ভারতের সন্ধানে

পঞ্চদশ শতকে পৃথিবী সম্বন্ধে মানুষের ধারণা ছিল ত্রুটিযুক্ত ও সীমিত। ভূমধ্যসাগর আর ইউরোপের খুব অল্প জায়গার মানচিত্রাঙ্কনই ছিল নিখুঁত। অন্যান্য জায়গার মানচিত্র ছিল দূরকল্পী—বিশেষ করে পশ্চিম আর দক্ষিণের। আবিষ্কারক আর ব্যবসায়ীরা তত দিনে স্থলপথে পৌঁছে গেছে ভারত, চীন আর আফ্রিকায়, ওদিকে নাবিকেরা চলে গেছে আমেরিকায়—যদিও পৃথক একটা মহাদেশ হিসেবে ওটার অস্তিত্ব তখনো টের পাওয়া যায়নি।

বিশাল আফ্রিকা মহাদেশ ছিল রহস্যময় আর সমস্যাপূর্ণ। কেউই পুরোপুরি জানত না দক্ষিণে কতদূর বিস্তৃত ওটা, আকার কেমন কিংবা ভারতের সঙ্গে মিলিত হয়েছে কি না। ইউরোপে তখনো বিশ্বাস করা হতো পৃথিবী আকারে চ্যাপ্টা, ফলে ‘পৃথিবীর প্রান্তের ওপর দিয়ে’ জাহাজ চালানো সম্ভব। চালু ছিল এমন প্রকাণ্ড সব দানবের গল্প, যারা গিলে খেতে পারে আস্ত জাহাজ, গনগনে এমন সূর্য যার তাপে মানুষ হয়ে যায় শুঁটকি। এমনকি সাগরের পানি ফুটতে থাকে টগবগ করে। শতাব্দীর শুরুতে, বিশাল সবুজ সাগরে ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান হতো খুব কম, আর খুব অল্পই জানা ছিল আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল সম্বন্ধে, যেটার দক্ষিণে এখন অবস্থিত মরক্কো।

কিন্তু ইউরোপের অন্ধকার যুগের অবসান হয়ে রেনেসাঁর সূচনায় বিদায় নিল এসব আদিম কুসংস্কার। শিক্ষিত মানুষ পরিচিত হলো প্রাচীন গ্রিক এবং রোমান দার্শনিক আর বিজ্ঞানীদের বইয়ের সঙ্গে। স্বীকৃত হলো যে পৃথিবী আসলে গোল, চ্যাপ্টা নয়। তারা জানল খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ সালে ফিনিশীয় বংশোদ্ভূত হ্যানো নামের এক প্রাচীন কার্থেজীয় আবিষ্কারক জাহাজে করে গিয়েছিল সুদূর দক্ষিণের সিয়েরালিয়নে, যেটার অবস্থান আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের লাইবেরিয়ার ঠিক উত্তরে এবং বিষুবরেখার পাশে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালের দিকে ফারাও নেকো-ও তার অভিযানের দায়িত্ব অর্পণ করেছিল ফিনিশীয়দের ওপর, যারা জাহাজ ভাসিয়ে গিয়েছিল আফ্রিকার পুব থেকে পশ্চিমে। প্রত্যেক শীতে সেখানে শস্য বুনে- কেটে তিন বছর পর ফিরে এসেছিল জিব্রাল্টার প্রণালি ঘুরে।

