উড়ে উড়ে বেড়ায় সারাক্ষণ

স্কুলে মাধ্যমিকের দিনগুলো তখন ডিঙিয়ে যাচ্ছিলাম ক্লাসরুমে ঘুমিয়ে কিংবা লুকিয়ে গল্পের বই পড়ে পড়ে। প্রতিদিন পাঠ্যবইয়ের রুটিনের বদলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে পাওয়া বইগুলো ক্লাসের মধ্যে একনিশ্বাসে শেষ করে ফেলা ছিল নিয়মিত রুটিন। সেবার বহুদিন অপেক্ষা করার পর হাতে পেয়েছিলাম জুলে ভার্নের অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ বা আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ বইটি। সেদিনের ভূগোল ক্লাসটি যে আমার আর করা হয়নি, তা তো নিশ্চয়ই সবার বোধগম্য? বরং জুলে ভার্নের আশি দিনে বিশ্বভ্রমণ পড়ে নিজেই হয়ে গিয়েছিলাম যেন ভূগোলের মাস্টারমশাই! গল্পে ডুব দিয়ে আমিও বিশ্বভ্রমণটা সেরে ফেলেছিলাম সেবার। কিন্তু তখন তো জানা ছিল না, গল্পকে সত্যি করে দিয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তে আমার বয়সী এক সদ্য কৌশোর পেরোনো মেয়ে সত্যি সত্যি করে ফেলবে বিশ্বভ্রমণ, তা–ও আবার মাত্র ১৫০ দিনে!

বলছি ব্রিটিশ-বেলজিয়াম বংশোদ্ভূত জারা রাদারফোর্ডের কথা। মাত্র ১৯ বছর বয়সে একা একাই জারা পাড়ি দিয়েছেন ৫টি মহাদেশ আর ১৪টি দেশ। তা–ও আবার উড়ে উড়ে! জারার ওড়ার সঙ্গী হয়েছিল শার্ক অ্যারো নামক প্রতিষ্ঠানের দুই আসনবিশিষ্ট আলট্রালাইটসমৃদ্ধ বিমান। সে বিমান নিয়েই জারা পাড়ি দিয়েছেন নানা দুর্গম, বিপৎসংকুল আকাশপথ। কখনো তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলে জ্বলতে থাকা আগুনের খপ্পরে পড়ছিলেন, আবার কখনো ঠান্ডায় জমে ফ্রোজেন সিনেমার এলসা হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়ে যাচ্ছিলেন! একটুর জন্য তো উত্তর কোরিয়ার মিসাইলও লাগতে যাচ্ছিল তাঁর পিছু!

২০২১ সালের ১৮ আগস্ট আকাশপথে পুরো পৃথিবী একা পাড়ি দেওয়ার অভিযানে নামেন জারা। মাত্র পাঁচ মাসে সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে জারা অবতরণ করেন এ বছরের ২০ জানুয়ারি। আর সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যায় সর্বকনিষ্ঠ নারী হিসেবে আকাশপথে পৃথিবী পাড়ি দেওয়ার বিশ্ব রেকর্ডটা। জারার পরিকল্পনা ছিল, আমাদের গোলগাল, কিন্তু কমলালেবুর মতো চ্যাপটা গ্রহটাকে তিন মাসের মাঝে চক্কর দিয়ে ফেলার। কিন্তু ভিসা–জটিলতা, করোনাভাইরাস, বৈরী আবহাওয়া আর জরুরি অবতরণের কারণে পরিকল্পনায় দেখা দেয় খানিক বিলম্ব।

জারার প্লেনে ওঠার হাতেখড়িটা হয়েছিল তিন কি চার বছর বয়সে। বাবা-মা দুজনই পাইলট, তাই সেই ছোট্টবেলাতেই বাবা কিংবা মায়ের সঙ্গে ছোট বিমানে উঠলে মাঝেমধ্যেই পাইলটের সিটে বসার সুযোগ হতো জারার। যদিও বিমানের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য ছয়টি বালিশের ওপর আসন পেতে বসানো হতো তাঁকে। আর হাতটাও ধরে থাকতেন তাঁর বাবা। তবে কৈশোরে পা দিতেই জারা বুঝে গিয়েছিলেন, বিমান নিয়ে আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর প্রতি রয়েছে তাঁর অন্য রকম আসক্তি। মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন জারা। ২০২০ সালে তিনি হাতে পান বিমান চালানোর লাইসেন্স।

