পেছনে রেখে হাঁটি। এক পা যখন মাটিতে থাকে, অন্য পা তখন থাকে শূন্যে। তাই এক পা আমাদের ভারসাম্য বজায় রাখে। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে চাইলে অন্য পা তা ঠিক করে সোজা রাখে আমাদের। কিন্তু সেটা আমরা টের পাই না। কারণ, আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু ছোট বাচ্চাদের দেখো। ওরা যখন হাঁটা শেখে, কিছুক্ষণ পরপর পড়ে যায়। কেন পড়ে? কারণ, তখনো ভারসাম্য ধরে রাখতে শেখেনি। হাঁটার বিজ্ঞানটা অবশ্য এতটা সহজও নয়। এখানে মহাকর্ষ বলের ব্যাপারস্যাপার আছে। কিন্তু আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় এটা নয়। তাই অন্য কোনো দিন এ বিষয়ে আলোচনা করব। এখন প্রসঙ্গে ফিরি।

পা দিয়ে যেমন আমরা ভারসাম্য রক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে চলি, তেমনি সাইকেলের প্যাডেলের সাহায্যেও সাইকেলের ভারসাম্য বজায় থাকে। সাইকেল যদি ডান দিকে পড়ে যেতে চায়, তাহলে আমরা শরীরটাকে একটু বাঁয়ে বাঁকিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখি এবং সোজা এগিয়ে চলি। ফলে সাইকেল পড়ে যায় না। এটা হলো অতি সহজ ব্যাখ্যা। এখন একটু জটিল ব্যাখ্যায় যাই।

সাইকেল কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখে, তা বুঝতে হলে সাইকেলের ট্রেইল সম্পর্কে একটু জানতে হবে। সাইকেলের চাকার যে অংশ মাটির সঙ্গে স্পর্শ করে থাকে, সে অংশকে ট্রেইল বলে। সাইকেল চালানোর সময় এই সামনের চাকা যত সোজা থাকবে, ট্রেইল তত বেশি হবে। অর্থাৎ ভারসাম্য ভালো বজায় থাকবে। কিন্তু সাইকেলের সামনের চাকা ডানে বা বাঁয়ে ঘুরতে থাকলে ট্রেইল কমে যায়। অর্থাৎ মাটিতে স্পর্শ করা অংশের পরিমাণ কমে। ফলে ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে যায়।

ব্যাপারটা আরও সহজে বুঝতে সাইকেল চালানো শেখার কথা স্মরণ করো। যেদিন প্রথম সাইকেল চালানো শিখেছিলে, সেদিন কি প্রথম থেকেই সোজাভাবে চালাতে পারতে? না। কারণ, তোমার হাত শুধু ডানে-বাঁয়ে ঘুরে যেত। ফলে হাতের সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলের স্টিয়ারিংও যেত ঘুরে। এতে চাকার ট্রেইল কমে যেত এবং বারবার পড়ে যেতে। কারণ, ট্রেইল কমায় ভারসাম্য থাকত না। এরপর যখন সাইকেল চালাতে শিখলে, মানে ভারসাম্য ঠিক হলো, তখন কিন্তু আর সাইকেল ডানে–বাঁয়ে ঘুরে যায় না। ফলে তুমি সাইকেল নিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ো না।

আরও পড়ুন

এটা গেল ভারসাম্যের ব্যাপার। সাইকেল সোজা রাখতে আরেকটি বিষয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। জাইরোস্কোপিক প্রতিক্রিয়া। সাইকেলের ভারসাম্য বজায় রাখতে এটি সামান্য ভূমিকা রাখে। তবে আগে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে সাইকেল সোজা পড়ে না যাওয়ার প্রধান কারণ হলো এই জাইরোস্কোপিক প্রতিক্রিয়া। যদিও এখন সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু কী এই প্রতিক্রিয়া?