প্রাচীনকালে যা অর্জিত হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই পারে পঞ্চদশ শতাব্দীতে। এমন গভীর বিশ্বাস ছিল পর্তুগালের যুবরাজ হেনরির, যাকে সবাই চিনত ‘নাবিক’ নামে। পর্তুগালের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে সে প্রতিষ্ঠিত করেছিল নাবিকবিদ্যার একটা বিদ্যালয়। বহু জাহাজনির্মাতা, নকশাবিদ, গণিতবেত্তা, মানচিত্র অঙ্কনকারী, জ্যোতির্বেত্তা আর নাবিক এসেছিলেন সেখানে। সে বিদ্যালয়েই বিজ্ঞানীরা তৈরি করল মানচিত্র আর যন্ত্রপাতি। ওদিকে আবিষ্কারকদের মুখে শুনে জাহাজ নির্মাতারা তৈরি করল নতুন নতুন জাহাজ, যেগুলো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও টিকে থাকতে পারে। ধীরে ধীরে এসব নতুন ধরনের জাহাজ-যন্ত্রপাতির সহযোগিতায় অভিযান পরিচালিত হলো আরও দক্ষিণে। একে একে আবিষ্কৃত হলো ম্যাডেইরা দ্বীপপুঞ্জ, ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, শেষমেশ কেপ বোজাডোর, বর্তমানে যেটার অন্তর্গত স্প্যানিশ সাহারা।

দীর্ঘকাল ধরে এই কেপ বোজাডোর হয়ে ছিল একটা বাধার মতো, যার ওপারে যাওয়ার সাহস কেউ পেত না। ওপারে ছিল না কোনো মিঠাপানি, ঘাস বা সবুজ লতাপাতা। কিন্তু শেষমেশ এই কেপ বোজাডোর অতিক্রম করে দেখা গেল সেটার দক্ষিণ অংশটা অবিকল উত্তর অংশের মতো। পরিচালিত হলো অভিযানের পর অভিযান, প্রত্যেকটাই খানিক বেশি করে এগোতে পারল দক্ষিণে, তবে খুব বেশি নয়। সোনা-রুপা পেয়ে আরও নতুন নতুন অভিযানে উত্সাহী হলো আবিষ্কারকেরা। চলে গেল আরও দক্ষিণে।

যুবরাজ হেনরি মারা গেল। বিষুবরেখা পার হয়ে দক্ষিণ দিকে এগোলে ধ্রুবতারা অদৃশ্য হয়ে জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে। যুবরাজের জ্যোতির্বেত্তারা সেটার সমাধান দিল। ১৪৮৬ সালে ৫০ টনের ছোট একটা জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বার্থোলোমিউ ডায়াজ। এগোল উপকূল ঘেঁষে ঘেঁষে। শেষমেশ পরিকল্পনা করলেন আফ্রিকার সর্বদক্ষিণ প্রান্তে যাওয়ার—কিন্তু বিদ্রোহী নাবিকেরা ডায়াজকে বাধ্য করল একটা অন্তরীপ ঘুরে যেতে। ডায়াজ সেটার নাম দিল কেপ অব স্টর্মস (পরে পর্তুগালের রাজা জন এর নতুন নামকরণ করল কেপ অব গুড হোপ)। প্রায় দুই বছর পর লিসবনে ফিরে পেল এক কৌতূহলী অভ্যর্থনা।

এ রকম সময়েই দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেন ভাস্কো-দা-গামা। ১৪৬০ সালের দিকে পর্তুগালের সাইনিসে দা-গামার জন্ম। তাঁর বাবা তখন আলেমটেজো প্রদেশের গভর্নর। একজন অভিজাত মানুষ তিনি। পাশাপাশি যোদ্ধা আর নাবিক হিসেবে খ্যাত হলেও দা-গামা ইতিহাসে যশোলাভ করলেন ৩৭ বছর বয়সে। নতুন রাজা ইমানুয়েল তার প্রিয়পাত্র দা-গামাকে নির্দেশ দিল ভারতে যাওয়ার একটা সাগরপথের সন্ধান করতে।

আবিষ্কারের এই অভিযানের জন্য তাকে দেওয়া হলো সর্বাধুনিক ধরনের তিনটি জাহাজ—দুটি ১২০ টন আর একটি ৫০ টনের। বর্তমানের বিচারে এই জাহাজগুলো ছোট হলেও ছিল ডায়াজের জাহাজগুলোর চেয়ে অনেক বড়। একটা জাহাজ পরিচালনার ভার নিল দা-গামা নিজে, আরেকটার তার ভাই, আর তৃতীয়টার পুরোনো এক বন্ধু—নিকোলাউ কোয়েলহো। এই তিনটির সঙ্গে থাকল রসদ বহনের জন্য ছোট আরেকটা জাহাজ।