তবে একা একা বিশ্বভ্রমণে যেমনই রয়েছে রোমাঞ্চের হাতছানি, তেমনি রয়েছে নিঃসঙ্গতাও। গ্রহটাকে পাখির চোখে দেখার আনন্দ যেমন আছে, আছে পদে পদে বিপদের ভয়। রাশিয়ার আকাশে পৌঁছে জারাও উপলব্ধি করতে পারেন তাঁর দুঃসাহসিক মিশনটির ঝুঁকি আসলে ঠিক কতটা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়াভ্রমণের অভিজ্ঞতা জারার ভাষ্যে ঠিক এমন, ‘কোথাও কোনো জনমানবের চিহ্ন ছিল না। ছিল শুধু অসম্ভব কনকনে ঠান্ডা। কোনো রাস্তা, বিদ্যুৎ, বন্য প্রাণী, গাছের দেখা নেই সীমানাজুড়ে। এমনও হয়েছিল, আমি পুরো এক মাস কোনো গাছের অস্তিত্ব দেখিনি।’ জারা বলেন, ‘একা একা ভ্রমণের সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আপনি বলতে পারবেন না যে “আমি এটা আর করতে পারছি না, করতে চাই না, আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি”। হাল ছেড়ে দিলেও আপনাকে সঠিক জায়গা বুঝে, নিরাপদভাবে বিমানটি অবতরণ করতে হবে।’

চ্যালেঞ্জের কথা বললে প্রথমেই বলতে হয় উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার কথা। শহরটি পাড়ি দেওয়ার সময় জারা ঢুকে পড়েন এক বিশাল দাবানলে জ্বলতে থাকা এলাকার মধ্যে। দাবানলের আগুনকে ছাড়িয়ে তিনি যতই ওপরে উঠতে থাকেন, ততই যেন তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ধোঁয়া। প্রায় ১০ হাজার ফুট ওপরে উঠেও রক্ষা পান না তিনি। বিমানের পুরো কেবিন ভরে যেতে থাকে ধোঁয়ার গন্ধে। জারার দৃশ্যপটে জড়ো হতে থাকে একরাশ কমলা ধোঁয়া। বাধ্য হয়ে ধোঁয়ার কাছে কুপোকাত হয়ে জরুরি অবতরণ করতে হয় তাঁকে।

অন্যদিকে সাইবেরিয়ার আকাশ ফুঁড়ে চলার সময় তাঁর চোখগুলোকে প্রায় ফাঁকি দিয়ে দিচ্ছিল মেঘের দল। চোখের সামনে পাহাড় নাকি মেঘ—সে সংশয় নিয়েই পুরোটা পথ পাড়ি দেন তিনি। জারার মতে, রাশিয়ার আকাশের তুলতুলে মেঘেরাই হয়ে উঠতে পারে বিপদের ভয়ানক আস্তানা! বিমান যদি বরফের মতো ঠান্ডা মেঘগুলো ফুঁড়ে যেতে থাকে, বরফ জমে বিমানের পাখাগুলো বন্ধ হয়ে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। আর সেই দুর্ঘটনা যদি ঘটে মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মাইনাস ৩১ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রায়, তা–ও আবার জনবসতিহীন, লোকালয় থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে এক বরফে ঢাকা এলাকায়, তবে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া আর ফিরে আসার সম্ভাবনা যে কতটা ক্ষীণ, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। ৬ ঘণ্টায় যেখানে একটিমাত্র গ্রামের দেখা পাওয়া যায়, মেঘের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেই একাকী পথ পাড়ি দিতে গিয়ে জারার মনের অবস্থা কেমন হয়েছে, একবার ভেবে দেখো!

তবে মেঘের পাল্লায় যে জারা শুধু রাশিয়ায় পড়েছিলেন, তা কিন্তু নয়; বিশাল এক মেঘ তো তাঁকে রীতিমতো তাড়া করে ঠেলে দিচ্ছিল উত্তর কোরিয়ার আকাশসীমানায়। মাঝেমধ্যে সতর্কবাণী ছাড়া মিসাইল টেস্ট করা উত্তর কোরিয়ার এক বদভ্যাস। অনুমতি বা আমন্ত্রণ ছাড়া যে দেশটিতে কেউ ভুলেও পা দেয় না, সেখানেই আর ১৫ মিনিটের মধ্যে জারা প্রায় প্রবেশ করে ফেলছিলেন! যদিও সে যাত্রায় মেঘের সঙ্গে বোঝাপড়া করে সে পথ এড়াতে পেরেছিলেন জারা।