সাইকেল

মনে করো, তোমার সাইকেল বাঁয়ে পড়ে যাচ্ছে। তুমি শরীরটা একটু ডানে ঝুঁকিয়ে সাইকেলের ভারসাম্য ঠিক রাখবে। এই যে পড়ে যাওয়ার সময় শরীরের অবস্থানের একটু পরিবর্তন করলে, এটাই জাইরোস্কোপিক প্রতিক্রিয়া। যারা মোবাইলে পাবজি ধরনের গেম খেলেছ, তারা এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত। এই প্রতিক্রিয়ার ফলে কোনো গোলাকার বস্তু নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে থাকে। যেমনটা পৃথিবী ঘোরে। কিন্তু সে ঘূর্ণন তো আমরা দেখতে পাই না। বরং একটা কয়েনের কথা কল্পনা করো। কয়েনকে টেবিলের ওপর ঘুরিয়ে দিলে কী হবে? খাড়াভাবে এটা ঘুরতে থাকবে। কতক্ষণ ঘুরবে? যতক্ষণ ঘোরার মতো প্রয়োজনীয় গতি থাকবে, ততক্ষণ। গতি কমে গেলে কয়েন পড়ে যাবে। সাইকেলের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে। কিন্তু সাইকেল না পড়ার জন্য শুধু এই প্রভাবই যথেষ্ট নয়। কারণ, এই প্রতিক্রিয়ার ফলে সাইকেল সোজাভাবে চললে যে কেউ সাইকেল চালাতে পারত। এর জন্য আলাদাভাবে সাইকেল চালানো শিখতে হতো না। একজন নবিশ সাইকেল নিয়ে নেমে যেত হাইওয়েতে। পড়তে গেলেই জাইরোস্কোপিক প্রতিক্রিয়ার কারণে সাইকেল আবার সোজা হয়ে যেত। অর্থাৎ তখন আমাদের সাইকেল চালানো লাগত না বরং ওটাই আমাদের সয়ংক্রিয়ভাবে চালিয়ে নিয়ে যেত। তবে সামান্য হলেও সাইকেলের বিজ্ঞানের পেছনে এই প্রতিক্রিয়ার ভূমিকা রয়েছে।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে জাইরোস্কোপিক প্রতিক্রিয়ার চেয়ে ভারসাম্য বজায় রাখা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাইকেল কোন দিকে পড়ছে, তার বিপরীত দিকে শরীরকে ঠেলে দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। ফলে সাইকেল মাটিতে পড়ে যায় না। পাশাপাশি স্টিয়ারিংয়ের নড়াচড়া ছাড়াও সাইকেল চালানো সম্ভব নয়। একটা সোজা লাইন বরাবর তুমি অনেক সময় সাইকেল চালাতে পারবে না। কারণ, প্যাডেল দেওয়ার সময় আমাদের ভারসাম্যের তারতম্য হয়। ফলে সাইকেলের সামনের চাকা একটু এদিক–সেদিক বেঁকে যায়। শরীরের সাহায্যে সেই তারতম্য আমরা ঠিক করতে পারি। সাইকেল চালানো শেখা মানে আসলে এই ভারসাম্য বজায় রাখতে শেখা।

তবে শুধু ভারসাম্য বজায় রেখেও সাইকেল সোজা রাখা সম্ভব নয়। বরং ভারসাম্য ও স্টিয়ারিং—এই দুইয়ের ওপর নির্ভর করে সাইকেল দাঁড়িয়ে থাকে। ধরো, তোমাকে এমন একটা সাইকেল দেওয়া হলো, যার স্টিয়ারিং ডানে বা বাঁয়ে ঘোরাতে পারবে না। তাহলে কতক্ষণ তুমি সাইকেল চালাতে পারবে? ভাবছ, সোজা রাস্তা যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ চালাতে পারবে? তাহলে তোমার ধারণা ভুল। আসলে তুমি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাটিতে পড়ে যাবে এবং এটা প্রমাণিত সত্য। শুধু ভারসাম্য রেখে স্টিয়ারিং নড়াচড়া না করে তুমি সাইকেল চালাতেই পারবে না।

ফলে দেখা যাচ্ছে যে সাইকেল পড়ে না যাওয়ার জন্য স্টিয়ারিং সোজা রাখতে হবে। আর এটা সোজা রাখার জন্য শরীরের সাহায্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স, নিউ সায়েন্টিস্ট, বিবিসি ও ব্রিটানিকা

আরও পড়ুন