অভিযানের প্রস্তুতি চলল দীর্ঘ সময় ধরে। অন্তত দুই বছর টিকে থাকার মতো যথেষ্ট পরিমাণে রসদ নেওয়া হলো—শক্ত বিস্কুট, মাংস, ওয়াইন, চাল, কড মাছ আর পনির। অফিসারদের জন্য সরবরাহ করা হলো চমৎকার ছুরি, কাঁটাচামচ আর টেবিলে পাতার লিনেন। ব্যবসা করার উপযোগী জিনিসপত্রও তোলা হলো জাহাজে—আফ্রিকানদের জন্য আয়না, ঘণ্টা, ক্ষুদ্র গয়নার মতো তুচ্ছ বস্তু থেকে শুরু করে ভারতের জন্য চমত্কার কাপড় আর উচ্চমানের পণ্যদ্রব্য বিবেচনা করা হলো, যেহেতু বংশপরম্পরায় ভারত থেকে স্থলপথে আনা হয়েছে দুর্লভ মসলা আর প্রাচ্যদেশীয় রেশম, সেখানকার অধিবাসীরা দাবি করতে পারে ভালো ভালো জিনিস। দা-গামাও জোর দিয়ে বলল যে তার নাবিকদের উচিত অতিরিক্ত একটা কাজ শিখে রাখা, যেমন ছুতোরগিরি কিংবা পাল-তৈরি, যেন তারা মোকাবিলা করতে পারে জরুরি যেকোনো পরিস্থিতি।

যাত্রার প্রস্তুতি শেষ হতেই রাজা চূড়ান্ত এক উৎসবে তার ক্যাপ্টেনদের ডেকে দা-গামার হাতে তুলে দিল দুটি চিঠি। একটা পাবে কালিকটের রাজা (ভারতের মালাবার উপকূলের এই জায়গাটার অনুসরণেই হয়েছে ক্যালিকো কাপড়ের নামকরণ)। আরেকটা প্রবাদপ্রতিম খ্রিষ্টান রাজা প্রেসটার জন, যে আফ্রিকারই কোথাও আছে বলে বিশ্বাস করা হয়। তারপর ক্যাথেড্রালের ঐতিহ্যবাহী হাই মাস শেষে বন্দরে সমবেত বিপুল জনতার অসাধারণ বিদায়ী সম্ভাষণ। এরপর লিসবন থেকে ভাস্কো-দা-গামার ভারত অভিযান শুরু হলো ১৪৯৭ সালের ৮ জুলাই।

তিন সপ্তাহের মধ্যে পালতোলা জাহাজের ছোট বহরটা পৌঁছাল আফ্রিকা মহাদেশের সর্বপশ্চিম প্রান্তের কেপ ভার্দ দ্বীপপুঞ্জে। ৪০ বছর আগেই এই দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করে উপনিবেশ গড়ে তুলেছে পর্তুগিজেরা। ৩ আগস্ট পর্যন্ত দা-গামার অভিযানে বিরতি সেখানেই। উদ্দেশ্য পানিসহ অন্যান্য জিনিস ভান্ডারজাত করা। আবার যাত্রা শুরু হতেই উপকূল ঘেঁষে না গিয়ে ডায়াজের বাতলে দেওয়া সাগরপথ অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন দা-গামা। পশ্চিম আফ্রিকা উপকূলীয় পানির তীব্র বাতাস আর খরস্রোতের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার পর যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেছিল ডায়াজ, সেগুলো মাথায় নিয়ে গামা চললেন বরাবর দক্ষিণে। দক্ষিণ আটলান্টিকে বিরাট এক বেড় দেওয়ার পর আফ্রিকার চেয়ে সে চলে গেল দক্ষিণ আমেরিকার বেশি কাছে। মাঝসাগরে তিন মাস কাটানোর পর দা-গামা বুঝলেন উত্তমাশা অন্তরীপ বা কেপ অব গুড হোপের প্রায় পশ্চিম বরাবর চলছেন তিনি—যদিও অনেকটাই তার অনুমান। যেহেতু দুলতে থাকা জাহাজের ডেকে অ্যাস্ট্রোলেব আর কাঠের কোয়াড্রান্ট নিখুঁতভাবে ব্যবহারের পক্ষে যেমন ভারী তেমনই অসুবিধাজনক। যাহোক, দা-গামার এই অনুমান বেশ ভালো, তাই কেপের মাইল পঞ্চাশেক উত্তরে তাদের চোখে পড়ল সেন্ট হেলেনা বে-র প্রথম স্থলরেখা।