তবে পথের বাঁকে বাঁকে বিপদ ছাড়াও সবুজ আর নীলে ঘেরা পৃথিবীটা জারাকে দিয়েছে নানান অভিজ্ঞতা। ছোট্ট বিমানে উড়ে চলার সময় ৬ হাজার ৩৭১ কিলোমিটার প্রশস্ত বিশাল পৃথিবীটা জারার কাছে হয়ে উঠেছিল যেন এক ছোট্ট গ্রহ, যেখানে ভয়কে ছাড়িয়ে যেতে পারলেই হাতছানি দেয় খানিক পরপর পরিবর্তন হওয়া সাহারা মরুভূমির অপরূপ রং, উত্তর আলাস্কার ধু ধু মাঠ কিংবা মোহনীয় করে তোলা আইসল্যান্ডের এক পরিত্যক্ত দ্বীপে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ঘরটা (World’s lonliest house)। জারার মতে, তাঁর এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হয় নিউইয়র্কে। সেখানে নির্ধারিত নিয়মের কারণে বেশ নিচ দিয়ে সেন্ট্রাল পার্ক পার হতে গিয়ে তিনি দেখতে পান, কিছু ভবন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর থেকেও বেশি উচ্চতায়!

তবে বিশ্বভ্রমণের মতো বিশাল স্বপ্নপূরণ করা জারার লক্ষ্য কিন্তু শুধু পৃথিবীটা চক্কর দেওয়াই ছিল না, তাঁর আসল লক্ষ্য হলো মেয়েদের বিমানচালনা, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, গণিত—এই সব শাখায় পড়াশোনা ও অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করা। বিশ্বের মাত্র ৫ শতাংশ নারী বাণিজ্যিক বিমানচালনা ও মাত্র ১৫ শতাংশ নারী কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট পেশায় নিয়োজিত আছেন। জারা বিশ্বাস করেন, তাঁর ঐতিহাসিক অর্জনটি অনুপ্রাণিত ও সাহায্য করবে বিশ্বের সব প্রান্তের কিশোরী ও নারীদের এসব শাখায় তাঁদের অনন্য প্রতিভা তুলে ধরতে।

বোনের রেকর্ড ভাঙার পথে ছোট ভাই

জারা রাদারফোর্ডের ছোট ভাই ম্যাক রাদারফোর্ড। বোনের মতো তারও বিমানের সঙ্গে সখ্য সেই শৈশবেই। মাত্র ৭ বছর বয়সে ম্যাক প্রথমবারের মতো ককপিটের নিয়ন্ত্রণ নেয় নিজ হাতে। ১৫ বছর বয়সে বিশ্বের কনিষ্ঠতম ব্যক্তি হিসেবে ম্যাক পায় বিমান চালানোর লাইসেন্স। তবে ম্যাকের রেকর্ড এখানেই শেষ নয়। বোনের দেখানো পথেই উড়াল দিয়েছে ছোট ভাই ম্যাক।

বোনের বিশ্বজয়ের দুই মাসের মধ্যেই ছোট ভাই ম্যাক তৈরি হয়ে যায় নতুন বিশ্বজয়ের উন্মাদনা নিয়ে। চলতি বছরের ২৩ মার্চ আকাশপথে পৃথিবী ভ্রমণের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করে ম্যাক। দুই সিটের একটি আলট্রালাইট এয়ারক্রাফট হয়েছে তার সঙ্গী। খোদ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শার্ক অ্যারো এই যাত্রাকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়েছে। এমনকি প্রকল্পের অংশীদার হতেও রাজি হয়নি প্রতিষ্ঠানটি। কারণ, তাদের বিমানে চড়ে বিশ্বভ্রমণ করতে যাওয়া ম্যাকের বয়স যে মাত্র ১৬! তবে নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে একের পর এক দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে এ ব্রিটিশ কিশোর। তার লক্ষ্য আরও চারটি আফ্রিকান ও ভারত মহাসাগরীয় দেশ। তারপর মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকা হয়ে ফিরবে ইউরোপে। সব ঠিকঠাক থাকলে জুলাই মাসের মধ্যে শেষ হবে ম্যাকের বিশ্বভ্রমণ আর তার সঙ্গে সর্বকনিষ্ঠ পাইলট হিসেবে একা বিশ্বভ্রমণের নজির গড়বে ১৬ বছর বয়সী এ ব্রিটিশ কিশোর।