কেমন আছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানের মানুষেরা
বিশ্বের ৮ কোটির বেশি মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮ হাজার ২০০ ফুট ওপরে বাস করে। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার মানুষই বেশি। তবে সবচেয়ে উঁচুতে স্থায়ীভাবে বাস করে এমন বসতিগুলোর মধ্যে রয়েছে চীনের চিংহাই প্রদেশের ওয়েনকুয়ান। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫ হাজার ৯৮০ ফুট ওপরে অবস্থিত। আবার ভারতের কোরজোকরা গ্রামটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫ হাজার ফুট ওপরে।
তবে এটাই সবচেয়ে উঁচু জায়গা নয়, যেখানে মানুষ বাস করে। পেরুর আন্দিজ পর্বতমালায় অবস্থিত একটি শহরের নাম ‘লা রিনকোনাডা’। একে বলা হয় ডেভিল প্যারাডাইস বা শয়তানের স্বর্গ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ৪০৪ ফুট ও ১৭ হাজার ৩৮৮ ফুট উঁচুতে প্রায় ৫০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ বাস করে। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থান, যেখানে মানুষ স্থায়ীভাবে বাস করে।
তবে এমন উঁচু স্থানে বাস করা মোটেও সহজ নয়। এখানে নেই কোনো নদীর স্রোতধারা। বৃষ্টি হওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ মেঘ সৃষ্টি হয় এই স্থানের নিচে। মানে এই ডেভিল প্যারাডাইস যতটা ওপরে আছে, মেঘ তত ওপরে থাকে না। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও আবর্জনা ফেলার জায়গাও নেই। সারাক্ষণ চারপাশ থেকে দূর্গন্ধ আসে। এখানে নেই কোনো স্কুল বা হাসপাতাল। এখানকার মানুষের গড় আয়ু মোটে ৩০-৩৫ বছর। কিন্তু পেরুর মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। এখানকার মানুষ ধীরে ধীরে ফুসফুসের রোগ ও শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণের কারণে মারা যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত কষ্ট করে এই উঁচুতে মানুষ কেন বসবাস করে? তা–ও আবার প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। তাঁদের কি যাওয়ার কোনো জায়গা নেই? আসলে ডেভিল প্যারাডাইস সোনার খনির জন্য বিখ্যাত। ৬০ বছর আগে এখানে প্রথম সোনার খনির খননকাজ শুরু হয়েছিল। তার পর থেকে স্বর্ণের লোভে মানুষ এই গ্রামে ভিড় জমিয়েছে। শুধু স্বর্ণের জন্য এখানকার বাসিন্দাদের নানা দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অঞ্চলের অক্সিজেনের মাত্রা মাত্র অর্ধেক। মানে তুমি–আমি বাতাসে যতটুকু অক্সিজেন পাই, তারা পায় তার চেয়ে অর্ধেক। এ অবস্থায় জীবন বাঁচিয়ে রাখা কঠিন বটে।
তুমি যদি ওই অঞ্চলে ঘুরতে যাও, তাহলে প্রথমেই টের পাবে, তোমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ, বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কম। ওখানকার বাসিন্দারা এই অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। আবার যারা শৈশব থেকে এমন উঁচু স্থানে থাকে, বয়ঃসন্ধিকালের আগে তাদের ফুসফুসের আয়তন সামান্য বৃদ্ধি পায়। এতে তারা কম অক্সিজেনের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে পারে।
এই নারকীয় গ্রাম সম্পর্কে আরেকটি তথ্য দিই। এখানকার শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয় একটি পুরানো পদ্ধতিতে। নাম ক্যাচরিও (Cachorreo)। এই পদ্ধতিতে একজন শ্রমিক টানা ৩০ দিন কাজ করেন। তারপর ৩১তম দিনে শ্রমিকদের ৩ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে তারা খনি থেকে যতটুকু আকরিক নিতে পারবেন, নিয়ে যাবেন। সেই আকরিকের মধ্যে যতটুকু স্বর্ণ থাকবে, তা শ্রমিকের। যদি কোনো স্বর্ণ না পান, তাহলে শ্রমিকের তা মেনে নিতে হবে। আর ৩০ দিনের কষ্ট যাবে বৃথা। আসলে বেশিরভাগ শ্রমিকই স্বর্ণ পান না। অনেকে পান সামান্য সোনা। কিন্তু তারপরও তাঁরা কাজ করে যান এই আশায় যে একদিন তাঁরা অনেক সোনা পাবেন এবং ধনী হবেন। একবার অনেক সোনা পেলে আর কষ্ট করে খাটতে হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শ্রমিকদের সে দিনটি আর আসে না। তারপরেও স্বর্ণের আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকেন এই নরকের মধ্যে। এমনই কষ্ট করে বেঁচে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানের মানুষ। যেন সবচেয়ে উঁচু স্থানের মানুষই রয়েছে সবচেয়ে বেশি কষ্টে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, মাই বেস্ট প্লেস ডট কম
ছবি: মাই বেস্ট প্লেস