এতগুলো মাস সাগরে থাকার পর জরুরি হয়ে পড়ল জাহাজ পরিষ্কার করা, পালগুলো মেরামত, আর নতুনভাবে তাজা খাবার, পানি আর জ্বালানি কাঠের মজুত করা। তাই ১৪৯৭ সালের ১০ নভেম্বর নোঙর ফেলল জাহাজগুলো।

বহরটা সেন্ট হেলেনা বে-তে থাকল নয় দিন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের সঙ্গে দেখা হলো আদিবাসীদের। বন্ধুভাবাপন্ন কয়েকজনকে দা-গামার জাহাজ সাও গ্যাব্রিয়েলে নেওয়া হলো। সোনা, মুক্তা আর মসলার নমুনা দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো, এ ধরনের জিনিস চায় অভিযাত্রীরা। কোনো সাড়া নেই। বোঝা গেল এসব পণ্যদ্রব্য অপরিচিত আফ্রিকার এই অঞ্চলে। ঘণ্টা আর আংটি উপহার দিয়ে আদিবাসীদের বিদায় করা হলো খুশি মনে। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের বেশি টিকল না এই বন্ধুত্ব। আদিবাসীরা আচমকা চড়াও হলো তীরে নামা এক অফিসারের ওপর। তার চিৎকারে এক জাহাজ থেকে একটা নৌকা ছুটল সাহায্যের জন্য। বাধল দাঙ্গা—ভাস্কো-দা-গামা স্বয়ং আহত হলো আদিবাসীদের এক বর্শায়—তারপর উদ্ধার করা হলো সেই অফিসারকে।

ভাস্কো-দা-গামা

আবার এগিয়ে চলল দা-গামার অভিযান, কিন্তু এবার পরিবর্তিত হলো তাদের ভাগ্য। ১৮ নভেম্বর কেপ অব গুড হোপের দেখা মিলল। কিন্তু প্রচণ্ড প্রতিকূল বাতাসে হতভম্ব হয়ে গেল তারা। পরিস্থিতি ঠিক হলো চার দিন পর। উত্তর বরাবর স্থলরেখা দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠল তারা! তারা বুঝতে পারল, পেছনে পড়ে গেছে অন্তরীপ। সামনেই ভারত।

পথ এখন উত্তর-পুবে। পানি নেওয়ার জন্য সান ব্রাস উপসাগরে থামল তারা। একই সঙ্গে রসদবাহী অপ্রয়োজনীয় জাহাজটা ভেঙে ফেলে সেটার অবশিষ্ট মালামাল নিয়ে গিয়ে তুলল অন্য জাহাজগুলোতে। তারপর আবার ঝড়, প্রতিকূল বাতাস আর স্রোতের মুখে পড়ে একসময় তারা পিছিয়ে চলে গেল ডায়াজের পৌঁছানো সর্বশেষ সীমায়। বড়দিনে ডায়াজের এই সীমার ২০০ মাইল ওপারে আরেকটা স্থলরেখা পেল তারা। দা-গামা সেটার নাম রাখল টিয়েরা ডি নাটালে (এখন এটাই নাটাল বলে পরিচিত)। সাগরে ছয় মাস কাটিয়ে দেওয়ার পর মোহভঙ্গ হলো তিনটি জাহাজের ১৫০ জনের বেশি নাবিকের। স্কার্ভিতে ভুগে তাদের অবস্থা খারাপ (ভিটামিন আবিষ্কার হওয়ার তখনো কয়েক শতাব্দী বাকি)। ১১ বছর আগে ডায়াজের বেলায় যা ঘটেছিল, এবারও ঘটল সেই ঘটনা—বিদ্রোহী হয়ে ষড়যন্ত্র করতে লাগল নাবিকেরা। জাহাজের কর্তৃত্ব দখল করে পর্তুগালে ফিরে যাবে তারা। ষড়যন্ত্র আঁচ করে দ্রুত নির্মম পদক্ষেপ নিলেন দা-গামা। প্রথমে রাগী স্বরে স্তব্ধ করে দিল নাবিকদের। বিদ্রোহী নেতাদের করল বন্দী। তারপর শপথ করে বলল যে ভারতে যাওয়ার সাগর পথ আবিষ্কারের উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত সে পর্তুগালে ফিরে যাবে না।

