কিছু দেশে প্রাণীরা কেন রঙিন, কিছু দেশে কেন সাদাকালো
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের জগৎটা খুব রঙিন। যেন প্রকৃতির আঁকা এক বিশাল ক্যানভাস। এই যেমন আমাজন জঙ্গল। যেখানে ম্যাকাও পাখির গায়ে যেন কেউ রংধনু লাগিয়ে দিয়েছে। আবার সাগরের গভীরে প্রবালপ্রাচীরের পাশে ভেসে বেড়াচ্ছে উজ্জ্বল হলদে-নীল মাছের ঝাঁক। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের এসব হরহামেশাই দেখা যায়। কিন্তু কেন? এই অঞ্চলের প্রাণীরা কেন এত রঙিন?
উত্তর বলার আগে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেই। নিরক্ষরেখাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর যে বেল্টে সূর্যের আলো সবচেয়ে বেশি পড়ে, সেই অঞ্চলকেই আমরা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল বলি। এই অঞ্চলে সারা বছরই তুলনামূলকভাবে গরম থাকে। দিনের দৈর্ঘ্যে খুব বেশি তারতম্য হয় না। আর সূর্যের আলো প্রায় সোজাসুজি এসে পড়ে। এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার প্রায় ১২৫টি দেশ এই অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। বাংলাদেশ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশ।
জার্মানির লিবনিজ সেন্টার ফর ট্রপিক্যাল মেরিন রিসার্চের মৎস্যবিজ্ঞানী অস্কার পুয়েবলার ও তাঁর দল এই রঙের রহস্য খুঁজতে নেমেছিলেন। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, প্রাণীরা আসলে রঙের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যেন কথা বলে। সে কথা অবশ্য মানুষের মতো নয়। ওদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে আরকি। কোনো প্রাণী হয়তো এই রঙিন ভাষা সঙ্গীকে আকর্ষণ করে। অনেক প্রাণী আবার বিপদে পড়লে শিকারি প্রাণীকে হুংকার দিয়ে বলে, ‘সাবধান! আমার কাছে এসো না, আমি কিন্তু বিষাক্ত।’ আবার মাঝেমধ্যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকার জন্য এই রং হয় ওদের সেরা কৌশল।
ব্যাপারটা অনেকটা গ্রামের বিশাল মেলার মতো। ধরো, তুমি মেলায় গিয়ে ভিড়ের মধ্যে নিজের বন্ধুকে খুঁজে পাচ্ছ না। কীভাবে চিনবে তাকে? নিশ্চয়ই তার পরনের বিশেষ রঙের পোশাকটা দেখে! রেইনফরেস্ট বা সাগরের প্রবালপ্রাচীরও ঠিক সে রকমই একটা মেলার মতো। সেখানে হাজারো প্রজাতির প্রাণী, পাখি আর মাছ একসঙ্গে বাস করে। এই ভিড়ের মধ্যে টিয়া পাখিদের নিজেদের প্রজাতির সঙ্গীকে ঠিকঠাক চিনে নিতে হয়। ভুল করে অন্য প্রজাতির সঙ্গে মিশে গেলে তো চলবে না! তাই নিজেদের আলাদা করে চেনানোর জন্যই তাদের গায়ে এত রঙের বাহার।
তবে মূল বিষয়টা কিন্তু মোটেও সহজ নয়। আমাদের চোখে যা খুব উজ্জ্বল আর আকর্ষণীয়, অন্য প্রাণীর চোখে তা হয়তো নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলার জাদুমন্ত্র! যেমন সাগরের গভীরে পানির নিচে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না। তাই যে মাছের গায়ের রং টকটকে লাল, সে আসলে শত্রুর চোখে প্রায় কালো বা অদৃশ্য হয়ে যায়। এতে ওই মাছ সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারে। আবার প্রবালপ্রাচীরের উজ্জ্বল হলদে-নীল মাছ দেখে আমাদের মনে হতে পারে, এরা তো সহজেই শত্রুর চোখে পড়ে যাবে! কিন্তু আসলে ওই উজ্জ্বল রংই ওদের শিকারি মাছের থেকে রক্ষা করে। কিন্তু আমাদের চোখে তা দেখে খুব রঙিন মনে হয়।
এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এই অঞ্চলের প্রাণীরাই কেন শুধু রঙিন হয়? শীতপ্রধান দেশের প্রাণীদের কি তাহলে সঙ্গীকে আকর্ষণ করতে হয় না? ওখানকার প্রাণীদের কি ছদ্মবেশ লাগে না? আসলে সব অঞ্চলের প্রাণীদের জন্যই এসব লাগে। কিন্তু নিজেকে রঙিন করাটা কিন্তু সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। প্রাণীদের তো মানুষের মতো পার্লার নেই যে গিয়ে একটু নিজেকে রঙিন করে এল। মূলত প্রাণীদের শরীরে এই রং তৈরি করতে বা ধরে রাখতে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন। মরুভূমি বা বরফের দেশের মতো কঠিন পরিবেশে থাকা প্রাণীদের কাছে খাবার আর শক্তি থাকে কম। তাই ওরা রঙিন হওয়ার বিলাসিতা করতে পারে না। কোনোরকমে টিকে থাকার জন্য লড়াই করে। কিন্তু গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে প্রচুর খাবার থাকে। আবহাওয়াও বেশ আরামদায়ক। তাই এখানকার প্রাণীরা সহজেই রঙিন হওয়ার মতো শক্তি জোগাড় করতে পারে এবং নিজেদের রঙিন সাজে সাজিয়ে রাখে।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স