অনুকূল বাতাস তাদের নিয়ে গেল জাম্বেজি নদীর মোহনায়, যেখানকার আদিবাসীরা সত্যিই বন্ধুভাবাপন্ন আর অনেকটা মার্জিত। তাজা ফল পেল তারা। বুঝতেও পারল না ফলের ভিটামিন সি তাদের সুস্থ করল ভয়ংকর সেই রোগ থেকে। এখানে কয়েক দিন থেকে জাহাজগুলো ঠিকঠাক করল। আদিবাসীদের সুরুচিপূর্ণ পোশাক আর পর্তুগিজদের পণ্যদ্রব্যের প্রতি তাদের উদাসীনতায় বোঝা গেল যে আরব বণিকেরা ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে এই দূর দক্ষিণে।

উত্তেজিত হয়ে পড়লেন দা-গামা। উপকূল বরাবর উত্তরে এগিয়ে পেলেন কর্মব্যস্ততায় পূর্ণ একটা বন্দর আর খড়ের চালের বাড়িঘরের বড় শহর—মোজাম্বিক। এখানে আছে আরবিভাষী মুুর গোষ্ঠী। মূল্যবান ধাতু, পাথর এবং মসলাভরা আরবি জাহাজ। কিন্তু দেখা দিল একটা সমস্যা: পর্তুগিজ আর মূর হলো ঐতিহ্যগত শত্রু। তাই দা-গামা সঠিকভাবেই অনুমান করলেন যে এখানে লড়াই বাধতে পারে। প্রথমে পর্তুগিজদের তুর্কি মনে করে স্বাগত জানাল তারা। তবে সত্য বুঝতে তাদের দেরি হলো না। দা-গামা আর কোয়েলহো যখন গেল দুজন পাইলটের খোঁজে, যারা তাদের উপকূলের শেষ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে বলে কথা দিল, ছোট ছোট নৌকায় করে তাদের পথরোধ করে দাঁড়াল সশস্ত্র মুরেরা। তৎক্ষণাৎ ছোট কামানের গোলাবর্ষণের নির্দেশ দিল দা-গামা। মুররাও পালিয়ে গেল তৎক্ষ ণাৎ, কিন্তু বিচক্ষণ দা-গামা প্রতিশোধের ঘটনা ঘটতে পারে এই ভয় পেয়ে জাহাজের নোঙর তুলে রওনা দিল আর কালবিলম্ব না করে।

মৃদুমন্দ অনুকূল বাতাস, তবু তীব্র স্রোত খানিকটা পেছনে সরিয়ে দিল পর্তুগিজদের। দা-গামা উদ্বিগ্ন। অনুকূল বাতাসের বেগ বাড়ার জন্য অপেক্ষমাণ। তখনই মুরদের সঙ্গে ঘটল আরেক দফা লড়াই। পর্তুগিজ বহর মোম্বাসা (বর্তমানে কেনিয়া) পৌঁছার আগেই সেখানে পৌঁছে গেল তাদের শক্তিশালী অস্ত্রের কথা। পর্তুগিজ অতিথিদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করল মোম্বাসার রাজা। পাঠাল উপহারসামগ্রী, সঙ্গে বিপুল পরিমাণ কমলা আর লেবু (স্কার্ভি রোগের প্রতিষেধক, যদিও রাজা তা জানত না)। সেই সঙ্গে জানাল জাহাজগুলোকে মোম্বাসা বন্দরে প্রবেশের সাদর আমন্ত্রণ। দা-গামা সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ল জাহাজে তুলে নেওয়া কয়েকজনের অদ্ভুত আচরণে। তাদের দুজনের ওপর অত্যাচার চালাতে লাগল সে। উভয়ের বাহুতে ঢালতে লাগল গরম তেল। যতক্ষণ না তারা স্বীকার করল যে পর্তুগিজ জাহাজগুলো বন্দরে প্রবেশ করামাত্র আক্রমণ চালিয়ে সব কটি দখল করে নেওয়া হবে মোজাম্বিকের ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে। বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। ওদিকে মোম্বাসার রাজা দেখলেন বন্দরে প্রবেশের কোনো ইচ্ছেই নেই অতিথিদের। ব্যস, গভীর রাতে চুপচাপ নৌকায় উঠে আক্রমণ চালাল মোম্বাসাবাসী। কিন্তু পর্তুগিজরা সতর্ক থাকায় তা সম্পূর্ণ বিফলে গেল।

দুই দিন পর আবার ভাসল দা-গামার বহর, মোম্বাসার রাজার ফলের উপহারে নাবিকদের রোগও সারতে লাগল ধীরে ধীরে। দা-গামার মনে হলো দূর উত্তরে চলেছে সে, যা তাকে নিয়ে যাবে লোহিত সাগরে। ভারত এখন স্টারবোর্ডের দিকে—কিন্তু কতটা? এই পর্যায়ে তার দরকার অভিজ্ঞ একজন পাইলট।

মুরদের ছোট একটা জলযান দখল করে, সেটার যাত্রীদের প্রশ্ন করার মাধ্যমে দা-গামা জানতে পারল যে উত্তরে অদূরেই আছে মালিন্দি বন্দর, আর সেখানে পাওয়া যাবে ভারত থেকে আসা খ্রিষ্টান সব জাহাজ। পর্তুগিজরা শহরের বাইরে নোঙর ফেলে, একটা লংবোটে করে মুর বন্দীদের তীরে পাঠাল। উদ্দেশ্য রাজাকে এই বার্তা দেওয়া যে অতিথিরা এসেছে শান্তি আর শুভেচ্ছা নিয়ে। রাজা সেই বার্তার জবাব দিল দা-গামাকে উপহার পাঠিয়ে তাকে তীরে নামার আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে। প্রতিদানে দা-গামাও উপহার পাঠাল রাজাকে, কিন্তু মোম্বাসার ঘটনা স্মরণ করে জাহাজ থেকে নামতে রাজি হলো না। যাহোক, রাজা ছিল আন্তরিক, তাই দা-গামা মালিন্দির মাটিতে পা রাখতে বারবার অস্বীকার করলেও শেষমেশ রাজার সঙ্গে দেখা করল বজরায় গিয়ে—যেখানে তাকে রাজকীয়ভাবে আপ্যায়ন করা হলো নয় দিন ধরে। আশপাশের জাহাজের খ্রিষ্টানরা এসে উঠল পর্তুগিজ বহরে, রাজা অবশেষে দা-গামাকে জোগান দিল একজন পাইলট যে সাগরে পথ দেখিয়ে তাকে নিয়ে যাবে ভারতে। ১৪৯৮ সালের ২৪ এপ্রিল পর্তুগিজ ছোট বহরটা শুরু করল তাদের যাত্রার শেষ অংশ।

এক মাস লাগল তাদের ভারতে প্রবেশ করতে। যখন জাহাজগুলো নোঙর ফেলল কালিকটে, পূরণ হলো ভাস্কো-দা-গামার উদ্দেশ্য—সে আবিষ্কার করে ফেলেছে ভারতে আসার সাগর পথ। যাহোক, পর্তুগিজদের স্বাগত জানানোয় আগ্রহ দেখা গেল খুবই কম, যথেষ্ট শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করল স্থানীয় আরব বণিকেরা। তাদের একচেটিয়া ব্যবসা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায়। সেই দূর অতীতেও ব্যবসা ছিল বর্তমানের মতোই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যদিও রাজা ছিল বেশ বন্ধুভাবাপন্ন, আরবেরা হিন্দুদের সাবধান করল এই বলে যে পর্তুগিজরা ব্যবসা করতে নয়, এসেছে ভারত জয় করতে।

দা-গামার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও লড়াই বেধে গেল হিন্দু আর পর্তুগিজদের মাঝে। দা-গামা স্বয়ং অপহৃত হলো এবং নিশ্চিত খুনও হয়ে যেত, যদি না অতি দ্রুত তৎপর হতো তার ভাই; সে কালিকটের কয়েকজন গণ্যমান্য নাগরিককে আটক করে রাখল জামিন হিসেবে, যতক্ষণ না নিরাপদে ফিরে এল দা-গামা। কিন্তু পর্তুগিজদের পক্ষে আর সম্ভব হলো না কালিকটে থাকা। তারা চলে গেল উপকূলের মাইল পঞ্চাশেক উজানের কানামোরে এবং সেখানেই প্রতিষ্ঠিত করল বন্ধুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক। সে বছরই নভেম্বর মাসে জাহাজগুলো তাদের খোল মসলায় ভর্তি করে শেষমেশ রওনা দিল দীর্ঘ ফিরতি পথে।

নাবিকেরা হলো আনন্দে আটখানা, কিন্তু তাদের ঝামেলা শেষ হলো না। শান্ত সাগর আর খেয়ালি মৃদু বাতাস হতবুদ্ধি করে ফেলল বহরকে এবং আবারও স্কার্ভির প্রকোপে মরতে লাগল মানুষ। দা-গামা থামল মালিন্দিতে আর রাজাকে দিল ভারতীয়দের অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করা দশ সিন্দুকভর্তি পর্তুগিজ পণ্যদ্রব্য, তারপর ১৪৯৯ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণে জাহাজ ভাসাল কেপ অব গুড হোপ অভিমুখে। যদিও আর কোনো বন্দরে তারা থামল না, প্রবাহিত হলো প্রবল অনুকূল বাতাস, অন্তরীপ পার হতে তাদের লেগে গেল তিন মাস।

আটলান্টিকে নামল ঝড়। দুলতে লাগল ছোট জাহাজগুলো দেশলাই কাঠের মতো, প্রায় তিন বছরের কঠোর পরিশ্রম আর অসুস্থতায় দুর্বল হয়ে যাওয়া মানুষগুলো মরতে লাগল মাছির মতো। জাহাজগুলো যখন অ্যাজোরেস পৌঁছাল, তখন আর তাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট মানুষ জীবিত নেই। মোট মানুষের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পর্তুগালে ফিরতে পারল প্রাণ নিয়ে। এমনকি ভাস্কো-দা-গামার ভাই পাওলো অনেক মাসের রোগভোগের পর মারা গেল অ্যাজোরেসে। তারা পর্তুগালে ফেরার আগেই পৌঁছে গেল তাদের ফেরার সংবাদ, আর সেপ্টেম্বরে অবশেষে যখন তারা পৌঁছাল লিসবনে, জুটল তাদের এক কোলাহল আর আবেগপূর্ণ সংবর্ধনা। উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল পুরো দেশ, ভাস্কো-দা-গামার ওপর বর্ষিত হলো সম্মানের পর সম্মান। অবশেষে অঙ্কিত হয়েছে ভারতে যাওয়ার সাগরপথের মানচিত্র, এবার পুরোনো স্থলপথের পরিবর্তে প্রাচ্যের যাবতীয় মূল্যবান সম্পদ এদিক দিয়ে অনেক সস্তায় আনা যাবে পাশ্চাত্যে। ধনী হবে পর্তুগাল—এবং সেই সময় থেকে সত্যিই সূচিত হলো দেশটার সৌভাগ্য, কিন্তু কতটা উচ্চ মূল্য, আর কতখানি চরম নিয়তির বিনিময়ে?